যুক্তি তর্ক গল্প-আত্মীয় সমাজ থেকে নাগরিক সমাজ কবে হবে? by আবুল মোমেন

বিএনপির নেতা ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাটির প্রেক্ষাপটেই এই লেখা। ইলিয়াস আলী যদিও বিএনপির কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদের অধিকারী ছিলেন, তবু তাঁর রাজনৈতিক ভূমিকা ও কাজকর্ম মূলত ছিল সিলেটকেন্দ্রিক। আবার যদিও তিনি দীর্ঘদিন বিএনপির রাজনীতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নেতা প্রয়াত সাইফুর রহমানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকে


থেকেছেন এবং সাংসদও নির্বাচিত হয়েছিলেন, তবু তাঁর ভাবমূর্তিতে বরাবর বিতর্কের নেতিবাচক ছায়া বিরাজমান ছিল।
তাই বলে তিনি অপহূত হবেন, গুম হবেন, খুন হবেন, সেটা তো চলতে পারে না, মানা যায় না।
এই পরিস্থিতিতে উদ্বেগের সঙ্গে দুটো বিষয় লক্ষ করছি। একদিকে এর নিছক মানবিক দিক, যা তাঁর স্ত্রী ও পরিবারের জন্য মুখ্য বিষয়, তাঁকে ক্রমেই ছাপিয়ে বিষয়টি রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে উঠেছে। বিরোধী দল বিএনপি তাদের চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলন চাঙা করতে ও জঙ্গি রূপ দিতে এই ইস্যুকে যে কাজে লাগাচ্ছে, তা অনভিপ্রেত হলেও অভূতপূর্ব নয়। কারণ, আমরা জানি, আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এটাই হওয়ার কথা। আওয়ামী লীগও এ কাজই করত। উদ্বেগের দ্বিতীয় কারণটি হলো, এই ঘটনার রাজনৈতিক অভিঘাত কেবল রাজপথের আন্দোলনে সীমাবদ্ধ না-ও থাকতে পারে। এটা গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য রীতিমতো হুমকি হয়ে উঠতে পারে। পরের বিষয়টা ব্যাখ্যা করা দরকার।
এ দেশের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখব, জনগণ যদিও রাজনৈতিক দলেরই নেতৃত্বে বারবার গণতন্ত্র এনেছে, কিন্তু তা ধরে রাখা যায়নি এবং যায়নি মূলত রাজনৈতিক ব্যর্থতার কারণে। ১৯৫৪, ১৯৫৮, ১৯৭৫, ২০০৭ সালে দেশের নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার উৎখাত হয়েছে, সরকারের পতন ঘটেছে। প্রতিবারই সামরিক হস্তক্ষেপে এমনটা ঘটেছে। এর পেছনে বিদেশি ষড়যন্ত্র, সামরিক বাহিনীর উচ্চাভিলাষ, দেশীয় সুযোগসন্ধানীদের ভূমিকা ইত্যাদি অবশ্যই ছিল। তাদের ষড়যন্ত্র সফল এবং হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি হয় কেন, সে প্রশ্নও তো ওঠা দরকার। তাই তাদের ন্যক্কারজনক ভূমিকার সমালোচনা করেই বলব, কেন আমরা বারবার এ ধরনের ষড়যন্ত্র ও অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপের শিকার হচ্ছি, সে কথাটা ভাবা জরুরি। আমাদের দুর্বলতা কোথায়, তা জানা এবং সংশোধন করাও কি জরুরি নয়?
অন্যের দোষ সম্পর্কে অবশ্যই জানব, বলব, কিন্তু যতক্ষণ নিজেদের দুর্বলতাগুলো না জানছি এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছি, ততক্ষণ তো এই ফাঁদ কেটে আমরা বেরোতে পারব না! একটু বড় প্রেক্ষাপট থেকে বিষয়টা বোঝা দরকার।
দেখা গেছে, কেবল দুর্নীতির কারণে গণতন্ত্র ব্যাহত হয় না, এর বড় দৃষ্টান্ত সাম্প্রতিক জাপান ও ইতালি। দ্রব্যমূল্য বাড়লে সরকারের সংকট হলেও গণতন্ত্রের সংকট হয় না, সাম্প্রতিক ভারত এর বড় উদাহরণ। জনসংখ্যার চাপ ও অশিক্ষাও গণতন্ত্রের জন্য বড় বাধা নয়। ভারতই তার ভালো দৃষ্টান্ত। এমনকি অপরাধের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আমরা শিশু, কিন্তু তা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ক্ষুণ্ন করতে পারে না। তবে প্রসঙ্গত বলতেই হবে, দুর্নীতিমুক্ত শিক্ষিত সচ্ছল অপরাধমুক্ত সমাজ যে আদর্শ এবং সবারই অভীষ্ট হওয়া উচিত, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
কেবল বলব, বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের যেগুলো মূল ও মৌলিক সমস্যা, সেগুলো নিয়েই পৃথিবীর দেশে দেশে গণতন্ত্র চালু রয়েছে। সেসব দেশে নানা ইস্যুতে সরকারের পতন হয়, বদল হয়। কিন্তু গণতন্ত্রের বদলে অনির্বাচিত সামরিক বা ছদ্মসামরিক তন্ত্র ফিরে আসে না। তাহলে আমাদের দুর্বলতা কোথায়?
দুটি বড় কারণের কথা বলব। প্রথমত, আমরা প্রকৃত নাগরিক সমাজ গড়ে তুলতে পারিনি, সেদিকে এগোচ্ছিই না। প্রাচীন গণতন্ত্রও নাগরিক সমাজেরই সৃষ্টি এবং তা বরাবর নাগরিক চেতনার মানের ওপর নির্ভরশীল। অথচ আমাদের এটি বস্তুত আত্মীয় সমাজ, যেখানে পরিচিত ‘আপনজনের’ প্রতি পক্ষপাতের ভিত্তিতে সুযোগ-সুবিধা ও অধিকারভোগ থেকে সব বিষয়ের নিষ্পত্তি হয়। নাগরিক সমাজ চলে মূলত আইনের ভিত্তিতে, যা ব্যক্তি ও সম্পর্কনিরপেক্ষ। এর লক্ষ্য ও ফল হলো প্রতিষ্ঠান ও পদ্ধতির বিকাশ, স্থিতিশীলতা ও কার্যকারিতা। কিন্তু আত্মীয় সমাজের কাজ হলো নিজ নিজ সুবিধা আদায়ে এতে হস্তক্ষেপ করে একে অকার্যকর করে নিজের বা ‘আপনজন’-এর পক্ষে ফল আদায়।
আমাদেরও আইন, সংসদ, প্রশাসন, বিধান, প্রবিধান সবই আছে। আছে নির্বাচিত সরকার, সার্বভৌম সংসদ, স্বাধীন বিচার বিভাগ, আধুনিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পুলিশ বিভাগ, অভিজ্ঞ প্রশাসন বিভাগ ইত্যাদি। কিন্তু একই সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানকে অর্থাৎ এসবের কর্তাদের প্রভাবিত করা, প্রয়োজনে পক্ষে টানার মতো ব্যক্তি, গোষ্ঠী এ সমাজে বরাবর সক্রিয়। প্রয়োজন পড়ে তাদের খুঁজে নেওয়া এবং আত্মীয় সমাজে—বলা বাহুল্য—তাদের খুঁজে পাওয়া মোটেও কঠিন নয়। কিন্তু সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে, যে সমাজ এভাবে চলে সেটি নৈতিকভাবে দুর্বল হয়। কারণ, যদি কারও দলীয় আনুগত্য না-ও থাকে, তবু আত্মীয়তার আনুগত্যের ঊর্ধ্বে এ সমাজের কেউ নয়। এভাবে পক্ষ নিতে গিয়ে মানুষ নীতি ও বিবেকবর্জিত কাজ তো করেই, আকছার নিয়মও ভাঙে, আইনের গতিও রোধ করে। দীর্ঘকাল এ অবস্থা চলতে চলতে এখানে প্রায় কোনো ফাইলই নিয়মে নিষ্পত্তি হয় না, ধরাধরি করে অর্থাৎ ক্ষমতাবান কাউকে দিয়ে সুপারিশ করে অথবা সব ঘাটে ঘুষ দিয়ে কাজ আদায় করতে হয়। শুধু তা-ই নয়, দিনে দিনে সমাজ ভালো-মন্দের, বড়-ছোটর জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। অর্থাৎ সমাজের নৈতিকতা দুর্বল হওয়ার পাশাপাশি মূল্যবোধও হারিয়ে যায়। কারণ, আমাদের বিচারবোধ বলে, আমার পছন্দের ব্যক্তি—যে পছন্দের কোনো যৌক্তিক ভিত্তি নেই, হয় আমার আত্মীয়, নয়তো জেলার লোক, হয়তো নিছক সহপাঠী কিংবা দলের নেতা ইত্যাদিই মাপকাঠি—কখনো ছোট হতে পারে না, দোষী হতে পারে না।
উপকার চাওয়া সমাজের রীতি, উপকারীর উপকার স্বীকার করা ভালো গুণ, কিন্তু উপকারটি যদি পক্ষপাতদুষ্ট কাজ হয়, আইনসম্মত না হয়? আমাদের সমাজ এসব নিয়ে ভাবিত নয়। যখন কোনো সাবেক উপাচার্য তারেক রহমানের মধ্যে ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রীকে দেখতে পান, যখন প্রধানমন্ত্রী পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির প্রার্থী ছেড়ে বিতর্কিত অভিযুক্ত প্রার্থীর পক্ষ নেন, এমনকি যখন দলীয় বিবেচনায় কি পারিবারিক অনুরোধে খোদ রাষ্ট্রপতি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির মুক্তির ব্যবস্থা করেন তখন বুঝতে হবে, গণতন্ত্র এ সমাজে এখনো নিরাপদ নয়। এ রকম সমাজে একজন নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চেয়ে একজন ইলিয়াস আলীর জনসমর্থন ও জাতীয় গুরুত্ব বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। এটি একটি ক্ষয়িষ্ণু সমাজ। এখানে আবার বলে রাখি, ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়া কোনোমতেই মানা যায় না এবং এর দায় সরকার এড়াতে পারে না।
দ্বিতীয় কারণটি আমাদের ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত।
ভাষা আন্দোলনের সূত্র ধরে গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকে এ দেশে একটি আধুনিক বাঙালি নাগরিক সমাজ গড়ে উঠছিল। ষাটের দশকের শেষে তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক বিকাশের আকাঙ্ক্ষাগুলো রূপ পেতে থাকে। কিন্তু এ জাগরণ ও বিকাশের প্রক্রিয়া রাজনীতি আর শহুরে সংস্কৃতিচর্চার গণ্ডি পেরোনোর আগেই পাকিস্তানি সামরিক জান্তা আমাদের ঠেলে দিল স্বাধীনতার দাবির দিকে। স্বাধীনতার পরও আমরা ষাটের দশকের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে পারতাম। কিন্তু নেতৃত্বের অসচেতনতা-অদূরদর্শিতা আর জিয়াউর রহমানের প্রতিক্রিয়াশীল শাসনের ধাক্কায় জাতি যাত্রাপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে গেল। এখন এখানে যুক্তি-বিজ্ঞান ও ইহজাগতিক ভাবনা ও সংস্কৃতিচর্চা নানাভাবে বিঘ্নিত, সীমিত ও আক্রান্ত হচ্ছে। মুক্তচিন্তার এবং সংশয় ও প্রশ্নের জায়গা কমছে, বাড়ছে অন্ধবিশ্বাস ও সংস্কারের দাপট। এই অবস্থার প্রতিকারে আওয়ামী লীগের অবস্থান বিভ্রান্তিকর। সেটা হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ, সমাজ-প্রগতি চিন্তার জগৎ স্পর্শ না করে পোশাকি পরিবর্তনে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়লে সে সমাজের চিন্তাজগৎ অপরিণত থেকে যায়। সেখানে ধর্মের নামে পারলৌকিক কথাবার্তা ও আচার-অনুষ্ঠান বাড়লেও পাল্লা দিয়ে বাড়ে ইহজাগতিক ভোগবিলাসের প্রবণতা। আর সর্বক্ষেত্রে উৎকর্ষ অধরা থেকে যায়। তদুপরি আমাদের শিক্ষা কেবল পরীক্ষা ও ফলমুখী বলে এর প্রভাব জীবনের বড় পরিসরে পড়ে না। নাগরিক মুক্ত সংস্কৃতির ভূমিকা এখনো শহুরে কিছু মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আর রাজনীতি? আপাতত নির্বাচনে জয় ও ক্ষমতা ছাড়া আর কিছুই এর বিবেচ্য নয়। ফলে নিত্যনতুন প্রযুক্তির ব্যবহারে আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠলেও চিন্তার জগৎ প্রায় সুপ্ত, নির্জীব।
আবার এ কারণে আইনের শাসনের পরিবর্তে আত্মীয়ের (অর্থাৎ আপনজনের) হস্তক্ষেপই এখানে সহায় হয় বেশি। সবাই কাছের মানুষ, পাশের জন, মনের মানুষ, পক্ষের মানুষ, অনুগতজন ধরে ধরেই কাজ চালায়। তাহলে যাদের এ রকম মানুষ নেই তারা এ সমাজের কেউ নয়? আর আইন? আইন, নিয়ম, বিধান ইত্যাদি অকার্যকর।
অথচ, এসব ছাড়া গণতন্ত্র তো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে না।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.