চারদিক-মায়ানদী পার হবি কেমনে... by সাহাদাত পারভেজ

রহমতখালী নদীর ঘাটে ভিড়ে আছে সারি সারি বেদেনৌকা। একটি সাদা বক সকালবেলায় আহারের জন্য মাছ খুঁজছিল নদীর কিনারায়। বকটিকে ধরার জন্য পিছু ছুটল এক বেদেশিশু। টের পেয়ে ডানা মেলে উড়াল দিল বকটি। বেদেশিশুটি আক্ষেপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। এমন একটি ছবি ধারণ করছিলাম আমার ক্যামেরায়।


হঠাৎ কোথা থেকে কানে এল একটি গান, ‘বগায় যেমন মাছ খাইতে যায়, বসে নদীর কিনারায়, বেদেরা পাখি ধরতে যায়, বসে গাছতলায়, নলের আগায় নল বসাইয়া এক দৃষ্টিতে চায়। মানুষ ধরলে মানুষ পাবি, চিনব মানুষ সন্ধানে সে, মানুষ যেখানে...। ভজ মাইনষের চরণেগো, ভিকাও মাইনষের চরণে, মানুষ যেখানে...।’
নদীর তীর ধরে পূর্ব দিকে এসে দেখি, এক বয়াতি হাতে দোতরা নিয়ে মাদুর বিছিয়ে একটি গাছের নিচে বসে গান গাইছেন। আর লোকজন জড়ো হয়ে শুনছে তাঁর গান। লক্ষ্মীপুর জেলা শহর থেকে নয় কিলোমিটার দূরে মজু চৌধুরীর হাট। রহমতখালী নদী আর মেঘনা একসঙ্গে এখানে এসে মিশেছে। রহমতখালী মেঘনার শাখা নদী। নদীর পাড়ে বিশাল বিশাল গাছ। আর এই গাছের নিচে বসেই গানে মত্ত হানিফ বয়াতি। ৭৭ বছর বয়সী হানিফ বয়াতির মাথার চুল পেকে গেছে। রং দিয়ে চুল কালো করে রাখেন সব সময়। তিনি বলেন, ‘ভেতরে ভেতরে অনেক বয়স হইয়া গেছে। শরীরের জোর কমছে। তয় আমার তো লাগে না।’ এতটুকু বলেই গান জুড়ে দিলেন—‘আমার চুল পাকিল, যৌবন গেল, মন তো আমার বুড়া হয় না। আমারে যে বুড়া বলে, আমি তারে কই শয়তান, আমার মনে লাগে যেমন ছোট্ট একটা পোলাপান।’
হানিফ বয়াতি নিজের লেখা গান ছাড়াও পাগল বাচ্চু, দেওয়ান রজ্জব, বাউল গান, দেহতত্ত্ব, ভাব-বিচ্ছেদ, আঞ্চলিক গান, গুরু-ভজন, নবীতত্ত্বের গান গেয়ে থাকেন। বাজাতে পারেন দোতারা, বেহালা, হারমোনিয়াম, ঢোল, তবলা, বেঞ্জু, বাঁশি, পাতাবাঁশি ও মোড়লিবাঁশি। কেউ শুনতে চাইলে এসে বসেন গাছের নিচে। ভেতরে তাঁর অনেক গান। শুধু শোনার কান দরকার। তাঁর ভাষায়, ‘শিখতে পারি নাই কিছুই।’ তিনি আরও বলেন, ‘মনের মধ্যে একটা দেয়াল আছে। দেয়াল মানেই পাগল। পাগল হানিফ খোদ জঙ্গলে পইড়া আছি।’ সেটা কোথায় জানতে চাইলে বয়াতি বলেন, ‘যেখানে বইসা আছেন, সেখানটায়। আর দেহের মধ্যে তিন মহাজন হচ্ছে হু হা হে।’
ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি ঝোঁক ছিল তাঁর। আশপাশের গ্রামে গানের আয়োজন হলে তিনি চলে যেতেন। শিল্পীদের সঙ্গে সুর মেলাতেন। নির্ঘুম রাত কাটিয়ে ফোলা চোখ নিয়ে ঘরে ফিরতেন শেষ রাতে। একদিন গানের টানে চলে গেলেন চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে। সেখানেই কিতাব আলী বয়াতির সঙ্গে পরিচয়। গানের হাতেখড়িও তাঁর কাছে।
হানিফ বয়াতির গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার শাকচর গ্রামে। দুই স্ত্রী, তিন ছেলে, এক মেয়ে রয়েছে তাঁর। দ্বিতীয় স্ত্রী রেহানা আক্তার তাঁর গানের সঙ্গী, সুরের সঙ্গী। আর ঘর সামলান প্রথম স্ত্রী রুপালি বিবি। ছেলেদের উপার্জনে কোনো রকমে চলে তাঁর সংসার। বয়াতির দ্বিতীয় স্ত্রীর গলায় টিউমার হয়েছে। চিকিৎসার অভাবে তা দিনে দিনে বড় হচ্ছে। অস্ত্রোপচারের জন্য ৫০ হাজার টাকা দরকার। কিন্তু এই টাকা কোথায় পাবেন হানিফ বয়াতি?
যখন ফিরছি, তখন মাথার ওপর খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সূর্য। রহমতখালী ও মেঘনা নদীর মিলন মোহনায় তখন হানিফ বয়াতির কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে—মায়ানদী পার হবি কেমনে, ভাবি মনে, মায়ানদী পার হবি কেমনে...মায়ানদীর ঊর্ধ্বধার, মাসে তিন দিন হয় জোয়ার, ওগো তিন মহাজন আছে তিন সন্ধানে...।

No comments

Powered by Blogger.