খেলা-ক্রিকেট ও গণতন্ত্রের কাকতালীয় সম্পর্ক! by এ কে এম জাকারিয়া

তিউনিসিয়ার পর মিসর। পরপর এ দুটি ঘটনা আবারও আমাদের মনে করিয়ে দিল যে শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রই যেন শেষ কথা। তা না হলে তিউনিসিয়ার ঘটনা, যাকে সুনামির সঙ্গে তুলনা করে ‘টিউনিসামি’ বলতে শুরু করেছেন অনেকে, সেই ঢেউ পুরো আরব দুনিয়াকে আঘাত করবে কেন! তিউনিসিয়া থেকে পালালেন বেন আলী,


এর পরপরই মিসরে স্লোগান উঠল, ‘ইহরাল মোবারক ইহরাল’ (সোজা বাংলায়—মোবারক তুমি ভাগো)। মোবারককেও ভাগতে হলো। গণতন্ত্র যখন আবার আলোচনায়, তখন সবকিছুতে ‘গণতন্ত্র’ খুঁজতে দোষ কোথায়? বাংলাদেশে এখন আবার ক্রিকেটের সময়। বিশ্বকাপ ক্রিকেট নিয়ে মেতেছে দেশ। এই খেলাটির মধ্যেও তো আমরা ‘গণতন্ত্র’ খুঁজতে পারি। এর রাজনীতি, বিকাশ ও ইতিহাস—এসব পুরোনো কিছু বিষয় আবার নতুন করে ঘাঁটাঘাঁটি করতে পারি। ‘গণতন্ত্র’ নাম নিয়ে একসময় যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা শুরু হয়েছিল তার অনেক রূপান্তর, পরিবর্তন হয়েছে। গণতন্ত্রের এই রূপান্তর কতটা ‘গণতান্ত্রিক’ হয়েছে সেটাও এখন আলোচনার বিষয়। একসময় দুনিয়াকে সাম্রাজ্য বানিয়েছিল যে শক্তি, তাদের হাতে তৈরি ও পরিপুষ্ট হয়েছে ক্রিকেট। আবার আধুনিক গণতন্ত্র বলতে আমরা যা বুঝি তার বিকাশের পেছনেও রয়েছে একসময়ের এই ঔপনিবেশিক শক্তি। ‘অভিজাতদের’ খেলা ক্রিকেটের গণতান্ত্রিক রূপান্তর বা পরিবর্তন অথবা এর সঙ্গে গণতন্ত্রের সম্পর্কটা আসলে কী; বা আদৌ কি কোনো সম্পর্ক আছে?
একসময় যা ছিল শুধুই ‘ব্রিটিশদের খেলা’, তা এখন ফুটবলের পর বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা—অর্থ, টিভি কভারেজ, রাজনীতি ও এমন আরও অনেক বিবেচনায়। আজকের যে ক্রিকেট খেলা, তার ধরন শুরুতে তো আর এমন ছিল না। অনেক পরিবর্তন আর রূপান্তরের মধ্য দিয়ে এখানে এসে দাঁড়িয়েছে। ১২ শতকের ল্যাটিনভাষী ব্রিটিশ কবি জোসেফ ব্যাট ও বলের খেলা ক্রিকেটের যে বর্ণনা ১১৮২ সালে দিয়েছেন, সেই ক্রিকেট ছিল অনেকটা আধুনিক ক্রিকেট ও বেসবলের মিশেল। এরও অনেক পরে ১৭০৪ সালে প্রকাশিত হয় ক্রিকেটের বিধিবিধান। নিয়মকানুন মেনে একটি পূর্ণাঙ্গ খেলা হিসেবে মাঠে ক্রিকেট খেলা শুরু হয় তখন থেকেই। এই বিধিবিধানের ওপর ভিত্তি করেই ১৭৮৯ সালে তৈরি হয় ‘ক্রিকেট আইন’। খেলার একমাত্র ‘আইন’। ক্রিকেট হচ্ছে বিশ্বের একমাত্র খেলা, যার একটি আইন রয়েছে। এই আইনের (law) অধীনেই খেলাটি হয়, বিধি (rules) দিয়ে নয়। ক্রিকেট খেলার সব বিধিবিধান গড়ে উঠেছে ক্রিকেট আইনের (laws of cricket,1789) ওপর ভর করে। রাষ্ট্র যেমন চলে একটি সংবিধান দিয়ে, অনেকটা সে রকম। সংবিধানকে মেনেই তৈরি হয় রাষ্ট্র পরিচালনার বিধিবিধান। ক্রিকেটের সঙ্গে রাষ্ট্র, রাজনীতি—এসবের তো মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে সহজেই!
একমাত্র মার্কিন সংবিধানের সঙ্গেই নাকি ক্রিকেট আইন তুলনীয়। ১৭৮৮ সালে তৈরি হয়েছিল মার্কিন সংবিধান; আর এর পরের বছরই রচনা হয়েছে ক্রিকেট আইন (১৭৮৯)। পর পর বছরে লেখা বলেই কি এই তুলনা? না। মার্কিন সংবিধানও গড়ে উঠেছে শুধু আইনের ওপর ভিত্তি করে। আকারের দিক দিয়েও দুটি প্রায় সমান। ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই আইন দুটি দাপটের সঙ্গে প্রভাবিত করে যাচ্ছে মানবসভ্যতাকে, গণতন্ত্র, রাজনীতি ও খেলায়। রাজনীতিও একধরনের খেলা, আবার খেলাকেও তো রাজনীতি থেকে আলাদা করা যাচ্ছে না!
‘ব্রিটিশ’ খেলাটি ১৭ শতকে দেশটির বাইরের শুরু হওয়ার পেছনে ব্রিটিশ উপনিবেশ, রাজনীতি—সবই কাজ করেছে। সাম্রাজ্য রক্ষায় বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ব্রিটিশ সেনা ও সেনা কর্মকর্তারা যে ঘাঁটি গেড়েছিলেন, তাঁদের মাধ্যমেই ক্রিকেটের ভিত গড়ে ওঠে দেশটির বাইরে। রাজনৈতিক উপনিবেশ গড়তে সামরিক শক্তি যেমন লাগে, তেমনি উপনিবেশ রক্ষা করতে গেলে সাংস্কৃতিক আধিপত্যও কায়েম রাখতে হয়। ১৭৮৯ সালের ক্রিকেট আইন দিয়ে যে আধুনিক ক্রিকেটের সূচনা, ১৯৬৪ সালের আগ পর্যন্ত ইংল্যান্ড অথবা অস্ট্রেলিয়া—এই ছিল শীর্ষ দুটি দেশ। রাজনৈতিক ভাষায় গণতন্ত্রায়ণ বা পরিবর্তন যা-ই বলি, তার শুরু এর পর থেকে, আস্তে আস্তে উঠে এসেছে অনেক দেশ। এখনকার ইতিহাস সবার জানা। কিন্তু ১৭৮৭ সালে মেরিলেবন ক্রিকেট ক্লাবের (এমসিসি) নেতৃত্বে ১৭৮৯ সালে যে ‘ক্রিকেট আইন’ রচিত হয়েছে, তারা এখনো ‘ক্রিকেটের চেতনা’ বলতে যা বোঝায় তার অভিভাবক হিসেবেই বিবেচিত। ক্রিকেট আইনের সংরক্ষণের (custodianship) দায়িত্বও এককভাবে এই প্রতিষ্ঠানটির। বিশ্বের ১০টি সেরা ক্রিকেট খেলুড়ে দেশের মধ্যে তিনটি ছাড়া বাকি সবই উন্নত দেশের বাইরে। কিন্তু এমসিসি ও এর মূল কমিটির সবাই একটি দেশের নাগরিক, সবাই ব্রিটিশ।
আমাদের রাজনৈতিক সমাজ বা এখনকার রাজনৈতিক রাষ্ট্রকাঠামোতে প্রচলিত বিভিন্ন টার্ম দিয়ে আমরা ক্রিকেটের নানা কিছু ব্যাখ্যা করতে পারি। রাষ্ট্রের একটি সংবিধান লাগে, আবার রাষ্ট্র চালানোর জন্য নিয়মিত সংবিধান মেনে নতুন বিধিবিধান তৈরি করতে হয়। রাষ্ট্রের আইনসভা বা পার্লামেন্ট তা করে থাকে। ক্রিকেটের ক্ষেত্রেও বিষয়টি একইভাবে সত্য। খেলার নতুন নতুন বিধিবিধান তৈরি ও ক্রিকেট আইনের ব্যাখ্যা করার একক কর্তৃত্ব খাঁটি ব্রিটিশদের প্রতিষ্ঠান এমসিসির। তাদের করা ক্রিকেট আইনের সর্বশেষ সংস্করণ যা ‘2000 Code 4th Edition 2010’ নামে পরিচিত, তা ১ অক্টোবর ২০১০ সাল থেকে কার্যকর হয়েছে। তবে আইন কার্যকর করার একক ক্ষমতা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট পরিষদের (আইসিসি)। বিষয়টি অনেকটা আধুনিক রাষ্ট্রের আইনসভা ও নির্বাহী বিভাগের মতো। এ ক্ষেত্রে ‘আইনসভা’ এমসিসি আর ‘নির্বাহী বিভাগ’ হচ্ছে আইসিসি। তবে গঠনের দিক দিয়ে এই প্রতিষ্ঠান দুটির চরিত্র ‘আইনসভা’ আর ‘নির্বাহী বিভাগের’ প্রায় উল্টো। ‘নির্বাহী বিভাগ’ হলেও আইসিসি বিভিন্ন ক্রিকেট খেলুড়ে দেশের সদস্যদের নিয়ে গঠিত, বলা যায় প্রতিনিধিত্বমূলক, গণতান্ত্রিক। অন্যদিকে ক্রিকেটের বিধিবিধান তৈরি ও সংশোধনের ‘আইনসভা’ হয়েও এমসিসি শুধু একটি দেশের নাগরিকদের নিয়ে গঠিত, প্রতিনিধিত্বশীল কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। এর বাইরে খেলার আম্পায়ার, রেফারিংয়ের দায়িত্ব, বিভিন্ন অভিযোগের তদন্ত, প্রশিক্ষণ, খেলার উন্নয়ন, স্পনসরশিপ, টিভি স্বত্ব নিয়ে সমঝোতা করা—সবই আইসিসির কাজ। ২০০৫ সালের আগ পর্যন্ত এমসিসি ও আইসিসি—দুটোরই মূল দরবার ছিল লন্ডনের লর্ডসের মাঠ। সে বছর আইসিসির সদর দপ্তর দুবাই সরে আসার পর ক্রিকেটের ওপর ইংল্যান্ডের আধিপত্য প্রতীকীভাবে হলেও কমছে। ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান এমনকি বাংলাদেশের দাপটে ক্রিকেট দুনিয়ায় এশিয়ার শক্তিকে এখন আর এড়ানোর সুযোগ কই। ক্রিকেট নিয়ে পাগলামি আর দর্শকসংখ্যা—এই দুটি বিবেচনায় নিলে এখন এই মহাদেশটির ধারেকাছেও কেউ নেই। ২০০৬ সালে এসে অবশ্য ‘এমসিসি বিশ্ব ক্রিকেট কমিটি’ নামে একটি নতুন কমিটি তৈরি হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বর্তমান ও সাবেক ক্রিকেটার ও আম্পায়ারদের নিয়ে গঠিত হয়েছে এই কমিটি। তারা বছরে দুবার বসেন খেলাটির ‘prevalent issues’ নিয়ে আলোচনার জন্য। এমসিসিও পরিবর্তন ও গণতন্ত্রায়ণের পথে হাঁটা শুরু করেছে বলে মনে হচ্ছে।
আক্ষরিক অর্থেই ‘পৃথিবীর পথে’ ক্রিকেট হেঁটেছে হাজার বছরের পথ। ১৭০০ থেকে ১৮০০ সালের মধ্যে আজকের ক্রিকেট, যাকে আমরা ‘আধুনিক ক্রিকেট’ হিসেবে চিনি, তার শুরুর আগে ব্যাট ও বলের এই খেলা বিবর্তিত হয়েছে হাজার বছর ধরে। ১২ শতক থেকে ১৭ শতক পর্যন্ত ক্রমাগত হয়েছে বড় বড় পরিবর্তন। খেলা হয়েছে নানাভাবে। বিভিন্ন পর্যায় পার হয়ে তা আধুনিক ক্রিকেটের কাছাকাছি কিছু একটাতে দাঁড়িয়েছে। দুই স্ট্যাম্পের উইকেট থেকে তিন স্ট্যাম্প, চার বলের ওভার থেকে পাঁচ বল হয়ে ছয় বলের ওভার—কত কিছু। ‘আধুনিক’ ক্রিকেটের বয়সই ২০০ ছাড়িয়েছে। তবে আধুনিক ক্রিকেটের দুই শতকের এই পথচলা ও অনেক পরিবর্তনের পরও কিছু বিষয় শুধু ক্রিকেটের জন্যই তোলা আছে। ক্রিকেট নিয়ে কিছু ধ্রুপদি বাক্য এখনো সচল, ‘আপনি হারলেন কি জিতলেন এটা বড় কথা নয়, খেলাটা কীভাবে খেললেন সেটাই বড় কথা’ ( It is not whether you win or lose, it is how you play the game) অথবা ‘এটা ক্রিকেট নয়’ (It is not cricket) অথবা ‘আম্পায়ারের কথাই চূড়ান্ত, কোনো প্রশ্ন করা যাবে না’ (The umpire's word is final, not to be questioned)। এই কথাগুলো শুধুই ক্রিকেটের। অসংখ্য ভিন্ন সংস্কৃতি ও একটি সহস্রাব্দের পরিবর্তনের মধ্যেও যে ক্রিকেট টিকে আছে তা কি শুধুই একটি খেলা!
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট পরিষদের (আইসিসি) পূর্ণাঙ্গ সদস্যসংখ্যা এখন ১০। এর বাইরে শীর্ষ সহযোগী সদস্য হিসেবে আছে ছয়টি দেশ, সহযোগী সদস্য ৩৫টি দেশ আর নিবন্ধিত সদস্য হিসেবে আছে ৬০টি দেশ। বলা যায়, কোনো না কোনোভাবে বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশে ক্রিকেট খেলা হয়। ‘অভিজাত’ ক্রিকেটের গণতন্ত্রায়ণ তো কম হয়নি! গণতন্ত্রের সঙ্গে ক্রিকেটের আরও কিছু সম্পর্কও আবিষ্কার করেছেন অনেকে।
মহাদেশ ধরে বিবেচনায় নিলে যে দেশগুলোতে গণতন্ত্র ও মুক্তচিন্তার দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে, সে দেশগুলোতে নাকি ক্রিকেট খেলার চল বেশি। আর অন্যদিকে, বিশেষ করে ইউরোপের বাইরে, চরিত্রের দিক দিয়ে যে দেশগুলোর শাসনব্যবস্থা কর্তৃত্ববাদী, রাজনীতিতে গণতন্ত্রের চর্চার সুযোগ কম, সেখানে ক্রিকেটের চর্চাও নাকি নেই। বিষয়টি কি কাকতালীয়? সেটা হলেও তো ক্রিকেটের সঙ্গে গণতন্ত্রের একটা বড় সম্পর্ক পাওয়া গেল।
মিসর আর তিউনিসিয়া দিয়ে শুরু করেছিলাম। ২৩ বছরেরও বেশি সময় ক্ষমতায় ছিলেন বেন আলী, আর মোবারক ৩০ বছর। আইসিসির সদস্য রাষ্ট্রের তালিকায় আবার চোখ বোলালাম। পূর্ণাঙ্গ সদস্য, শীর্ষ সহযোগী সদস্য, সহযোগী সদস্য, নিবন্ধিত সদস্য—কোনো তালিকাতেই মিসর বা তিউনিসিয়ার নাম পেলাম না। গণতন্ত্র আর ক্রিকেটের সম্পর্কটি তো একেবারে কাকতালীয় মনে হচ্ছে না!
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.