ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরাম-দিনবদলের স্বপ্ন ও বর্তমান বিশ্ব by মহিউদ্দিন আহমদ

তাঁরা এসেছিলেন পেরু থেকে পোল্যান্ডে, এঙ্গোলা থেকে আর্জেন্টিনায়, ব্রাজিল থেকে বাংলাদেশে, চিলি থেকে চীনে—পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকে। সেনেগালের রাজধানী ডাকারে বসেছিল ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরামের আসর, নাগরিক সমাজের বৈশ্বিক সম্মেলন।


৬ থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ডাকারের চেখ আন্তা ডিয়োপ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ মুখরিত ছিল হাজার হাজার মানুষের দৃপ্ত পদচারণে, নানা বয়সের নানা দেশের নারী ও পুরুষ, যাঁরা নিজ নিজ সমাজে নিরন্তর লড়াই করছেন সব রকমের বঞ্চনা আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে, শান্তি ও মানবাধিকারের পক্ষে, নয়া উদারবাদী অর্থনীতির পরিবর্তে সামাজিক ন্যায়বিচার ও ন্যায্য বাণিজ্যের ভারসাম্যপূর্ণ বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য।
রাষ্ট্র বনাম সিভিল সমাজ বা নাগরিক সমাজের বিভাজন ও বিতর্ক অনেক পুরোনো। রাষ্ট্রের খবরদারি আর পুঁজির দৌরাত্ম্যের বাইরে স্বস্তিতে নিঃশ্বাস ফেলার জায়গাটুকু ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। নাগরিকদের হাতে গড়া রাষ্ট্র আর ভোটে জেতা অভিভাবকদের অপশাসন, চোখ রাঙানি আর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজ যুগে যুগে, দেশে দেশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে; সক্রেটিস থেকে চমস্কি, এমনতর হাজারো মানুষ স্বাধীনতার জন্য প্রাণপাত করেছেন এবং করছেন। এই স্বাধীনতা হলো বিবেকের স্বাধীনতা, পতাকার স্বাধীনতামাত্র নয়। এরই নবতর রূপ একুশ শতকে দেখতে পাই ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরামের মধ্যে। এই ফোরাম প্রথম শুরু হয় ২০০১ সালের জানুয়ারি ব্রাজিলের পোর্তো এলেগ্রে শহরে।
পর পর তিন বছর পোর্তো এলেগ্রেতে এই ফোরাম বসেছিল; লাতিন আমেরিকার অনেক দেশে নাগরিক সমাজে সৃষ্টি করেছিল পরিবর্তনের জন্য নতুন প্রণোদনা। ফলে ব্রাজিলের রাজনীতিতে হাওয়া বদল হয়েছিল, গণমানুষের নেতা লুলা রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরিবর্তনের সেই ঢেউ আছড়ে পড়েছে আশপাশের দেশে, একের পর এক পেরু, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া ও চিলিতে। আর ভেনেজুয়েলা তো লাতিন আমেরিকার সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের সমীকরণটাই পাল্টে দিয়েছে।
ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরামের পটভূমি রচিত হয়েছে নয়া উদারবাদী অর্থনীতির মোড়কে আগ্রাসী বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের অঙ্গীকার নিয়ে। উল্লেখ্য, প্রতিবছর এ সময় সুইজারল্যান্ডের দাভোস শহরে শিল্পোন্নত দেশগুলোর বৈঠক বসে। বিশ্বের রাজনীতি, অর্থনীতি আর সমরনীতির নির্ধারকেরা দাভোসে বসে ছয় বিলিয়ন মানুষের ভাগ্য নিয়ে পাশা খেলেন। এরই পাল্টা হিসেবে নাগরিক সমাজ তাদের বৈশ্বিক সম্মেলন আয়োজন করে থাকে। এই ফোরাম একটি প্ল্যাটফরম, যেখানে নয়া উদারবাদ ও আগ্রাসী বিশ্বায়নবিরোধী বিশ্বের সব নাগরিক অংশ নিতে পারেন।
এ বছর এই ফোরামে অংশ নিয়েছেন ১২৩টি দেশের ১২০৫ সংগঠনের প্রতিনিধিরা। এ বছর বেশির ভাগই এসেছেন আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে। পাশের মৌরিতানিয়া, নাইজেরিয়া, সিয়েরা লিওন, মালি, বেনিন, বুরকিনা ফাসো, গিনি ও আইভরি কোস্ট থেকে এসেছে সড়কপথে শত শত মানুষের কাফেলা। ৮ থেকে ১০ হাজার এসেছেন আফ্রিকার বাইরে থেকে। বাংলাদেশ থেকে অংশ নিয়েছেন জনা দশেক। এঁদের মধ্যে ছিলেন নবধারা, ব্র্যাক, অঙ্গীকার বাংলাদেশ ও অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা। ফোরামের শেষ দিন, অর্থাৎ ১১ ফেব্রুয়ারি, মিসর থেকে একদল তরুণ হাজির হয়েছিলেন। তুমুল করতালির মধ্যে তাঁরা স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করেছিলেন আন্তা ডিয়োপ বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বর।
বিভিন্ন সংগঠন আয়োজন করেছে তাদের কর্মসূচিভিত্তিক সেমিনার, ওয়ার্কশপ ও র্যালি। আলোচ্য বিষয়গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, সামাজিক নিরাপত্তা, নারী-পুরুষ সমতা, সুশাসন, সামরিক ব্যয়, খাদ্য সার্বভৌমত্ব ও জলবায়ু পরিবর্তন। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সব রকমের বৈদেশিক দায়দেনার আশু অবলোপনের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন অনেকেই।
এবারের ফোরামের অন্যতম চমক ছিল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলিভিয়ার রাষ্ট্রপতি ইভো মোরালেসের উপস্থিতি। তিনি এসেছিলেন একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে, নাগরিক সমাজের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে, কোনো রকম প্রটোকল ছাড়াই। এসেছিলেন ব্রাজিলের সাবেক রাষ্ট্রপতি লুলা। গিনির পররাষ্ট্রমন্ত্রী, যিনি কিছুদিন আগেও ছিলেন একজন সমাজকর্মী, এসেছিলেন কোনো পাইকপেয়াদা ছাড়াই। এসেছিলেন জুবিলি সাউথ, সোশ্যাল ওয়াচ, এলডিসি ওয়াচ, ফ্রেন্ডস অব দি আর্থ ইন্টারন্যাশনাল, থার্ড ওয়ার্ল্ড নেটওয়ার্ক, সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর পোভার্টি ইরাডিকেশন, নেটওয়ার্ক অব আফ্রিকান উইমেনসহ অনেক বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা। এ ছাড়া প্রতিদিন উপস্থিত ছিলেন ডাকারের হাজার হাজার নাগরিক।
সেনেগাল আফ্রিকার একটি স্বল্পোন্নত মুসলিম-অধ্যুষিত রাষ্ট্র। মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে বাংলাদেশের প্রায় কাছাকাছি। কিন্তু দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশে বেশি। দেশটি একসময় ছিল ক্রীতদাস সংগ্রহ ও চালানের এক অন্যতম কেন্দ্র, যার সাক্ষী ডাকার বন্দরের কাছে গোরি দ্বীপের উঁচু দেয়ালঘেরা বন্দিশালার প্রতিটি ইট। তারপর ৫০টি বছর কেটেছে ফ্রান্সের উপনিবেশ হিসেবে। কবি ও রাষ্ট্রনায়ক লিওপোল্ড সেংঘরের এই দেশটি এখন মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে। আর ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরামের মতো একটা বিশাল অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে তারা প্রমাণ করেছে তাদের আন্তরিকতা ও সক্ষমতা। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ও এর আশপাশে উর্দিপরা ও সঙ্গিনধারী কাউকে দেখা যায়নি, শোনা যায়নি কোনো হইচই, কারও পকেট কাটা যায়নি, মধ্যরাত পর্যন্ত নির্বিঘ্নে ও নিশ্চিন্তে সব বয়সের নারী-পুরুষ ঘুরে বেড়িয়েছেন। কোনো অঘটন ঘটেনি। এসব দেখে মনে হয়েছে, দেশটা স্বাধীন, মানুষগুলো মুক্ত। এটাই গণতন্ত্র। গণতন্ত্র সংবিধানের পাতার কালো হরফে বন্দী কোনো মন্ত্র নয়, যা যখন-তখন জপ করতে হয়। গণতন্ত্র হলো ইচ্ছেমতো চলাফেরা করা, অন্যের ক্ষতি না করে। মনে হলো, সেনেগাল অনেক দূর এগিয়ে যাবে।
এই ফোরাম আয়োজন করে ‘ডাকারবাসী কী পেলেন?’ এক কথায় বলা যায়, আত্মবিশ্বাস আর নিজেকে বিশ্বের নাগরিক সমাজের কাছে ইতিবাচকভাবে তুলে ধরার সুযোগ। আর বিদেশ থেকে আসা অংশগ্রহণকারীরা কী পেলেন? তাঁরা পেলেন পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ, পরস্পরের সংগ্রামে সংহতি জানানোর ক্ষেত্র। তাই দেখা যায় ফিলিস্তিনিদের তাঁবুতে ফিনল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া আর নামিবিয়ার বন্ধুদের; হাইতির দুর্যোগপীড়িত মানুষের পক্ষে এশিয়া-আফ্রিকা-ইউরোপের নাগরিক সমাজের সরব উচ্চারণ: আমরা তোমাদের পাশে আছি। আর সবকিছু ছাড়িয়ে আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হলো হাজার হাজার মানুষের দৃপ্ত উচ্চারণ: এই পৃথিবী বিক্রির জন্য নয়, নতুন একটি পৃথিবী গড়ে তুলবই আমরা, আমাদের কোনো দায়দেনা নেই—তোমরা যারা আমাদের সম্পদ লুটে নিয়েছ শত শত বছর ধরে, তা আমাদের ফেরত দাও, এর জন্য তোমরাই ঋণী।
১১ ফেব্রুয়ারি একটি শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে শেষ হলো এই মিলনমেলার।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক, গবেষক।
mohi2005@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.