২৫ ফেব্রুয়ারি-স্বজন হারানোর দিন by ওয়ালিউল্লাহ

ফাগুন মাসে ৫৭টি পরিবারের সর্বনাশ হবে, এ ছিল কল্পনার অতীত। সেদিন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটতে পারে ৫৭ জনের কেউ ভাবতে পারলে হয়তো এ ঘটনা এড়ানো যেত। এ দিনে রক্তের হোলিখেলায় পরিকল্পনাকারীরা মেতে উঠেছিল। পরিকল্পনার বেড়াজাল ছিন্ন করা সম্ভব হয়নি।


যে কারণে চৌকস এসব মেধাবী সামরিক কর্মকর্তাকে জীবন দিতে হয়েছে। স্মরণকালের সবচেয়ে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি বাংলাদেশের জন্য ছিল অনভিপ্রেত। সবে দেশে একটি নির্বাচনের মাধ্যমে হোঁচট খাওয়া গণতন্ত্রের নবযাত্রা শুরু হয়েছিল। কেন ওই ঘটনা ঘটানোর জন্য ২৫ ফেব্রুয়ারিকে বেছে নেওয়া হয়েছিল, তা যেমন অজানা রয়ে গেছে, তেমনি অজানা থেকে গেল এর কুশীলবদের নেপথ্যের ব্যক্তিদের পরিচয়ও।
এ দেশের নিরাপত্তা রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যে নিরাপত্তারক্ষীদের নিরাপত্তা বিধান করার কথা ছিল, তারা কার ইঙ্গিতে সেদিন কাজ করেছিল, তা আজও আমাদের ভাবিয়ে তোলে। এই হত্যাযজ্ঞ কী কারণে ঘটানো হয়েছিল, তা জানতে অপেক্ষার প্রহর গুনতে হবে। বাংলাদেশ রাইফেলস দেশের একটি সুশৃঙ্খল ও ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বাধীনতা পদক লাভের গৌরব অর্জন করেছিল। ষড়যন্ত্রকারীরা কিছু সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে পরিকল্পনা করলেও এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন কর্মরত অনেক সদস্য। এ কালো অধ্যায়ের শিকার বিডিআরে কর্মরত সেনা কর্মকর্তাদের ওপর যে কাপুরুষোচিত ও বর্বরোচিত হামলা চালানো হয়েছে, তা নজিরবিহীন।
অতীতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যেসব বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল, সেগুলোর যদি বিচার হতো, অপরাধীরা শাস্তি পেত, তাহলে এ জাতিকে বারবার এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ও প্রতিশোধের রাজনীতি দেখতে হতো না। ৫৭ জনের স্বজন হারানো পরিবারের কান্নার সঙ্গে সুশৃঙ্খল জওয়ানদের অনেক পরিবারের কান্না আজ একাকার হয়ে গেছে। এই কান্নায় আকাশ ভারী হয়েছে। এমন মৃত্যু কারও কাম্য নয়।
এসব কর্মকর্তার অনেকেই জওয়ানদের প্রতি সংবেদনশীল ছিলেন, মায়া-মমতায় ভরা পেশাগত জীবন যাপন করছিলেন তাঁরা। অনেক কর্মকর্তা অধস্তনদের স্নেহ ও ভালোবাসায় পরিপূর্ণ রেখেছিলেন। এমন অনেক উদাহরণ আছে যেখানে কর্মকর্তা তাঁর জীবদ্দশায় জওয়ানদের জন্য সময় ও অর্থ ব্যয় করেছেন। এমন অনেক কর্মকর্তাও আছেন, যাঁরা কল্যাণমুখী কার্যক্রমের মাধ্যমে তাঁদের নেতৃত্বকে সুদৃঢ়ভাবে পরিচালনা করেছেন। জওয়ানদের পরিবারের জন্য পরিচালিত কল্যাণমুখী কার্যক্রমে কর্মকর্তাদের স্ত্রীদেরও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছিল। এ পেশায় দেওয়া আর নেওয়ার পারিবারিক বন্ধনে দৈনন্দিন জীবন পরিচালিত হয়ে আসছে দীর্ঘদিন থেকে। বিডিআরের এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা সেনাজীবনের জাতীয় নিরাপত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এটি শৃঙ্খলাভঙ্গের এক নিকৃষ্ট উদাহরণ হয়েই থাকবে।
পূর্বপরিকল্পিত এই হত্যাকাণ্ড স্ত্রীর কাছ থেকে স্বামীকে, সন্তানের কাছ থেকে পিতাকে, পিতার কাছ থেকে পুত্রকে কেড়ে নিয়েছে। আঘাত হেনেছে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তায়ও।
প্রতিটি ঘটনার পর তদন্ত আদালত গঠিত হলেও তাৎক্ষণিকভাবে ঘটে যাওয়ার মুহূর্তগুলো বিবেচনায় আনতে গিয়ে দীর্ঘসূত্রতার কারণে বিচারকার্য আইনি বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে যায়। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠা সবার কাম্য। কিন্তু আইন যখন ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা মানুষদের আশ্রয় দিয়ে আশ্রয়হীনদের নিরাশ্রয়ী করে তোলে, তখন আইনের শাসন প্রশ্নবিদ্ধ হয়। ৪০ বছরের বাংলাদেশে এমন সব লোমহর্ষক ও হূদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে, যা লাল-সবুজের পতাকায় আবৃত এ দেশের হাজারো মানুষের হূদয়কে রক্তাক্ত করেছে। আমরা আর কতকাল শুনব দুঃখের গান, কত কাল বইব শোকের বার্তা?
২৫ ফেব্রুয়ারি আমাদের সন্তানহারা বাবার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আমাদের মনে পড়ে যায় সেদিনের কথা, মুহূর্তে কালো মেঘে ঢেকে গিয়েছিল দিনটি, অবিরাম কান্নার বর্ষণে রক্তে ভেজা মাটি সিক্ত হয়েছিল। স্বজনহারাদের জন্য আমাদের সহমর্মিতা রয়েছে এবং থাকবে। আমরা বিদেহী আত্মাগুলোর মাগফিরাত কামনা করছি। কামনা করছি ঘাতক ও তাদের মদদদাতাদের সুষ্ঠু বিচার। আমরা প্রত্যাশা করি, সত্যিকারের বিচার হলে বারবার এ দেশের সবুজ মাটি রক্তে লাল হয়ে উঠবে না।
লে. কর্নেল ওয়ালিউল্লাহ: অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা।

No comments

Powered by Blogger.