সম্মাননা-জাকির হোসেন ও ধ্রুপদি সংগীতের বিশ্বায়ন by হায়াৎ সাইফ

ভারতীয় তথা উপমহাদেশীয় ধ্রুপদি সংগীতকে যে কজন ক্ষণজন্মা সংগীত ব্যক্তিত্ব একটা বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে গেছেন, তাঁদের মধ্যে একটা উজ্জ্বল নাম ওস্তাদ জাকির হোসেন, যিনি মূলত তবলাবাদক। তবলাবাদনে তিনি একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিয়েছেন। বাদনে তাঁর প্রতিভা বাল্য বয়সেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।


মাত্র ১২ বছর বয়স থেকেই তিনি দেশ-বিদেশে বাদনে সক্রিয় হন।
তিনি কিংবদন্তির তবলাবাদক আল্লা রাখা খানের পুত্র, যিনি একাত্তর সালে জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে বিখ্যাত ‘কনসার্টফর বাংলাদেশ’-এ অংশ নেন।
ভারতীয় সংগীতে তবলার স্থানটি কিন্তু একেবারে কেন্দ্রীয়। যেকোনো যন্ত্র বা কণ্ঠ সংগীতের সঙ্গে সংগীতের তাল ও মাত্রা নির্দিষ্ট করতে তবলার জুড়ি নেই। বর্তমানে তিনি ভারতীয় সংগীতবিদদের মধ্যে সম্ভবত সর্বাপেক্ষা পরিচিত। তাঁর খ্যাতি পাশ্চাত্যের সর্বত্র ছড়িয়ে গেছে।
অনন্য প্রতিভার অধিকারী জাকির হোসেন অল্প বয়সেই পণ্ডিত রবিশংকরের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পান। তাঁর সাংগিতিক জীবনের প্রাথমিক পর্যায়েই তিনি ভারতীয় ও পাশ্চাত্যের বিখ্যাত ব্যান্ডের সঙ্গে ফিউশন মিউজিকের মাধ্যমে সমন্বিত সংগীত সৃষ্টি করতে থাকেন। বিটলদের সঙ্গে কাজ করেছেন, আমেরিকান সাইকাডেলিক ব্যান্ড ‘শান্তি’র জন্য কাজ করেছেন এবং ‘প্ল্যানেট ড্রাম’ শীর্ষক অ্যালবামে যুগ্মভাবে কাজ করেছেন মিকি হার্টের সঙ্গে ১৯৯২ সালে। তাঁর প্রথম সোলো অ্যালবাম মেকিং মিউজিক ভারতে এবং পাশ্চাত্যের সর্বত্রই বিপুলভাবে সমাদৃত হয়। ১৯৯২ সালেই ওস্তাদ জাকির হোসেন ভারতীয় শীর্ষ ধ্রুপদি ব্যক্তিত্বদের নিয়ে তাঁর কনসার্ট বাদন ব্যবস্থাপনা ‘দি রিদম এক্সপেরিয়েন্স’ প্রতিষ্ঠা করেন। রিদম এক্সপেরিয়েন্সের ব্যানারে তিনি উত্তর ও দক্ষিণ ভারতীয় ধ্রুপদি কনসার্ট রেকর্ড করেন। তিনি অন্তত ১৫০টি অ্যালবাম প্রকাশ করেছেন।
ওস্তাদ জাকির হোসেন বিশ্বসংগীতে খুব বড় ধরনের কিছু কাজ করেছেন। তিনি বিল ল্যাসওয়েলের সঙ্গে ‘ওয়ার্ল্ড মিউজিক সুপার গ্রুপ’ নামের তবলা-বিটস-সায়েন্স বা তবলাবাদন-বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠা করেন। বিখ্যাত ‘সিল্ক রোড কোলাবোরেটিভ মিউজিক্যাল প্রজেক্ট’-এ তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। তিনি দুটি তবলা-সম্পর্কিত ছবিতেও অংশ নিয়েছেন। তার একটি হচ্ছে বিখ্যাত দি স্পিকিং হ্যান্ড: জাকির হোসেন অ্যান্ড দি আর্ট অব ইন্ডিয়ান ড্রাম। বস্তুত ওস্তাদ জাকির হোসেনের দুটি হাত যেন কথা বলে। তাঁর তবলাবাদন এমনই জাদুময়। আরেকটি ১৯৯৮ সালে প্রস্তুত ডকুমেন্টারি জাকির অ্যান্ড হিজ ফ্রেন্ডস। পাশ্চাত্যের বাদকদের মধ্যে তিনি কেবল মিকি হার্টের সঙ্গেই কাজ করেননি, তিনি বিখ্যাত জাজ সংগীতজ্ঞ জন ম্যাক লাফলিনের সঙ্গে অনেকগুলো ফিউশন প্রজেক্ট করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে ‘শক্তি’ (১৯৭৫, কলাম্বিয়া), ‘এ হ্যান্ডফুল অব বিউটি’ (১৯৭৬, কলাম্বিয়া) ও ‘ন্যাচারাল এলিমেন্টস’ (১৯৭৭, সিবিএস)। পরবর্তীকালে ম্যাক লাফলিন জাকিরের অ্যালবাম মেকিং মিউজিক-এ অংশ নেন। বছর বিশেক পরে তাঁরা আবার একত্র হন রিমেম্বার শক্তি (১৯৯৯, ইউনিভার্সাল রেকর্ডস) অ্যালবাম দিয়ে। তাঁর গ্লোবাল ড্রাম প্রজেক্ট অ্যালবামটি শ্রেষ্ঠতম সমসাময়িক বিশ্বসংগীত অ্যালবাম হিসেবে ২০০৯ সালে গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। বেলা ফ্লেক ও এডগার মায়ারকে একটা ট্রিপল কনসার্টো তৈরি করার জন্য ন্যাশভিল সিম্ফনি নিয়োজিত করলে তাঁরা তাঁদের তৃতীয় সঙ্গী হিসেবে জাকিরকে বেছে নেন। এই কনসার্টোটি ‘দি মেলোডি অব রিদম’ নামে ২০০৬ সালে প্রিমিয়ার হয়। এই তিনজনে মিলে আরও বেশ কয়েকটি সিডি প্রকাশ করেন। এতে সংগীত পরিচালনা করেছিলেন লিওনার্দো স্ল্যাটকিন।
ওস্তাদ জাকির হোসেন বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন এবং অংশও নিয়েছেন। এর মধ্যে কোনো কোনোটি একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত হয়। তিনি বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে সাউন্ড ট্র্যাক তৈরি করেছেন এবং ফ্রান্সিস কপোলার ‘অ্যাপোক্যালিপস নাও’ ও বার্নার্দো বার্টোলুচির ‘লিটল বুদ্ধা’র সাউন্ড ট্র্যাকে তবলাবাদনের কাজও করেছেন।
এভাবে তাঁর সংগীতজীবনে বেশ অল্প বয়স থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত পরিণত বয়সে তিনি অনবরত ভারতীয় ধ্রুপদি সংগীতকে পাশ্চাত্য ধ্রুপদির সঙ্গে সংমিশ্রিত করে এক নতুন প্রজন্মের বিশ্বসংগীত সৃষ্টি করেছেন। তিনি বিভিন্ন ধরনের সংগীতকে তাঁর সবকিছুর ওপরে একটি পরিপূর্ণ সামগ্রিকতার সঙ্গে সাংগিতিক বিচারকে স্থাপন করেছেন। ফলে আন্ত-সাংস্কৃতিক এক উজ্জ্বল অঙ্গনে তাঁর কর্মকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। এই অনন্য তবলাবাদক ও ভারতীয় ধ্রুপদ সংগীতজ্ঞ পাশ্চাত্য ধ্রুপদ সংগীত ও ভারতীয় ধ্রুপদ সংগীতের মধ্যে যে বৈসাদৃশ্য, তা সুস্পষ্টরূপে অনুধাবন করেন।
অসংখ্য সম্মাননা তিনি পেয়েছেন। এর মধ্যে প্রধান কয়েকটি উল্লেখ করা যায়: ১৯৮৮ সালে পদ্মশ্রী, ১৯৯২ সালে গ্র্যামি, ১৯৯৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অত্যন্ত উচ্চ সম্মাননা ন্যাশনাল হেরিটেজ ফেলোশিপ, ২০০২ সালে ভারতীয় সংগীতে অবদানের জন্য পদ্মভূষণ। এ ছাড়া প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি তাঁকে ওল্ড ডোমিনিয়ন ফেলো হিসেবে সম্মানিত করে। সেখানে তিনি সংগীত বিভাগে ফুল-প্রফেসর হিসেবে কাজ করেছেন এবং স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে পড়িয়েছেন।
ব্যক্তিগত জীবনে ওস্তাদ জাকির হোসেন বিবাহিত। তাঁর স্ত্রী বিখ্যাত কত্থক নৃত্যশিল্পী, একজন ইতালিয়ান আমেরিকান—এন্তোনিয়া মিনাকোলা। তাঁর দুই কন্যাসন্তান—আনিসা কোরেশি ও ইজাবেলা কোরেশি। যাঁরা দুজনেই শিল্পকলা সম্পর্কে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। এই অসাধারণ প্রতিভার কাছ থেকে বিশ্বময় শ্রোতারা উন্মুখ হয়ে থাকে তাঁর তবলাবাদনে বিশ্বসংগীতের তাল-প্রবাহকে তিনি কী করে পরিবর্তিত করে দেন, তা প্রত্যক্ষ করার জন্য।
হায়াৎ সাইফ: লেখক ও সাবেক সরকারি কর্মকর্তা।

No comments

Powered by Blogger.