মধ্যপ্রাচ্য-আরব মহাবিদ্রোহ by তারিক আলী

যে লৌহদণ্ড যুগের পর যুগ শাস্তি দিয়েছে, তাকে আর চুমু খেতে নারাজ আরব জনতা। তারা লিখছে ইতিহাসের নতুন এক অধ্যায়। পাশ্চাত্যের নব্য রক্ষণশীলদের আজব দম্ভ ছিল যে আরব ও মুসলমানেরা গণতন্ত্রবিদ্বেষী, তাদের সেই দম্ভ বিদ্রোহের আগুনে পুড়ে গেছে।


যারা এসব বাতিল ধারণা ছড়াত, আজ তারাই সবচেয়ে অসুখী—সেই ইসরায়েল ও ইউরো-আমেরিকায় তার লবিবাজেরা। এরই মধ্যে পশ্চিমা অস্ত্র ব্যবসায়ীরা তড়িঘড়ি করে যতটা পারে অস্ত্র বিক্রি করতে নেমেছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন অস্ত্র ব্যবসায়ীদের একটি দল নিয়ে আবুধাবির অস্ত্রমেলায় হাজির হয়েছেন। তাঁকে আর ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে মৃত্যুর সওদাগর, তিনি গণবিধ্বংসী অস্ত্র (ডব্লিউএমডি) বেচতে নেমেছেন। অথচ এই ডব্লিউএমডির অজুহাতেই ইরাককে ধ্বংস করা হয়েছিল।
অন্যদিকে দিশেহারা সৌদি শাসককুল তটস্থ হয়ে দেখছে, পতনের মহামারি তাদের প্রাসাদেও ঢুকে পড়ে কি না। এখন পর্যন্ত তাদের ওই সব প্রাসাদ দুনিয়ার বহু বিতাড়িত স্বৈরশাসকের অভয়ারণ্য হয়ে আছে। কিন্তু তাদের পালা যখন আসবে, তখন কোথায় পালাবে সৌদি রাজপরিবার? তারা নিশ্চয়ই জানে, তাদের পশ্চিমা অভিভাবকেরা সন্তর্পণে তাদের আস্তাকুঁড়ে ফেলবে এবং বলবে, তারা সব সময়ই গণতন্ত্রপিয়াসী।
ইউরোপের সঙ্গে তুলনায় আরবের বর্তমান বিদ্রোহ ১৮৪৮ সালের ইউরোপীয় পরিস্থিতির সঙ্গে মেলে। সে সময় ব্রিটেন ও স্পেন ছাড়া ইউরোপের সব কটি দেশে বিপ্লবী তরঙ্গ বয়ে গিয়েছিল। এমনকি রানি ভিক্টোরিয়া চার্টিস্টদের সমানাধিকার আন্দোলনে দারুণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। বেলজিয়ামের সিংহাসন হারানো তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে লিখেছিলেন, ‘জানি না, আমরা সবাই আমাদের শয্যায় কতল হয়ে যাব কি না।’ যাঁরা বিদেশি ব্যাংকে জমিয়েছেন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার এবং যেসব মাথায় মুকুট অথবা রত্নখচিত পাগড়ি শোভা পাচ্ছে, তাঁরা সবাই তাঁদের মাথা নিয়েই চিন্তিত।
১৮৪৮ সালের ইউরোপীয়দের মতোই আরবরা আজ বিদেশি আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়ছে (সাম্প্রতিক এক জরিপ জানিয়েছে, ৮২ শতাংশ মিসরীয় আমেরিকাকে অপছন্দ করে), তারা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার দলনের বিরুদ্ধে, অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়া অভিজাতদের বিরুদ্ধে লড়ছে। তারা লড়ছে অর্থনৈতিক ইনসাফের দাবিতে। গত শতকের আরব জাতীয়তাবাদী তরঙ্গের থেকে এটা আলাদা। তখন তারা নেমেছিল আরব থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রেখে যাওয়া খুঁটিগুলো উপড়াতে। নাসেরের নেতৃত্বে মিসরীয়রা সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করলে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইসরায়েল আগ্রাসন চালায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অনুমতি না থাকায় তারা বাধ্য হয় ফিরে আসতে। সেদিন কায়রো ছিল জয়োল্লাসে মাতোয়ারা।
১৯৫৮ সালে ইরাকের ব্রিটিশপন্থী রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে জনগণ, বিপ্লবীরা নেয় সিরিয়ার শাসন, শীর্ষস্থানীয় এক সৌদি রাজপুত্র প্রাসাদ অভ্যুত্থানের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন এবং পালিয়ে মিসরে আশ্রয় নেন। ইয়েমেন ও ওমানে শুরু হয় সশস্ত্র সংগ্রাম। সে সময় তিনটি রাজধানীসমেত এক বৃহৎ আরব রাষ্ট্রের সম্ভাবনা সামনে চলে আসে। এসবেরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় লিবিয়ায় এক অদ্ভুত অভ্যুত্থান ঘটে। এক তরুণ অর্ধশিক্ষিত সেনা কর্মকর্তা মুয়াম্মার গাদ্দাফি সেখানে ক্ষমতায় বসেন। তাঁর সৌদি শত্রুরা তখন বলেছে, ব্রিটিশ গোয়েন্দারা এই অভ্যুত্থানের আসল হোতা, যেমন করে তারা উগান্ডায় বসিয়েছে ইদি আমিনকে (পরিহাস যে এই সৌদি আরবই পতিত ইদি আমিনকে আশ্রয় দিয়েছিল)। গাদ্দাফির ঘোষিত জাতীয়তাবাদ, আধুনিকতা ও বিপ্লবীপনা ছিল তাঁর লেখা ভুতুড়ে বিজ্ঞান-কল্পকাহিনির মতোই এক মস্ত ভাঁওতা।
‘বিপ্লবের’ সুফল তাঁর জনগণ পায়নি। তেলসম্পদে ভরপুর হওয়া সত্ত্বেও তিনি লিবীয়দের শিক্ষার সুযোগ দেননি, দেননি বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসুবিধা অথবা ভর্তুকিপ্রাপ্ত আবাসন। বরং এই টাকা দিয়ে তিনি বিদেশে উদ্ভট সব কাজকারবার চালিয়েছেন। এর অন্যতম হলো, সুদানের বিরোধীদলীয় সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্টদের বহনকারী ব্রিটিশ বিমান ছিনতাই করে তাদের তুলে দেন সে সময়ের সুদানের স্বৈরশাসক গাফার নিমেইরির হাতে। তিনি তাদের সবাইকে ফাঁসিতে চড়ান। এর মাধ্যমে সুদানের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা তিরোহিত হয়, দেশটিতে নেমে আসে বিরাট বিপর্যয়। আজ পর্যন্ত সেই বিপর্যয়ের ধারাবাহিকতা সুদানে চলছে। আর স্বদেশে গাদ্দাফি এক সংকীর্ণ গোত্রপ্রথা টিকিয়ে রেখেছেন। ভেবেছেন, জনগণকে বিভক্ত করে তিনি ক্ষমতা টিকিয়ে রাখবেন। কিন্তু আর নয়।
১৯৬৭ সালের ইসরায়েলের ঝটিকা আক্রমণ আরব জাতীয়তাবাদের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়। সিরিয়া ও ইরাকে সংঘাতের শেষে ওয়াশিংটনের আশীর্বাদ নিয়ে ডানপন্থী বাথপন্থীরা ক্ষমতাসীন হয়। নাসেরের মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরসূরি আনোয়ার সাদাত ১৯৭৩ সালে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এমন বিজয় আনেন, যার দাম পরাজয়ের চেয়েও বেশি। মিসরের সামরিক কর্তারা ক্ষতির ধাক্কা কমাতে আমেরিকার কাছ থেকে বার্ষিক বিলিয়ন ডলার ভর্তুকি পেতে শুরু করেন, বিনিময়ে ইসরায়েলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। পুরস্কার হিসেবে ইউরো-আমেরিকা এই স্বৈরশাসককে রাষ্ট্রনায়কের তকমা পরায়, যেমন পুরস্কার দীর্ঘসময় জুড়ে সাদ্দাম হোসেনও পেয়ে এসেছিলেন। অথচ আমেরিকা সাদ্দামকে তখন রক্ষা না করলে ইরাকি জনগণই সাদ্দাম হোসেনকে অপসারণের সুযোগ পেত। তাহলে ইরাক যুদ্ধে অন্তত ১০ লাখ মানুষ মরত না, এতিম হতো না ৫০ লাখ শিশু।
আরব বিপ্লবের সলতেয় আগুন দিয়েছে অর্থনৈতিক সংকট। জন্ম হয়েছে অভূতপূর্ব গণ-আন্দোলনের। কিন্তু জীবনের সব দিকের পরিবর্তন নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি। তিউনিসিয়ায় যেমন সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অধিকার নিয়ে ভয়ানক সংঘাত হয়েছে, অন্যত্র তেমনটা হয়নি। হয়নি নতুন কোনো রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব। এসব থেকে বোঝা যায়, সামনের নির্বাচনী যুদ্ধে লড়াই হবে মূলত আরব উদারনীতির সঙ্গে আরব রক্ষণশীলতার। মিসরে সেই রক্ষণশীলতারই নাম ইসলামিক ব্রাদারহুড। তারা তুরস্ক ও ইন্দোনেশিয়ার আদলে নিজেদের তৈরি করছে এবং সানন্দে আমেরিকাকে আলিঙ্গন করতে রাজি।
মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন আধিপত্য ধাক্কা খেয়েছে, কিন্তু ধ্বংস হয়নি। স্বৈরতন্ত্র-পরবর্তী শাসনব্যবস্থা আরও স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক হবে এবং এই গণতন্ত্র হবে তাজা ও ভেতর থেকে পরিবর্তনকামী। সম্ভবত নতুন সংবিধানে সামাজিক ও গণতান্ত্রিক চাহিদাগুলো স্বীকৃত হবে। কিন্তু মিসর ও তিউনিসিয়ার সেনাবাহিনী চাইবে মৌলিক পরিবর্তন ঠেকিয়েরাখতে। ইউরো-আমেরিকার সবচেয়ে বড় ভয় বাহরাইন নিয়ে। দেশটির শাসকেরা উচ্ছেদ হওয়া মানে সৌদি আরবে গণতান্ত্রিক জাগরণ আছড়ে পড়া ঠেকানো কঠিন হয়ে যাওয়া। ওয়াশিংটন কি এ ঘটনার অভিঘাত সামাল দিতে পারবে? তারা কি তা ঘটতে দেবে? নাকি তারা ওয়াহাবি বিকারগ্রস্তদের রক্ষায় সেনা পাঠাবে?
গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে ভাষান্তর ফারুক ওয়াসিফ
তারিক আলী: পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ সাংবাদিক ও লেখক।

No comments

Powered by Blogger.