চারদিক-পথস্কুলে একদিন by শারমিন নাহার

সূর্যের তেজ কিছুটা কমে এলেই হাতে বইয়ের ব্যাগ নিয়ে হাজির হয়ে যায় ওরা। প্রতিটি ব্যাগের ওপরে আবার নাম লেখা রয়েছে। আসার পর রাস্তার মধ্যেই মাদুর পেতে বসে পড়ে। নির্ধারিত সময় বেলা তিনটা থাকলেও ক্লাস শুরু হতে আরও ৩০ মিনিটের বেশি লাগে। সাড়ে তিনটা থেকে সমস্বরে ওরা পড়া শুরু করে। ওরা পথশিশু, কেউ বা কর্মজীবী।


মা কিংবা বাবার সঙ্গেই কাজ করে আর ফাঁকে ফাঁকে এখানে চলে পড়াশোনা। মহানগর ঢাকার আজিজ সুপার মার্কেটের পেছনের রাস্তায় জমে উঠেছে এই স্কুল। নেই আলাদা কোনো বেঞ্চ বা কক্ষ। রাস্তার মধ্যে একটা জায়গায় মাদুর পেতে ওদের ক্লাসের জায়গা আলাদা করা হয়েছে। এই জায়গাটুকুকেই মোট চারটি ভাগে ভাগ করে নদীর নামের সঙ্গে মিল রেখে নাম রাখা হয়েছে। নামগুলোও বেশ চমৎ কার—পদ্মা, মেঘনা, যমুনা আর সুরমা। বহতা নদীর মতোই যেন ওরা বয়ে চলে।
এই চার অংশের মধ্যে যমুনা অপেক্ষাকৃত ভালো। আর এই বিভাজন হয়েছে মূলত শিক্ষার্থীর বয়স এবং সে কতটুকু জানে, তার ওপর ভিত্তি করে। হয়তো পদ্মার ক্লাসে শেখানো হচ্ছে বর্ণমালা, অন্যদিকে ইংরেজিতে সাত দিনের নাম শেখানো হচ্ছে যমুনাদের। এভাবেই সব কটি সুর মিলে এক আলাদা ঐকতানের সৃষ্টি করে। এমন কচিকাঁচাদের মেলা দেখে অনেক পথচারী থমকে দাঁড়ায়। কেউ বা আগ্রহভরেই তাকিয়ে দেখতে থাকে। সেদিন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হওয়ার মুহূর্তে এই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় মার্লিন লক্ষ করেন এ দৃশ্য। আগ্রহ পোষণ করেই পড়াতে নেমে যান। মার্লিন জানান, ছোট বাচ্চাদের পড়িয়ে খুব ভালো লেগেছে। ওদের যা শিখিয়েছি, তা-ই ওরা শেখানো ময়না পাখির মতো বলেছে। সবচেয়ে ভালো লেগেছে মানুষকে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা। ওরা আসলেই খুব বেশি অবজ্ঞা ও বঞ্চনার শিকার। একটুখানি ভালোভাবে কথা বললেই ওরা খুশি। মার্লিনের সঙ্গে কথা শেষ হতে না হতেই পড়া ছেড়ে পদ্মা শাখার বুলবুলি উঠে আসে। নিজের নাম বলে জানতে চায় আমার নাম। এটা নাকি নিয়ম। স্কুলের আপা আর ভাইয়ারা নাকি শিখিয়েছেন। নিজের পরিচয় দিয়ে অন্যের সঙ্গে পরিচয় হতে হয়। এরই মধ্যে বুলবুলি কাঁধে হাত রেখেছে, খুলে ফেলেছে আমার চোখের চশমা। এবার আর আটকে রাখা গেল না। সবাই ছুটে এসেছে, ব্যস্ত হয়ে বলছে নিজেদের নাম-ঠিকানা। কেউ হয়তো এরই মধ্যে কোলের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। স্কুল থেকে কী কী শিখিয়েছে, তা একে একে বলতে থাকে। বুলবুলির বোন সুন্দরী পড়ে যমুনা শাখায়। সুন্দরীও হাজির হয়েছে এরই মধ্যে। ওদের সবার পড়াশোনা করতে ভালো লাগে। আর এই স্কুলে এসে তারা খুব বেশি খুশি। স্কুলের পাশেই আজিজ সুপার মার্কেটের একটি দোকানে কাজ করে মোহাম্মদ রাসেল। কেন পড়তে এল রাসেল? রাসেল জানায়, ‘ফড়ালেহা কইরে মানুষ হব, বড় মানুষ।’ রাসেলের চোখ চকচক করছে আর তার চোখের ভাষা বলে দেয়, সে জানে, বিদ্যা অর্জন করলে তা মানুষকে বড় আর মহৎ করে। নিজে কিছু করে—এটা বলতেই বেশ গর্ববোধ করে লিনা। ‘সারা দিন মায়ের সাথে বাটা সিনগেলে (সিগন্যাল) কাম করি। তয়, স্কুলে আইলে মা কিছু কয় না, বাহে মারে না, ভালো কয়।’ এরা সুবিধাবঞ্চিত, আর এদের পাশে এগিয়ে এসেছে কিছু শিক্ষার্থী, যাঁরা নিজেরা পড়াশোনা করছেন এবং পড়াচ্ছেন এই শিশুদের। বেতন বা বইখাতা তাঁরাই জোগান। স্কুলের মূল উদ্যোক্তা মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের সমাজে অনেক শিশু আছে, যারা পেটে খাবার নেই বলে ভিক্ষা চায় আর ওই টাকা দিয়ে নেশার সামগ্রী কেনে। তাই চিন্তা করলাম, এই শিশুদের নিয়ে যদি কোনো স্কুল করা যায়, তবে ওদের নৈতিক শিক্ষা দেওয়া যাবে। কী করা উচিত, কী করা উচিত নয়, যে শিক্ষাটা মূলত পরিবার থেকে পাওয়ার কথা ছিল, সেই শিক্ষার সঙ্গে যদি অক্ষরজ্ঞানের কিছু শিক্ষা দেওয়া যায়, তবে অকালেই এই শিশুরা ঝরে পড়বে না।’ স্কুলের অন্য শিক্ষক এহসানুল হক বলেন, ‘আমরা চাই, এই শিশুরা ভবিষ্যতে যেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে; তবে তা কাগজ কুড়ানো, ফুল বিক্রি বা চায়ের দোকানে কাজ করে নয়।’ সন্ধ্যা হয়ে গেছে, এবার ছুটি। সবাই বলতে শুরু করল, ‘ছুটি গরম গরম রুটি এক কাপ চা সবাই মিলে খা’। তবে গরম রুটির পরিবর্তে চলে এসেছে পুরি আর জিলাপি। ‘পড়া শেষে ভাইয়ারা আমাগে খাওন দেয়।’ এ জন্য খুব খুশি মেঘনা শাখার রাকিব। স্কুল শেষে ওরা ফেরে যে যার কাজে, আর স্বপ্ন দেখে মানুষ হওয়ার। কিছুক্ষণের জন্য থেমে থাকা রাস্তায় আবার গাড়ি চলে।

No comments

Powered by Blogger.