অরণ্যে রোদন-ভয় পেয়ো না, আমরা আছি কোটি কণ্ঠ নিয়ে... by আনিসুল হক

ধানমন্ডি এলাকায় থাকি। মাঝেমধ্যেই এ-বাড়িতে ও-বাড়িতে গায়েহলুদের অনুষ্ঠান হয় আর অনেক রাত অবধি উচ্চ স্বরে গান বাজে। সেসব গানের বেশির ভাগই হয় হিন্দি, নয়তো ইংরেজি। এই ফেব্রুয়ারি মাসেও পড়শির অনুষ্ঠান থেকে আসা হিন্দি আর ইংরেজি গানের কানফাটা আওয়াজে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটেছে। ২০ ফেব্রুয়ারি রাত।


মিরপুরে একটা বড় ফ্ল্যাট-চত্বরে ঢুকছি। ও-বাড়ি থেকে হিন্দি সিরিয়ালের আওয়াজ আসছে, ও-ঘর থেকে আসছে—‘মোর পিয়া ঘর আয়ি ও রামজি’। আর দূরে, কোথাও কী একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে, হয়তো গায়েহলুদ বা মুখেভাত; গান বাজছে—‘শিলা শিলা শিলা কি জোয়ানি’। মনটা একটু দমে গেল। আমাদের কৈশোরে ফেব্রুয়ারি মাসে, বিশেষ করে ২০ ফেব্রুয়ারির রাতে, কোথাও কোনো ‘পার্টি’ থেকে হিন্দি গান ভেসে আসবে, এটা অকল্পনীয় ছিল। এর পেছনে যে আছে বাংলাদেশে ভিসিআরের মাধ্যমে হিন্দি ছবি এবং পরে টেলিভিশনের মাধ্যমে হিন্দি অনুষ্ঠান ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা, শুধু তা-ই নয়, আছে একটা বড় অর্থনৈতিক শক্তির প্রতিবেশী হিসেবে বসত করার বাস্তবতাও। ইদানীং অনেকগুলো টিভি চ্যানেলে হিন্দিতে নির্মাণ করে বা ডাব করে শিশুদের কার্টুন ছবি দেখানো হচ্ছে; সেসব বাংলাদেশে প্রবল জনপ্রিয়ও হচ্ছে এবং বাংলাদেশের ঘরে ঘরে শিশুরা হিন্দিতে দক্ষ হয়ে উঠছে। বোধ হয় আমার আনন্দিত হওয়া উচিত। কারণ, একাধিক ভাষা জানা সব সময়ই ভালো। কিন্তু কেন জানি না, আমি আনন্দিত হতে পারছি না।
আজ যেকোনো থানা শহরেও ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল গড়ে উঠেছে এবং সম্পন্ন মধ্যবিত্তের শিশুরা ওই সব স্কুলেই যাচ্ছে। ঢাকা শহরে বহু ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে পড়ছে। এদের বলেই দেওয়া হয়, এরা যেন স্কুলে এবং বাড়িতেও সব সময় ইংরেজিতেই কথা বলে। গতকাল একুশে ফেব্রুয়ারিতে ধানমন্ডিতে প্রথম আলো আয়োজিত বর্ণমেলায় গিয়েছি। বাচ্চারা আসছে, ‘ক্যান আই হ্যাভ এ ফটোগ্রাফ উইথ ইউ’। ‘ক্যান আই হ্যাভ ইউর অটোগ্রাফ, প্লিজ’। মা বলছেন, ‘এই এই, আজ একুশে ফেব্রুয়ারি। আজ বাংলায় বলো।’ বলেই মা জিভ কাটছেন, শুধু আজ নয়, প্রতিদিনই বাংলা বলতে হবে।
আমরা বড় হয়েছি প্রবল বাঙালি জাতীয়তাবাদী জোয়ারের কালে। ইংরেজিটা ভালো করে শিখিনি। সে কারণে নিজেকে কেমন যেন হাত-পা বাঁধা লাগে। চারদিকে তাকিয়ে মনে হয়, জ্ঞান মানে হচ্ছে ইংরেজিতে চৌকস হওয়ার দক্ষতা। ফলে আমাদের বাচ্চারা ইংরেজিটা ভালো জানুক, এটা আমরা খুব চাই। কিন্তু এরা বাংলাটা ভালো করে জানবে তো! এরা রবীন্দ্রনাথ বাংলায় পড়বে, নাকি গীতাঞ্জলির বদলে সং অব অফারিংস পড়ে এদের রবীন্দ্ররস আস্বাদন করতে হবে!
বাংলা কি আজ হুমকির মুখে পড়েছে? বিশ্বায়ন একটা বাস্তব সত্য। মুক্তবাজার বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো ঢুকে পড়েছে আমাদের দেশেও। আমরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি চাই। বাঙালিরা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। আমি চাই, আরও আরও বাঙালি বিদেশে যাক। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়—
পুণ্যে পাপে দুঃখে সুখে পতনে উত্থানে/
মানুষ হইতে দাও তোমার সন্তানে/
হে স্নেহার্ত বঙ্গভূমি—তব গৃহ ক্রোড়ে/
চিরশিশু করে আর রাখিয়ো না ধরে।/
দেশদেশান্তর-মাঝে যার যেথা স্থান/
খুঁজিয়া লইতে দাও করিয়া সন্ধান।
আরেকটা বাস্তবতা হলো তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় বিকাশ। চার কোটি লোকের হাতে মোবাইল ফোন। বাসায় বাসায় ইন্টারনেট। স্যাটেলাইট টেলিভিশন। নতুন প্রযুক্তি, নতুন জ্ঞান। ইন্টারনেটের বাংলা কী করব? অন্তর্জাল? সেটা কবিতায় চলতে পারে, কিন্তু বাস্তবে? ফেসবুক থেকে ছবি ‘ডাউনলোড’ নাও, এর বাংলা কি সম্ভব? কিবোর্ডে কন্ট্রোল অপশন ‘গ্রেটার দ্যান’ চাপ দাও, এই কথার বাংলা কী হবে? হবে না। এই সব নিয়ে দুশ্চিন্তা করবারও বেশি দরকার নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ল্যাবরেটরি’ গল্প শুরু হচ্ছে, ‘নন্দনকিশোর ছিলেন লন্ডন য়ুনিভার্সিটি থেকে পাস করা এঞ্জিনিয়ার। যাকে সাধু ভাষায় বলে দেদীপ্যমান ছাত্র, অর্থাৎ ব্রিলিয়ান্ট, তিনি ছিলেন তাই। স্কুল থেকে আরম্ভ করে শেষ পর্যন্ত পরীক্ষার তোরণে তোরণে তিনি ছিলেন পয়লা শ্রেণীর সওয়ারি।’ আমরা এখন জানি, ‘য়ুনিভার্সিটি’র বদলে বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুলের বদলে বিদ্যালয়, ‘এঞ্জিনিয়ার’-এর বদলে প্রকৌশলী শব্দ এরই মধ্যে বাংলাদেশে চালু হয়ে গেছে। ‘ব্রিলিয়ান্ট’-এর বাংলা ‘মেধাবী’ দিয়ে আমরা চালিয়ে নিতে পারব। যে সমাজে যা থাকে না, সে শব্দও সে সমাজে থাকবে না। ‘স্যুপ’-এর বাংলা ‘ডাল’ও নয়, ‘ঝোল’ও নয়, ওটা স্যুপই।
একদিন আমাকে, এই অভাজনকে একটা এফএম বেতারকেন্দ্রে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমাকে ঘণ্টা তিনেক আরজে-গিরি করতে হবে। আমি প্রথমেই ‘আরজে’র বাংলা করলাম ‘বেতারবন্ধু’। ‘মোবাইল ফোন’-এর বাংলা নির্মলেন্দু গুণ করেই রেখেছেন— মুঠোফোন। এসএমএসের বাংলাটা আমি করলাম ‘খুদে বার্তা’। সে আজ থেকে বছর দুয়েক আগেকার কথা। এফএম রেডিও সবে চালু হয়েছে, আর প্রবলভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আমি ঠিক করেছিলাম, আমার এই রংপুরিয়া জিভে যতটা আসে, যত কষ্টই হোক, আমি প্রমিত বাংলা বলব, ইংরেজি এড়িয়ে যাব। ওই আড়াই ঘণ্টায় আমরা অনেক খুদে বার্তা পেয়েছিলাম, শ্রোতারা বলেছিলেন, তাদের কানে আরাম লাগছে। তারা বলছেন, বাংলা-ইংরেজি না মিশিয়ে বললেও অনুষ্ঠান জনপ্রিয় করা যায়। পরে, আমরা যখন একটা এফএম রেডিওর নীতিনির্ধারণী পরামর্শ সভায় যোগ দেওয়ার সুযোগ পাই, এটাকেই নীতি হিসেবে গ্রহণ করার পক্ষে জোর দেওয়া হয়েছিল যে, বাংলা বলতে হবে বাংলার সুরে, বাংলার সঙ্গে ইংরেজি না মিশিয়ে, যতটা সম্ভব মান কথ্যভাষায়। ওই বেতারকেন্দ্রটি যথেষ্টই জনপ্রিয় হয়েছে।
বিশ্বায়ন, অভিবাসন, প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার, মুক্তবাজার ইত্যাদি কারণে আমাদের বাংলা ভাষার প্রতিপক্ষ হয়ে উঠছে ইংরেজি আর হিন্দি। বাংলাদেশে বিজ্ঞাপনী সংস্থায় অ-বাংলাভাষীরা কাজ করেন, তাঁরা না বোঝেন বাংলাদেশের ভাষা, না বোঝেন বাংলাদেশের সংস্কৃতি। তাই আমাদের বিজ্ঞাপনী স্লোগানে ‘হাঙ্গামা’ বা ‘ধামাকা’ ঢুকে পড়ে। ‘মন্ত্র’র মতো সুন্দর বাংলা শব্দ এখন হয়ে যাচ্ছে ‘মান্ত্রা’, আর ‘যোগ’ না বলে আমরা বলছি ‘ইয়োগা’। কলকাতার জন্য সমস্যাটা খুবই বাস্তব। ওরা সর্বভারতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় নিজেদের সমকক্ষ করে তোলার জন্য হিন্দি আর ইংরেজি শিখছে কষ্ট করে হলেও। বাংলাদেশের জন্য সমস্যাটা এখনো প্রকট নয়, কিন্তু শাহরুখ খানদের নৃত্যের সঙ্গে হাজার হাজার বাংলাদেশি তরুণকে নেচে উঠতে দেখলে বুকটা একটু কেঁপেই ওঠে বৈকি। হলিউড যেমন সমস্ত পৃথিবীকে একই সংস্কৃতির রঙে রাঙিয়ে দিতে উদ্যত, বলিউডও তেমনি আমাদের জন্য এক প্রবল বাস্তবতার ঝড়।
এই সব দুশ্চিন্তা নিয়ে প্রথম আলোর বর্ণমেলায় গিয়েই শুনতে পাই বুলবুল ইসলামের কণ্ঠে অতুলপ্রসাদের গান:
মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা।
তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালবাসা।
কি যাদু বাংলা গানে! গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে।
গেয়ে গান নাচে বাউল, গান গেয়ে ধান কাটে চাষা।
মনের মধ্যে কোথাও একটা সান্ত্বনা যেন পাচ্ছি। তখনই মনে পড়ল জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের উক্তি, ‘বাংলা ভাষাটা বাঁচাইয়া রাখছে চাষাভুষা, মুটেমজুর—এরা কথা কয় দেইখ্যাই ত কবি কবিতা লিখতে পারে। সংস্কৃত কিংবা ল্যাটিন ভাষায় কেউ কথা কয় না, হের লাইগ্যা অখন সংস্কৃত কিংবা ল্যাটিন ভাষায় সাহিত্য লেখা অয় না।’—জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক (যদ্যপি আমার গুরু, আহমদ ছফা)
আসলে বাংলা ভাষাটা যে অপরাজেয়, এটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করার যে কারণ নেই তার মূলে কিন্তু তারাই, যারা দাঁড় টানতে টানতে গান গায়, নেচে বেড়ায় বাউলবেশে, ধান কাটে—বাংলাদেশের সাধারণ শ্রমজীবী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। তাদের মুখে বাংলা বেঁচে আছে, বেঁচে থাকবে, তাই কবি কবিতা লিখতে পারবেন। বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ কিন্তু ইংরেজি মাধ্যমে পড়া কয়েক হাজার ছেলেমেয়ে নয়, বাংলা মাধ্যমে পড়া চার কোটি ছেলেমেয়ে। এরাই বইমেলায় ভিড় করে বাংলা বই কেনে। এদের বেশির ভাগই আমার মতো—শুদ্ধ উচ্চারণে বাংলা বলতে পারে না, কিন্তু এরা কেবল বাংলাই বলে; এরা হয়তো সাকিব আল হাসান কিংবা মাশরাফি বিন মুর্তজার মতো—সংবাদ সম্মেলনে বা টেলিভিশনের আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রমিত বাংলায় কথা বলে না, কিন্তু বিশ্বকাপের সংবাদ সম্মেলনে এরা বাংলাতেই কথা বলে, বাংলাতেই সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তর দেয়; এবং এরা আমাদের মতো কেবল দিনগুলো ঘরের মধ্যে বৃথা কাজে কাটিয়ে জনমটাকে বৃথা কাজে অপচয়িত হতে দিচ্ছে না—এরা ছক্কা মারছে, নিউজিল্যান্ডকে ধবলধোলাই করছে, এরা এভারেস্টে উঠছে, এরা নতুন নতুন ব্যবসা-শিল্প-প্রযুক্তিগত উদ্যোগের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিচ্ছে।
বর্ণমেলায় গান ধরলেন অদিতি মহসিন। রবীন্দ্রসংগীত। ‘তোর আপন জনে ছাড়বে তোরে,/ তা ব’লে ভাবনা করা চলবে না।/ ও তোর আশালতা পড়বে ছিঁড়ে,/ হয়তো রে ফল ফলবে না।’ আবার ভরসা পেলাম।
আবার স্মরণ করলাম গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের নোবেল বক্তৃতা। ‘মানুষের মৃত্যু নেই, এ জন্য নয় যে তার ভাষা আছে। মানুষের মৃত্যু নেই, তার কারণ তার আত্মা আছে।’ বাঙালিরও মৃত্যু নেই। তার কারণ এই নয় যে তার ভাষা আছে, তার কারণ তার আত্মা আছে। তার আত্মাটা আছে তার হাজার বছরের ঋদ্ধ সংস্কৃতিতে। তার আত্মা আছে কোটি কোটি চাষা-শ্রমিকের রোজকার বুলিতে। সেই আত্মার প্রমাণ পাই একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে, যখন রাতের আঁধার ভেদ করে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গান গাইতে গাইতে হাজার হাজার মানুষ শহীদ মিনারের দিকে ফুল হাতে হাঁটতে থাকে। সারা দেশে গড়ে ওঠে অসংখ্য অস্থায়ী শহীদ মিনার। বইমেলায়, শহীদ মিনারে, বর্ণমেলায় এত মানুষ! মানুষই এই দেশের প্রধান সম্পদ। মানুষই এই দেশের প্রধান ভরসা। কয়েকজন জাত্যভিমানী পণ্ডিত ‘ভাষা শেষ হয়ে গেল’ বলে যতই ডেথ সার্টিফিকেটে সই করুন, মানুষই বাঁচিয়ে রাখবে এই বাংলা ভাষাকে, এই বাংলাদেশকে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.