চারদিক-আনা দিলি by মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান

আমি দেড় বছর ধরে ইংরেজিতে ‘২১ ফেব্রুয়ারি সকল ভাষার কথা কয়’ শীর্ষক একটি মাতৃভাষার কবিতার সংকলন তৈরি করছিলাম। টেক্সাসে আমার এক তুর্কি-দম্পতির সঙ্গে আলাপ। আন্তর্জাতিক শান্তি ও সম্প্রীতিবিষয়ক এক ভোজসভায় আবার তাঁদের সঙ্গে দেখা। আমি তুর্কি ও কুর্দি ভাষার দুটো কবিতা চাইলাম।


কয়েক মাস পরে দুটো কবিতা পেলাম। একটার নাম আনা দিলি। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড ল-এর এক তরুণ গবেষক শারওয়াত শামীনকে বললাম, ‘কবি আনা দিলির একটা পরিচিতি ইন্টারনেট থেকে বের করুন।’ উনি ইন্টারনেট ঘেঁটে বললেন, ‘আনা দিলি কোনো লেখকের নাম নয়। আনা দিলি মানে মাতৃভাষা।’
আজেরি ভাষার বইয়ের ওপরে স্থাপিত একটি পালক কৃষ্ণ মর্মরে নির্মিত ‘আনা দিলি’র নকশা করেন ভাস্কর এলমান লেলেইয়েভ। শিক্ষায় মাতৃভাষার গুরুত্বকে তিনি আলোকিত করতে চান। এই ভাস্কর্য একটি অনন্য ভাস্কর্য, যা আজারবাইজানিদের প্রতি উৎ সর্গীকৃত। উচ্চবিদ্যালয়ের আজেরি পাঠ্যপুস্তকের প্রচ্ছদে এটি শোভা পাচ্ছে।
সবশেষে আজেরি ভাষার দুটো কবিতা উদ্ধৃত করে এ লেখাটি শেষ করি।


আজেরি ভাষা
বাখতিয়ার ওয়াহাবজাদে (১৯৬৭)
আমার মা

সে নিরক্ষর
তার নিজের নাম লিখতে পারে না, আমার মা।

কিন্তু সে আমাকে গনতে শিখিয়েছে।
সে আমাকে মাস আর বছরের
নাম শিখিয়েছে।
আর তার চেয়ে বড় কথা
সে আমাকে ভাষা শিখিয়েছে, আমার মা।

আমি স্বাদ নিয়েছি
আনন্দ ও দুঃখের
এই ভাষাতে।
আর আমি সৃজন করেছি প্রতিটি কবিতা
আমার
আর প্রতিটি সুর
এই ভাষাতে।

এ ব্যতিরেকে
আমি কেউ না।
আমি মিথ্যা।
আমার কাজের সৃজনকর্ত্রী,
সকল খণ্ড সকল খণ্ডের,
আমার মা!
ওয়াকিফ সামাদোগলু
১৯৩৯-১৯৬৪

আমি ভুলে যেতে পারি তোমার ব্যাকরণের নিয়ম
কিন্তু কোনো দিনই আমি ভুলতে পারি না
তোমার শব্দমালা,
তোমার নানা আঞ্চলিক কথা।

যদি কোনো দিন
অকস্মাৎ , জীবনের তুহিন বাতাস
যদি আমাকে অন্যসব ভাষার সমুদ্রে ফেলে দেয়।
আমি ভুলব না, এক মুহূর্তের জন্যও নয়,
তোমার দুঃখ,
তোমার আনন্দ
তোমার আশা।
আর আমি কোনো দিনই ভুলব না তোমার আবেগ,

আমার মাতৃভাষা, আজেরি।

গত এক শ বছর ধরে সেখানে হরফ নিয়ে যে পিংপং খেলা হয়েছে, তা যেমন কৌতূহলোদ্দীপক, তেমনি মর্মন্তুদ। বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকের আগে প্রায় ১৩ শ বছর ধরে আজারবাইজানে ফারসি হরফের ওপর ভিত্তি করে পরিবর্তিত আরবি হরফ চালু ছিল। বিশের দশকের শেষে দেশে সাক্ষরতা আন্দোলনে সহায়ক ভূমিকা রাখার জন্য লাতিন হরফ প্রবর্তন করা হয়। পেছনে আরও কিছু গূঢ় কারণ ছিল বলে অনুমান করা হয়। ওই অঞ্চলে ইসলামের প্রভাব সীমিত বা সংকুচিত রাখার জন্য এবং সোভিয়েত তুর্কি প্রজাতন্ত্রগুলো, যেমন—কাজাখস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কিরঘিজস্তান ও অন্য ছোট ছোট তুর্কিভাষী তাতারের মতো জনজাতিগুলো যেন নিজেদের মধ্যে কোনো সংহতি বা মৈত্রী সংগঠনের মাধ্যমে সোভিয়েত সার্বভৌমত্ব বা প্রাধান্যের কোনো ক্ষতিসাধন না করতে পারে সে চিন্তাও ছিল লাতিন হরফ প্রবর্তনার পেছনে।
সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ এই আন্দোলনকে ইসলামের প্রভাব হ্রাসের বড় সহায়ক মনে করে। ১৯২৬ সালে বাকুতে প্রথম আন্তর্জাতিক তুর্কিতত্ত্বের কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। সেই সময় লাতিন হরফকে তুর্কিভাষীদের সাধারণ ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার সুপারিশ করা হয়।
১৯২৮ সালে তুরস্ক লাতিন বর্ণমালা গ্রহণ করে। দুই বছরের মধ্যে সব তুর্কি প্রজাতন্ত্র লাতিন বর্ণমালা চালু করে। এই সময়ে নতুন বর্ণমালা চালু করার সঙ্গে সঙ্গে সোভিয়েত নারীবাদী আন্দোলনের স্লোগান ‘চাদর নিপাত যাক’ ধ্বনিত হয়। নারী-প্রগতি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ৯৮ শতাংশ সাক্ষরতা বৃদ্ধি পায়। ইতিমধ্যে যাঁরা লাতিন বর্ণমালা সম্পর্কে বাকু কংগ্রেসে সোচ্চার হন, তাঁরা স্তালিনের বিরাগভাজন হন। অনেকে নিখিল তুর্কবাদ প্রচারের জন্য নির্বাসিত হন, অনেকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হন। স্তালিন আশঙ্কা করেন, ব্যাপক লাতিন হরফের চল তুর্কিভাষীদের মধ্যে এমন ঐক্য গড়ে তুলবে, যা সোভিয়েত প্রাধান্য ক্ষুণ্ন করবে। ১৯৩৭ সালে স্তালিন সব তুর্কি প্রজাতন্ত্রের জন্য সিরিলিক বর্ণমালা বাধ্যতামূলক করেন। স্তালিনের জন্মস্থান জর্জিয়া ও তাঁর ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা মিকোইয়ানের দেশ আর্মেনিয়ায় চালু বর্ণমালা অপরিবর্তিত থাকে। ১৯৩৯ সালে সোভিয়েত তুর্কি প্রজাতন্ত্রগুলোতে লাতিন বর্ণমালার পরিবর্তে রুশ ভাষায় ব্যবহূত সিরিলিক বর্ণমালা চালু করা হয়। জ্বালানি তেল-উৎ পাদন প্রবৃদ্ধির সময় গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে হরফ বিষয়টা বিশেষ পর্যালোচনা করা হয় এবং ভাবা হয় আজারবাইজান ভাষার সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে একেবারে নতুন একটি লাতিন বর্ণমালা তৈরি করা যায় কি না। যখন ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে এবং আজারবাইজান স্বাধীনতা অর্জন করে, তখন ডিসেম্বর ১৯৯১ খুব স্বাভাবিকভাবেই লাতিন বর্ণমালা পুনঃপ্রবর্তিত হয়।

No comments

Powered by Blogger.