সময়ের প্রেক্ষিত-‘আব্বু আমার লি গাং!’ by মনজুরুল হক

অনেকটা এই একই শিরোনামে একটি প্রতিবেদন নিউইয়র্ক টাইমস ছেপেছিল গত বছর নভেম্বরে। যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেই প্রতিবেদন, তা অবশ্য ঘটে এরও সপ্তাহ তিনেক আগে, মধ্য জাপানের হেবেই প্রাদেশিক বাওদিং শহরে। প্রাদেশিক পুলিশের উপপ্রধান হচ্ছেন শিরোনামের আলোচিত সেই পুরুষ লি গাং। শিরোনামেই যেমন আভাস পাওয়া যাচ্ছে, ঘটনার প্রধান আরেক চরিত্র হলো তাঁর আদরের ছেলে।


চীনে এক সন্তানের নীতি এখনো কার্যকর থাকায় আমরা ধরে নিতে পারি, পুলিশ কর্মকর্তার একমাত্র সন্তান হচ্ছে তাঁর সেই ছেলে। ফলে মা-বাবার অশেষ স্নেহ আর আদর-যত্নে মানুষ হওয়া সে রকম সন্তানদের বেলায় বখে যাওয়ার দরজা যেমন সহজেই খুলে যায়, চীনের সেই প্রাদেশিক পুলিশ-প্রধানের ছেলের বেলাতেও তার কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। উল্টোভাবে বরং আদর-যত্নের পাশাপাশি বাবার প্রতিপত্তি আর ক্ষমতার ব্যাপ্তি ছেলে লি চিমিংকে করে তুলেছিল আরও অনেক বেশি বেপরোয়া। সে রকম দৃষ্টান্ত অবশ্য হরহামেশা আমাদের চোখের সামনে দেখতে পাই। ক্ষমতার দাপটে ধরাকে সরা জ্ঞান করে বসে থাকা মানুষজন খুব সহজেই যে কথাটা ভুলে যায় তা হচ্ছে, মানুষের সহ্যের গ্রহণযোগ্য একটা সীমারেখা রয়েছে, যা অতিক্রম করা হলে এমনকি হা-ভাতে মানুষও মারমুখী হয়ে ওঠে এবং প্রতিশোধ গ্রহণে নিজস্ব পথ ধরে অগ্রসর হয়। ঠিক এ রকম কিছুই আমরা এখন সম্ভবত দেখছি মিসরে, জনতা যখন ভয়ের অদৃশ্য বাধা অতিক্রম করে গিয়ে উদিগরণ করে দিচ্ছে বছরের পর বছর ধরে মনের ভেতরে জমা হওয়া পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, যার সামনে এসে দাঁড়াতেই খসে পড়ছে এত দিনের বলদর্পী সব কাক-নায়কদের ময়ূরপুচ্ছ।
মানুষ যে সংঘবদ্ধ জীব, এই বাস্তবতা একালের তথাকথিত গণতন্ত্রের সেবক একনায়কেরা ক্ষমতার অন্ধকারাচ্ছন্ন কুঠুরিতে চাটুকার পরিবেষ্টিত অবস্থায় কালাতিপাত করতে গিয়ে প্রায়শই ভুলে বসে থাকেন। ফলে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর মানবিক গুণাবলিও তাঁদের চোখে ধরা দেয় না এবং সে রকম প্রক্রিয়ায় লি গাং ও তাঁর ছেলের মতো চরিত্ররা দাপটে চষে বেড়ায় নিজেদের বরাদ্দের তালুকজুড়ে। চীনের গত বছরের সেই ঘটনা এ রকম বাস্তবতাই আবারও আমাদের সামনে তুলে ধরছে।
ঘটনার মূল কাহিনি হচ্ছে এ রকম, পুলিশ কর্মকর্তার ছেলে এক সন্ধ্যায় মদ্যপান করে গাড়ি চালিয়ে স্থানীয় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীবাসে গিয়েছিল বান্ধবীকে তুলে নিয়ে অন্য কোথাও হাওয়া খেতে যাওয়ার উদ্দেশে। তবে মদ্যপ মানুষের বেলায় স্বাভাবিকভাবে যা ঘটে থাকে, লি চিমিংয়ের বেলাতেও এর কোনো ব্যতিক্রম লক্ষ করা যায়নি। অর্থাৎ, গাড়ির এক্সেলেটরে চাপ যে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তরল পানীয়ের প্রভাবে মনে দেখা দেওয়া ফুরফুরে ভাব তাকে তা বুঝতে দেয়নি। ফলে গাড়ির গতি সামনে বৃদ্ধি পেয়ে একপর্যায়ে চালকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং পথের পাশ দিয়ে স্কেটিং করে যাওয়া দুই যুবতীর ওপর গাড়িটি সরাসরি এসে আঘাত হানলে ঘটনাস্থলেই একজনের মৃত্যু হয়। দুই যুবতী ছিলেন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, যার সীমানার ভেতরে দুর্ঘটনা ঘটে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য ছাত্ররা দ্রুত দৌড়ে সেখানে চলে এসে গাড়ির গতি রোধ করে দাঁড়ালে লি চিমিংয়ের পক্ষে সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়া সেদিন আর সম্ভব হয়নি। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষের মতোই ছাত্ররা হাতের কাছে তাঁদের ঘৃণার পাত্রটিকে পেয়ে কিছুটা উত্তম-মধ্যম দিয়ে পুলিশের হাতে তাকে সোপর্দ করেন। তবে সে রকম অবস্থাতেই উদ্ধত সেই যুবক পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করার সময় চিৎকার করে সবাইকে শুনিয়ে সেদিন যা বলেছিল তা হচ্ছে, ‘দেখি, কীভাবে আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা তোমরা নাও! আব্বু আমার লি গাং! দেখিয়ে দেবে তোমাদের একহাত।’
তবে সে রকম উদ্ধত আচরণ দেখানোর সময় যে বাস্তবতা লি গাংয়ের সুযোগ্য ছেলে লি চিমিং সে দিন ভুলে গিয়েছিল তা হলো, সংবাদের প্রবাহ সহজে নিয়ন্ত্রণ করার একটি যুগের অবসান হয়ে অবাধ তথ্যপ্রবাহের নতুন এমন একটি যুগের সূচনা চীনসহ সারা বিশ্বে ইতিমধ্যে অজান্তেই কার্যকর হয়ে গেছে, যার কল্যাণে কে কোথায় কোন অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে, তার সচিত্র সংবাদসহ বিস্তারিত বিশ্লেষণ এখন সহজেই মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। ফলে বেচারা লি চিমিং বেফাঁস সেই মন্তব্য করে বসার অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে চীনজুড়ে তা চাউর হয়ে যায় এবং প্রশাসনকে নিয়ে মশকরা করার একটি উপায় হিসেবে লোকজন সুযোগ পেলেই ঠাট্টাচ্ছলে বলতে শুরু করে, ‘জানো না, আব্বু আমার লি গাং!’ গত কয়েক মাসে চীনের বিভিন্ন ইন্টারনেট ব্লগে সবচেয়ে বহুল ব্যবহূত বাক্য হয়ে দাঁড়িয়েছে এটি। শুধু তা-ই নয়, কোনো কোনো ব্লগার এমনকি ছেলেসহ আসল লি গাংয়ের ছবিও তাদের ব্লগে সংযুক্ত করে দিচ্ছে।
চীনের প্রশাসন অবশ্য বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি বাড়াবাড়ি হওয়ার আগেই ঘটনা ধামাচাপা দিতে তৎপর হয়ে উঠেছিল। হেবেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেমন ছাত্রদের তলব করে ঘটনা সম্পর্কে নিশ্চুপ থাকার নির্দেশ দেয়, ফলে লি চিমিংয়ের মদ্যপান করে গাড়ি চালিয়ে এক তরুণীর প্রাণ বধ করার ঘটনার সবটা একসময় ক্রমশ আড়ালে চলে গেলেও ‘আব্বু আমার লি গাং’ বাক্যটি ক্ষমতার অপব্যবহারের জুতসই এক রূপকের আকার নিয়ে চীনে এখনো মানুষের কাছে প্রিয় এক বাক্য হয়ে থেকে গেছে, যা কিনা একদলীয় শাসনব্যবস্থায় স্বচ্ছতার অভাব থেকে কোন পরিণতি সাধারণ নাগরিকদের ভোগ করতে হতে পারে, তারই গ্রহণযোগ্য এক দৃষ্টান্ত তুলে ধরছে। চীন সরকারও একদিকে সরাসরি বিষয়টি নিয়ে খুব একটা বাড়াবাড়ি রকমের প্রতিক্রিয়া দেখানো কঠোরভাবে বন্ধ করার পদক্ষেপ নেওয়া সত্ত্বেও অন্যদিকে আবার আইনের চোখে সব অপধারীকেই যে একই রকম সাজা ভোগ করতে হয়, তা দেখানোর জন্য আদালতে অপরাধের ত্বরিত নিষ্পত্তি ঘটিয়ে সেই রায় সম্পর্কে নাগরিকদের জানাতে বিলম্ব করেনি। সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত খবর থেকে আমরা জানতে পারি, চীনের একটি আদালত গত মাসের শেষ দিকে হেবেই প্রদেশের সেই পুলিশ কর্মকর্তার সুযোগ্য ছেলেকে তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। তবে বাবা লি গাংয়ের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা অবশ্য জানা যায়নি।
চীনের সেই ঘৃণিত পুলিশ কর্মকর্তা এখন সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের সামনেই প্রতীকী এক নাম হয়ে দাঁড়িয়েছেন। শোষণ আর অত্যাচারের মাত্রা যে সমাজে যত বেশি, লি গাং ও তাঁর ছেলের মতো চরিত্রের মানুষজনের আবির্ভাব সেই সমাজে ঠিক ততটাই বেশি। অন্যদিকে আবার এদের বিরুদ্ধে নাগরিক মনে জমা হওয়া ক্ষোভের মাত্রাও হচ্ছে সে রকম সমাজে অনেক গভীর।
লি গাং কিন্তু সব সমাজেই উপস্থিত, যদিও স্থানীয়ভাবে ভিন্ন নামে তাঁরা হাজির হচ্ছেন। আমরা যেমন আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে ভালোভাবেই অবগত কে এবং কারা ‘আম্মু আমার...’ কিংবা ‘ভাইয়া আমার...’, অথবা স্রেফ ‘ঠিকানা আমার অমুক ভবন’ দাবি করে কোটি কোটি টাকা মানুষের পকেট থেকে হাতিয়ে নিয়েছে। তবে কথা হচ্ছে, এসব বাবা, মা, ভাইয়া আর তাঁদের ছেলেমেয়েরা, ভাইবোনদের অবস্থা এখন খুব একটা ভালো নেই। মোবাইল ফোনের সহজলভ্যতা আর টুইটার ফেসবুকের বিস্তারের কল্যাণে আমরা সহজেই জেনে যাচ্ছি তাদের পরিচয় আর কীর্তিকলাপের বিস্তারিত বর্ণনা, যা কিনা অন্যভাবে আরও কিছুটা উসকে দিচ্ছে আমাদের মনের গভীরে জমা হওয়া ক্ষোভের মাত্রা। ফলে আমরা সমবেত হচ্ছি কায়রোর তাহরির স্কয়ারে, তিউনিসের বুর্গুইবা এভিনিউতে কিংবা বিশ্বের যেখানেই নিপীড়ন আর অত্যাচারের মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে আমাদের সহ্যের সীমানা, সে রকম কোনো দেশের রাজধানীর নগরকেন্দ্রে।
লি গাংদের এখন বুঝে নেওয়া দরকার, নতুন এই বিশ্ব তাদের জন্য নয়। যত দ্রুত সেই উপলব্ধি তাদের মধ্যে দেখা দেবে, ততই মঙ্গল হবে মানবজাতির, মঙ্গল হবে বিশ্বের তাবৎ শান্তিপ্রিয় মানুষের।
টোকিও
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.