কালের পুরাণ-সংবিধান পুনর্মুদ্রণ না সোনার পাথরবাটি? by সোহরাব হাসান

বাঘ ও মোষকে এক ঘাটে পানি খাওয়ানোর মতো অসম্ভব কাজটিই সম্ভব করেছে মহাজোট সরকারের আইন মন্ত্রণালয়। তারা আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির ত্রিধারাকে এক ধারায় নিয়ে এসেছে বাংলাদেশের পুনর্মুদ্রিত সংবিধানের নামে।


এতে বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতা, জিয়াউর রহমানের বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম এবং এরশাদের রাষ্ট্রধর্মের সহাবস্থান নিশ্চিত করা হয়েছে। পরবর্তী দুই নেতার নামের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণকে যে আওয়ামী লীগ না-জায়েজ মনে করে, এখন তারাই কাতারবন্দি করে ফেলেছে। কাজটি কোনো অ-আওয়ামী লীগার করলে নিশ্চয়ই আদালতে মামলা হতো। এখন মামলাটি কে করবেন?
অবশ্য এ ক্ষেত্রে আইন মন্ত্রণালয় পঞ্চম সংশোধনী প্রসঙ্গে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের রায়ের দোহাই দেবে। কিন্তু সংবিধান পুনর্মুদ্রণের ক্ষেত্রে সেই রায়ও পুরোপুরি মানা হয়নি বলে লিখেছেন বন্ধু সহকর্মী মিজানুর রহমান খান। তিনি যে কথাটি পাঠককে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন তা হলো, সুপ্রিম কোর্টের রায়ে নেই এমন কিছু সংবিধানে ঢোকানো হয়েছে। তাঁর লেখার কোনো প্রতিবাদ বা ব্যাখ্যা দেয়নি মন্ত্রণালয়। সত্যি সত্যি যদি আইন মন্ত্রণালয় সেই কাজ করে থাকে, তাহলে কি সেটি আদালত অবমাননা নয়? কেবল সাংবাদিকেরা লিখলেই আদালত অবমাননা হয়? এ পর্যন্ত সংবিধানে যতগুলো অন্যায্য ও অবৈধ সংশোধনী এসেছে, তার সবগুলোই আইন মন্ত্রণালয়ের তৈরি। সামরিক হোক আর অসামরিক হোক, এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বেও গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তি ছিলেন। তাঁদের কারও বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা হয়নি।
এদিকে আইন মন্ত্রণালয়ের সংবিধান পুনর্মুদ্রণের এখতিয়ার আছে কি না, সে বিষয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ প্রশ্ন তুলেছেন। গতকাল আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদও স্বীকার করেছেন, সংবিধান প্রণয়নের মালিক জাতীয় সংসদ। আদালত কেবল সংবিধানের মৌল কাঠামোবিরোধী আইন ও ফরমানগুলো বাতিল করে দিয়েছেন।
আমরা সংবিধান পুনর্মুদ্রণের আইনি বিতর্কে যেতে চাই না। সেই কাজটি আইনজ্ঞরা করবেন, তাঁরা ক্লান্ত হয়ে পড়লে দেশ-বিদেশের আইন ও সংবিধান যিনি ঘাঁটাঘাঁটি করেন, মিজানুর রহমান খান—তিনিই তাঁদের শূন্যতা পূরণ করবেন।
কিন্তু আমরা সংবিধান পুনর্মুদ্রণের কিছু রাজনৈতিক প্রশ্ন তুলতে চাই।
পত্রিকায় যেসব প্রতিবেদন এসেছে এবং সংবিধান সংশোধনসংক্রান্ত বিশেষ কমিটির কো-চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সাংবাদিকদের কাছে যা বলেছেন, তাঁর সারমর্ম হলো: সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকবে। বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম থাকবে এবং এরশাদের রাষ্ট্রধর্ম ইসলামও বহাল থাকবে। অর্থাৎ একই ছাতার নিচে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও এরশাদ।
আমরা এটাকে রাজনৈতিক ছলচাতুরী বলেই মনে করি। ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মবাদিতা একসঙ্গে চলতে পারে না; আধুনিক রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রে তো নয়ই। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ভারত ও পাকিস্তান। পাকিস্তান থেকে গণতন্ত্র চিরতরে নির্বাসিত। ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতা রেখে ধর্মীয় রাজনীতি করতে দেওয়ার পরিণামও আমাদের জানা। ১৯৯২ সালে হিন্দু জঙ্গিবাদীরা কেবল বাবরি মসজিদ ভাঙেনি, সেই দেশটির কোটি কোটি মানুষের হূদয়ও ভেঙেছে।
আওয়ামী লীগকে এখন স্পষ্ট করে বলতে হবে, তারা কি ধর্মনিরপেক্ষতা চায় না? সেটা না চাওয়ার স্বাধীনতা তাদের আছে। কিন্তু জিয়া ও এরশাদের রাজনীতিকে স্বীকার করে নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা হয় না। এত দিন জানতাম, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-জাতীয় পার্টির বিরোধ মূলত রাষ্ট্রের এই মৌলিক কাঠামোটি নিয়ে। সেই বিরোধই যদি মুছে দেওয়া হয়, তাহলে বঙ্গবন্ধুর পাশাপাশি জিয়া ও এরশাদকেও জাতীয় নেতার খেতাব দিতে হবে।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব যদি মনে করেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা রাখার যুক্তি নেই, তাহলে ব্যক্তি হিসেবে পছন্দ না করলেও তাঁদের অভিপ্রায়কে সাধুবাদ জানাব। তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি আসন পাওয়া দলটি যা করবে, তা-ই আমাদের মেনে নিতে হবে। তবে একই সঙ্গে দুটি চলতে পারে না—ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা।
বিশ্বকাপ ক্রিকেট উপলক্ষে ঢাকা মহানগর সাজানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ইসলামী ব্যাংককে। এখন শহরের মোড়ে মোড়ে সাজানো আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক নৌকায় ইসলামী ব্যাংকের নামফলক ঝুলছে। তাতে আপত্তির কিছু নেই। কিছুদিন আগেও তো প্রচার করা হতো, ইসলামী ব্যাংক জামায়াতের প্রতিষ্ঠান এবং এটি জঙ্গিদের অর্থের জোগান দিচ্ছে। মানুষ কোনটি বিশ্বাস করবে? এক কথা বলে ভোট নেবেন, ভোট নেওয়ার পর অন্য কথা বলবেন—এই স্ববিরোধিতা কেন?
তার পরও বিষয়টির একটি ইতিবাচক দিক আছে। আওয়ামী লীগের নতুন এই উদ্যোগ বাংলাদেশের রাজনীতির ঐক্যসূত্র হতে পারে। আপনারা তিন দলই মিলেই সংবিধানটি এমনভাবে সংশোধন করুন, যাতে ভবিষ্যতে এ নিয়ে বিতর্ক না হয়। কেউ গায়ের জোরে উল্টে না দেয়।
শেখ হাসিনার সরকার একটি আধুনিক, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের কথা বলে ক্ষমতায় এসেছে। তারা এত দিন বাহাত্তরের সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা বলে আসছিল। এখন কি বিতর্কিত পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনীর কিছু অংশ নিয়ে সেটি কায়েম করতে চায়? আদালতের রায় অনুযায়ী সমাজতন্ত্রও সংবিধানের অংশ হয়ে গেছে, তার অর্থ এই নয় যে বাংলাদেশ সংবিধান পুনর্মুদ্রণের পর থেকে সমাজতন্ত্র কায়েম হয়ে গেছে।
কয়েক দিন আগেও সরকারের মন্ত্রীরা জিয়াউর রহমানকে পাকিস্তানের এজেন্ট প্রমাণ করতে জনসমক্ষে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন। এখন সেই সরকারই কী করে তাঁর আদর্শকে সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশ করল, সেটাই প্রশ্ন। মাননীয় আদালত বলেছিলেন, কোনো সামরিক আইনবলে কিংবা জাতীয় সংসদেও এমন আইন করা যাবে না, যা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী। তাহলে সংবিধানের যে চতুর্থ সংশোধনীতে সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, মানুষের বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছিল, সেটি কি বাহাত্তরের সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী ছিল না? যদি পরিপন্থী হয়ে থাকে, তাহলে মাননীয় আদালত কেন চতুর্থ সংশোধনীকেও রায় দ্বারা বাতিল করলেন না?
অবশ্য আদালত বলতে পারেন যে চতুর্থ সংশোধনীর কতিপয় বিষয় জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমানবলেই বাতিল করে দিয়েছিলেন। আদালতও সেসব ফরমান দেশ ও ‘জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে’ মার্জনা করে দিয়েছেন। বড় পরিহাস যে, আমরা এমন এক দেশে বাস করছি যেখানে বহুদলীয় গণতন্ত্র এসেছে সামরিক ফরমানবলে। তখন কিন্তু মাননীয় আদালত জনগণকে সেই অধিকার ফিরিয়ে দেননি। তবে এত কিছুর পরও জিয়া বা এরশাদ কেউ-ই গণতন্ত্রী হতে পারেননি। আগাপাছতলা স্বৈরশাসক।
আমাদের প্রশ্ন, আদালতের রায়ের পর জাতীয় সংসদের স্পিকার ১৫ সদস্যের একটি সর্বদলীয় কমিটি গঠন করেন সংবিধান সংশোধনের জন্য। সেই কমিটিতে বিরোধী দল থেকে একজন সদস্য নেওয়ার কথা থাকলেও বিএনপি রাজি হয়নি। ফলে এটি মহাজোটীয় কমিটি হয়েছে। পুনর্মুদ্রিত সংবিধান পেয়ে এরশাদ নিশ্চয়ই আহ্লাদিত হবেন। যে অষ্টম সংশোধনীর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ হরতাল করেছিল, সেই আওয়ামী লীগই তাকে সাদরে বরণ করে নিয়েছে। তবে কমিটির সদস্য রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনুর মনোভাব আমরা জানতে পারিনি। রাষ্ট্রধর্ম আইনের বিরুদ্ধে তাদের জেহাদি জোশ এখন আর দেখা যায় না। মামলাও না। ছিয়াত্তরে কর্নেল তাহেরের বিচারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা মামলা চলতে পারলে এরশাদের বিরুদ্ধে একানব্বইয়ের মামলা কেন চলবে না? কমিটির কো-চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্তই বা কীভাবে একে ইতিহাস ও সমাজ-রাজনীতির দর্শন হিসেবে মেনে নিয়েছেন? পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনীর কোনো অংশ রেখে যে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র করা যায় না, সেটি রাজনীতির অ আ ক খ পড়া শিক্ষার্থীও বোঝে। শুধু বোঝেন না বিশেষ কমিটির বিজ্ঞ সদস্যরা।
আমরা রাজনীতিতে ধর্মের প্রবেশকে আধুনিক রাষ্ট্রের প্রধান অন্তরায় বলে মনে করি। যে সমস্যায় প্রতিবেশী ভারত ভুগছে; তারা রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ অবয়ব দেখতে চায়; অথচ রাজনীতিকে ধর্মীয়করণের যতগুলো উপায় আছে, তা নির্দ্বিধায় গ্রহণ করেছে। আওয়ামী লীগ মনে করছে, ধর্মনিরপেক্ষতাই সমস্যা ছিল। আসলেই সমস্যা ছিল স্বাধীনতা-পরবর্তী শাসকদের অনাচার, জবরদস্তি ও বাড়াবাড়ি। এক কথায় যা তারা বিশ্বাস করত না, তা-ই সদর্পে প্রচার করেছে। অন্যের মুখ বন্ধ করার সব চেষ্টা চালিয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্রীয় নীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র প্রতিস্থাপন করলেও মানুষের ভাত-কাপড়ের সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। মানুষের পেটে ভাত দিতে না পারলে কোনো আদর্শের বুলি কপচিয়ে লাভ হবে না।
প্রথমেই বুঝতে হবে, সংবিধান আইন, বিধি—এসব কার জন্য? যদি জনগণের জন্য হয়, তাহলে জনগণের স্বার্থের কথাই ভাবতে হবে। এই যে আমাদের সংবিধান ১৩-১৪ বার কাটাছেঁড়া করা হলো কার স্বার্থে? কখনো ব্যক্তি কখনো গোষ্ঠী, কখনো বা অবৈধ ক্ষমতা বৈধ করার জন্য। সংবিধানের খুব কম সংশোধনীর সঙ্গে জনস্বার্থের সম্পর্ক আছে।
একটি কথা এখানে পরিষ্কার করা প্রয়োজন। সংবিধান সংশোধনে আনা কোনো গোঁজামিল চলতে পারে না। সেটি গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতার ক্ষেত্রেও। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রেখে, সংবিধানে বিসমিল্লাহ বহাল রেখে ধর্মনিরপেক্ষতা কায়েম করা যায় না। বাহাত্তরের সংবিধানের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন হয়নি। আন্দোলন হয়েছে তৎ কালীন সরকারের অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ ও সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে।
সংবিধান সংশোধন কমিটি কি পরিবর্তন আনতে চায়? তারা কি সর্বধর্ম সমন্বয়ের মতো সর্বমতাদর্শের সমন্বয় করতে চাচ্ছে? তাহলে সেই কথা খোলাখুলি বলুক। এও বলুক যে আসলে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-জাতীয় পার্টির মধ্যে তেমন ফারাক নেই। এখানে বঙ্গবন্ধুর বাঙালি জাতীয়তাবাদ, জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ এবং এরশাদের নতুন বাংলাকে একই পঙিক্তভুক্ত করা হয়েছে। এটি রাজনৈতিক মতাদর্শের ককটেল বা সোনার পাথরবাটি ছাড়া কিছু নয়।
আমরা সত্যিকার অর্থে একটি গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও ভবিষ্যৎ মুখী বাংলাদেশ চাই। পশ্চাৎ পদ অপরাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। রাজনীতিতে আদর্শের লড়াই থাকবে, নীতিহীনতা থাকবে না; সহনশীলতা থাকবে, আসপকামিতা থাকবে না। সংসদীয় বিশেষ কমিটি যা করতে চাইছে, তাকে কবি শামসুর রাহমানের ভাষায় বলতে হয়, ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.