বিশ্বকাপ-খেলা শুধু খেলা নয়, জীবনও by ফারুক ওয়াসিফ

দৃশ্যটি অদ্ভুত। ব্যাট-বল-স্টাম্প নিয়ে ছোকরাদের একটি দল হাঁটছে, সঙ্গে বোঁচকা কাঁধে আরও একজন। তারা খেলতে যাচ্ছে, যেখানে মাঠ যেখানে খেলোয়াড় সেখানেই খেল হবে। পাঁচ-ছয়জনের ছোট দল, আনাড়ি। খেলার জায়গাও ঠিক করা নেই।


স্টাফ কোয়ার্টারের মাঠে হলে ভালো, বারান্দায় বা জানালায় যারা দাঁড়ালে জীবন সার্থক হয়, তাদের সঙ্গে চোখাচোখি করে জীবন সার্থক করার সুযোগ আসবে। বলা বাহুল্য, স্থানীয় বীরপুঙ্গবদের ধাওয়া খাওয়াও বিচিত্র ছিল না। বোঁচকাশোভিত জন কোনো পদেই পড়ে না। সে দলটির বাঁধা সমর্থক, কিন্তু খেলা দেখে না। খেলা শুরু হতেই সে মাঠের পাশে বসে বোঁচকাটা খোলে। মোটা কোনো উপন্যাস বের হয়। ওদিকে খেলা আর এদিকে পড়া একতালে চলতে থাকে। দুপুরের বাতাস শোঁ শোঁ করে বয়, খেলোয়াড়দের ক্যাপ উড়ে যায়, বইয়ের পাতা ফড়ফড় করে পাখা মেলতে চায়। পাঠিকারা ঘরে, খেলুড়েরা মাঠে। আমি বেচারা কেবল ঘর-বাহির করি।
জগতে খেলোয়াড় কম, দেখনদারই বেশি। তাই জগতের সব ক্রীড়া দর্শকই আমার বন্ধু। তারা খেলা দেখে, আমি তাদের দেখি। দলবদ্ধ মানুষের উদ্যম দেখি, নায়ক-মহানায়কদের ট্র্যাজেডি-কমেডি-হাড্ডাহাড্ডি সবই দেখি। খেলা বুঝি না, কিন্তু তার সৌন্দর্য আর শক্তির প্রকাশ দেখে মুগ্ধ হই। যে মানুষটা মুখপোড়া, প্রিয় দলের জয়ে তার মুখে সূর্যের হাসি দেখি। যে ব্যাটা মনমরা ভীতুর ডিম, তার লম্ফঝম্ফ দেখি। খেলোয়াড়দের থেকেও বেশি খেলে দর্শকের মন। তারা না থাকলে ক্রিকেট বা ফুটবল আসর গরম করত না, আমরা মুড়িমাখা-সহযোগে লুডু খেলেই দিন গুজরান করতাম।
খেলা এখন দেখা আর দেখানোর জিনিস। তবে দর্শক মজে কোন মজায়? বড়রা খেলে সাড়ম্বরে, কিছুটা লুকিয়ে-ছাপিয়ে। শিশুরা খেলে প্রকাশ্যে মাঠে, সবাই মিলে। খেলার মাধ্যমেই তারা নিজেদের জাহির করে। বড়রা খেলে জয়ের নেশায়, খেলার আনন্দে খেলে কেবল শিশুরাই। বড়রা খেলে অন্যের জন্য, দর্শকের জন্য, স্পন্সর কোম্পানির জন্য, দেশের জন্য, জাতির জন্য। খেলা এখন দর্শকের আনন্দ, কোম্পানির মুনাফা, দেশের মর্যাদা আর জাতির গৌরবের রসদ। ভক্তদের কাছে খেলা ধর্ম, কোম্পানির কাছে তা ব্যবসার সুযোগ, সরকারের কাছে তা ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার উপায়। জাতীয়তাবাদ আর কোথাও না থাকলেও খেলার মাঠে তারই জয়জয়কার। এত কিছুর মাখামাখিতে খেলা আর খেলা থাকে না, খেলা এখন অনেক সিরিয়াস বিষয়। ক্রিকেট আর পরমাণু বোমা পাকিস্তানের আত্মবিশ্বাস। হিন্দি ছবি আর ক্রিকেট ভারতীয়দের আত্মপরিচয়। একেকটি বিশ্বকাপের আয়ে আমাদের মতো দেশের এক বছরের বাজেট হয়। ভারত বা পাকিস্তানকে সমর্থনকারী বাংলাদেশির দেশপ্রেম নিয়ে সন্দেহ ওঠে।
ঈশ্বর বিশ্বাস এবং খেলা নিয়ে বুদ্ধিজীবীরা সাধারণত সন্দিহান থাকেন। ম্যারাডোনা বা টেন্ডুলকারের মধ্যে বুদ্ধিজীবী দেখেন প্রশিক্ষণ আর প্রতিভা। কিন্তু ভক্তের চোখে তাঁরা দেবতা। আর্জেন্টিনায় ম্যারাডোনার নামে একটি গির্জা হয়েছে। সেই গির্জার অনুসারীদের চোখে তিনি দেবতা, ম্যারাডোনার আত্মজীবনী তাঁদের বাইবেল, সব ম্যারাডোনাভক্ত তাঁদের সহধর্মী, তাঁদের গির্জার নাম ‘হ্যান্ড অব গড’। ম্যারাডোনার হাত দিয়ে গোল করার ঘটনায় তাঁরা বিব্রত নন। তাঁদের বিশ্বাস হাতটি স্বয়ং ঈশ্বরের।
ভারতেও টেন্ডুলকার মার্গ গড়ে উঠেছে। ১৯৯৮ সালে শারজায় অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টেন্ডুলকারের ১৪৩ রানের ইনিংসকে অনেকেই ‘অলৌকিক’ মনে করেন। এমনকি শচীন ব্যাট করতে নামার আগে মাঠে হঠাৎ আছড়ে পড়া বালুঝড় যেন সেই ‘অলৌকিক’ ব্যাটিং-ঝড়েরই ইশারা। ভক্তরা এই স্মৃতি সারা জীবন বয়ে বেড়াবেন, এর স্মৃতিতর্পণ করে স্বর্গীয় পুলক পাবেন। এভাবেই ম্যারাডোনা বা শচীনরা হয়ে ওঠেন দেবতা। ভারতে শিশুদের পাঠ্যপুস্তকে শচীনের জীবন নীতিশিক্ষার অংশ হয়েছে।
লাতিন আমেরিকার জনপ্রিয় লেখক এদুয়ার্দো গ্যালিয়ানো ফুটবল নিয়ে কালজয়ী একটি বই লিখেছেন। এক মেক্সিকান ব্যবসায়ীকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হবে। গুলি করার ঠিক আগে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ভদ্রলোক আততায়ীদের গ্যালিয়ানোর লেখা একটি ফুটবল ম্যাচের গল্প বলা শুরু করেন। গল্পটা তাদের দারুণ মুগ্ধ করে এবং লোকটিকে তারা ছেড়ে দেয়। আরব্য রজনীর গল্পে শেহেরজাদি এক হাজার একটি গল্প বলে নিজের জীবন বাঁচিয়েছিল, আর এক ফুটবলভক্তের জীবন বাঁচায় ফুটবলেরই একটি গল্প। অলৌকিকই বটে!
আদিতে খেলা ধর্মেরই অঙ্গ ছিল। প্রাচীন গ্রিসে ধর্মাচরণের অংশ হিসেবেই অলিম্পিক শুরু হয়েছিল। এখন খেলা সংস্কৃতির অংশ। সেই সংস্কৃতিটা টেলিভিশন আর খবরের কাগজের কল্যাণে ধর্মীয় চেহারা পাচ্ছে। খ্যাতনামা ক্রীড়ামনস্তত্ত্ববিদ ড্যানিয়েল ওয়ান বলছেন, ‘খেলার ভক্তমার্গ আর আনুষ্ঠানিক ধর্মের মধ্যে ব্যাপক মিল। উভয়ই একই জাতীয় কিছু ধারণায় বিশ্বাসী। যেমন—বিশ্বাস, উৎ সর্গ, বন্দনা, প্রথা, আত্মত্যাগ, দায়বদ্ধতা, স্পিরিট, প্রার্থনা, সংগ্রাম, উৎ সব ও অভিষেক’। খেলা তাদের বিশ্বাস, নৈতিকতা আর জীবনযাপনের অংশ। যাদের ঘিরে এত সব, তারা ‘দেবতা’, আর দেবতাদের কর্মই তো ধর্ম।
অনেকেই খেলাকে মানবতাবাদী ধর্ম হিসেবে দেখছেন। ভক্তরা কোনো মানবের লোকাতীত গুণাবলির ভক্তি করে, তার নামে স্লোগান দেয় এবং তাকে বন্দনা করে। ধর্মানুষ্ঠানের মতোই তারাও কিছু প্রথা পালন করে। খেলার সময় বিশেষ রকমের পোশাক পরে, গায়ে-মুখে রং মাখে, প্রিয় দলের জন্য প্রার্থনা করে এবং ধর্মীয় গীতের মতো বন্দনাগীত গায়। পুরাকালে সাধুরা এমন বন্দনা পেতেন, আগে পেতেন জাতীয় নেতারা, এখন খেলোয়াড়েরাই বীরপূজার লক্ষ্য।
আমেরিকার জাতীয় ফুটবল প্রতিযোগিতা সুপারবৌলকে মার্কিন লোকধর্মের উৎ সব বলা হয়। টেলিভিশনের ক্লোজআপ, স্লো মোশন, রিপ্লে ইত্যাদি টেকনিকের সাহায্যে খেলা খেলোয়াড়দের অতিমানব করে তোলা হয়, দর্শকের মনে গেঁথে দেওয়া হয় ভক্তি-জাগানিয়া ছবি। খবরের কাগজের খেলার পাতার লেখা ও ছবি বিশেষ মর্যাদা পায়। বাংলাদেশের উৎ পল শুভ্রের ক্রীড়াবিশ্লেষণ খোদ খেলার মতোই জনপ্রিয়। প্রতিদিন সকালে খেলার পাতা না পড়লে অতৃপ্তিতে ভোগেন অনেকে। খেলোয়াড়দের ব্যবহূত ব্যাট-বল-স্টাম্প-বুট-জার্সি বা অটোগ্রাফ তাদের কাছে পবিত্র স্মারক। খেলা দেখে এবং খেলোয়াড়দের সংস্পর্শে ভক্তরা আধ্যাত্মিক আনন্দ লাভ করে। খেলা তাদের ‘বাস্তবতা’ ভুলে থাকতে সাহায্য করে, ঠিক যেমনটা করে ধর্ম। তাদের মন তখন ‘স্বর্গীয়’ জগতের অংশ হয়ে যায়, তারা আর বাস্তবে থাকে না। ভক্তরা পরস্পরের সঙ্গে আত্মিক বন্ধন অনুভব করে। জাদুঘরে বা সংগ্রহশালায় সেরা খেলোয়াড়দের মূর্তি বানিয়ে রাখা হয়, তাঁদের অবিস্মরণীয় কৃতিত্বের স্মারকগুলো প্রদর্শন করা হয়, যেমনটা করা হয় সাধুপুরুষদের স্মৃতির বেলায়ও। খেলাও ধর্মের মতো সীমা মানে না, অল্প সময়ের জন্য হলেও ধনী-গরিব, সাদা-কালো সবাই ভাবে, তারা সবাই এক ও অভিন্ন।
এবং বেশির ভাগ খেলাই পুরুষালি। শৌর্য-বীর্যের যেসব বিশেষণে খেলোয়াড়দের অভিষিক্ত করা হয়, তা-ও পুরুষালি। প্রতিযোগিতাকে দেখা হয় যুদ্ধ হিসেবে, দুটি দলের মধ্যে যতটা না শত্রুতা, তার থেকে বেশি শত্রুতা দেখা যায় দুই দলের ভক্তদের মধ্যে। ঢোল, শিঙা ইত্যাদি নিয়ে ভক্তদের মহড়াকে যুদ্ধের মহড়া বলেই মনে হয়। এবং বসুধা বীরভোগ্যা। সোনার কাপটা যেন সেই নারীর প্রতীক, পুরাকালে বিজয়ীরা পরাজিতের হাত থেকে যা ছিনিয়ে নিত। পরাজয়কে ভাবা হয় মেয়েলি গুণাবলি হিসেবে। একবার ওয়াসিম আকরামের নিন্দা হয়েছিল এ জন্য যে তিনি কানে রিং পরেছিলেন এবং সে জন্যই নাকি একটি ম্যাচে হেরে গিয়েছিলেন। শোয়েব মালিক গত বছর ভারতের টেনিস তারকা সানিয়া মির্জাকে বিয়ে করলে পাকিস্তানে আনন্দ আর ভারতে নিন্দার রব ওঠে। নারীকে এখনো তারা জয় বা পুরস্কারের বিষয় মনে করে।
সবই সত্য, কিন্তু তার পরও খেলা দেখব। ধর্মীয়ই হোক, আর সাংস্কৃতিকই হোক, এই প্রতীকী যুদ্ধ এই গণ-উল্লাস আর দেশের জয় দেখার দুর্বিনীত বাসনার কাছে কোনো কিছুই বড় নয়। বাংলাদেশের ছেলেরা একটি ছক্কা মারলে বা ভেঙে দিতে পারলে প্রতিপক্ষের স্টাম্প, দেশ-বিদেশের কোটি কোটি বাংলাদেশির মনে যে আনন্দতরঙ্গ বয়ে যাবে, সেই তরঙ্গে পুঁতির মতো গাঁথা পড়ার সুখ নেব। নিজেকে ছাপিয়ে বড় কিছুর মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার এই সুযোগ কে ছাড়ে? আমাদের লৌকিক জীবনে, হতাশাভরা প্রতিটি দিনের মধ্যে, যার যার ব্যক্তিগত অশান্তির ছায়ার মধ্যে থেকে আমরা তখন উঠে দাঁড়াব, জাতি হয়ে উঠব, দেশপ্রেমের আবেগে ভাসব, বাংলাদেশ দলের সব সমর্থককে মনে করব আত্মার আত্মীয়। বাস্তবে দুর্বল হয়ে যাওয়া জাতীয় সহমর্মিতা ক্রিকেটের হাওয়ায় সবল হলে হোক না। তবে আমি এখনো সেই বোঁচকাবাহী যুবকটি আছি, যে এখনো খেলার থেকে বেশি ভালোবাসে খেলার ছলে প্রকাশিত যৌথতা, আবেগ আর উদ্যম। আশার সমাধিক্ষেত্র এই বাংলাদেশে ক্রিকেট যদি আশাবাদী হতে শেখায়, চ্যালেঞ্জ জানানোর তাকদ দেখায়, জয়ী হওয়ার জন্য উদ্যমী করে, তাহলে বলব, ‘ক্রিকেট জিন্দাবাদ’। রাজনীতির হাতে যে মর্যাদা আমরা হারাচ্ছি, খেলার মাঠে তা উদ্ধারের মহড়া দিক আমাদের ছেলেরা। গৌরবের প্রাণভোমরা যদি ক্রিকেটের কৌটা থেকে উদ্ধার হয়, বিশ্বের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হিসেবে বাংলাদেশিরা যদি এর মাধ্যমে মর্যাদা অনুভব করে, তবে সেটা হবে বৈশ্বিক উচ্চবর্গের বিরুদ্ধে নিম্নবর্গেরই বিজয়। এই একটি ক্ষেত্র, যেখানে দল জিতলে দেশবাসী জিতবে। তাই খেলা আমাদের কাছে কেবল খেলা নয়, আরও বেশি কিছু।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.