সপ্তাহের হালচাল-মিসর থেকে বাংলাদেশ কত দূর by আব্দুল কাইয়ুম

মিসরের মতো বাংলাদেশেও গণবিস্ফোরণ ঘটতে পারে বলে বিএনপির নেতারা সম্প্রতি সরকারকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন। গত সোমবার ঢাকা শেয়ারবাজারের বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা মধুমিতা সিনেমা হলে আগুন দিলে ওই ঘটনাকে বিএনপির নেতারা ‘আসন্ন গণবিস্ফোরণের’ আগাম সংকেত বলে ধরে নিয়ে পরবর্তী করণীয় স্থির করতে বসে গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।


বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ গত শনিবার প্রেসক্লাবে এক আলোচনা সভায় বলেন, ‘দেশে গণতন্ত্রের নামে স্বৈরতন্ত্র চলছে।’ তাহলে তো মিসর থেকে বাংলাদেশ বেশি দূরে নয়, কারণ সেখানেও চলছিল হোসনি মোবারকের স্বৈরতন্ত্র।
এর আগে আড়িয়ল বিলে নতুন বিমানবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে গণবিস্ফোরণ ঘটে গেছে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শেষ পর্যন্ত বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার দাবি ‘মেনে নিয়ে’ পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন বলে সেই জন-অসন্তোষ আর অভ্যুত্থানের দিকে যেতে পারেনি। এখন শেয়ারবাজারে বিক্ষোভ, বিশ্বকাপ ক্রিকেটের টিকিট না পাওয়ার জন্য বিক্ষুব্ধ ক্রীড়ামোদিদের বিক্ষোভ প্রভৃতি কতটা দানা বাঁধে, সেটা হয়তো বিএনপি পর্যবেক্ষণ করছে।
তবে বাংলাদেশে মিসরের মতো অবস্থা সৃষ্টির সম্ভাবনা সম্পর্কে বিএনপির নেতাদের মনেও সন্দেহ যে নেই, তা বলা যাবে না। সেটা মওদুদ সাহেবের কথার সুরেই বোঝা গেছে। তাঁর বক্তৃতার শেষ দিকে তিনি বলেন, ‘সরকার ইচ্ছা করলে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এমন পরিবেশ তৈরি করতে পারে, যাতে বিএনপি সংসদে যেতে পারে।’ রাজপথ তেজি থাকলে তাঁদের এত দিনের সংসদ বর্জনের ধারা পরিত্যাগের কথা নয়। যাঁরা ঝানু রাজনীতিবিদ, তাঁরা জানেন যে গণজাগরণ ধরনের জিনিস কখন কোন দিকে মোচড় দেয়। বিএনপি চলতি অধিবেশনে যোগ না দিলে তাদের সাংসদদের সদস্যপদ চলে যেতে পারে। সুতরাং এখানে চালে ভুল করার কোনো সুযোগ নেই। হয় মিসরের মতো গণ-অভ্যুত্থান, নয়তো সংসদে যেতে হবে।
মিসরের অবস্থাটা একবার ভালোভাবে বোঝা দরকার। কেন সেখানে মানুষ লাখে লাখে রাস্তায় নেমে এসে হোসনি মোবারককে পদত্যাগে বাধ্য করল? গামাল আবদুল নাসেরের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১৯৫২ সালে মিসরে যখন বিপ্লব হয় এবং এরপর ১৯৫৬ সালে মিসর যখন ব্রিটিশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, একটি আঞ্চলিক যুদ্ধের হুমকি মাথায় নিয়ে সুয়েজখাল জাতীয়করণ করে, তখন আরব বিশ্ব উৎসাহিত হয়। ওই একনায়কতন্ত্রী ব্যবস্থার অনুকরণে আলজেরিয়া থেকে ইরাক, ইয়েমেন পর্যন্ত পরিবর্তন সূচিত হয়। কিন্তু হোসনি মোবারক সেই মিসরকে নিয়ে যান গণবিরোধী অবস্থানে। মিসরের ৪০ শতাংশ মানুষ এখন দিনে দুই ডলারেরও নিচে আয় করে। তারা আক্ষরিক অর্থেই দিন আনে দিন খায়। এক দিন কাজ না করলে উপোস থাকতে হয়। এই পরিস্থিতিতে মানুষ সহজে রাস্তায় নামতে পারে না, কারণ তাদের রোজগার বন্ধ হয়ে যাবে। উপরন্তু নেই গণতন্ত্র। ৩০ বছর ধরে জরুরি আইন দিয়ে সব ধরনের প্রতিবাদের পথ বন্ধ করে রাখা হয়েছে। পরিস্থিতি কতটা খারাপ হওয়ার পর মিসরে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
মোবারকের পর কতটা গণতন্ত্র আসবে, আবার সামরিকতন্ত্র নতুন বেশে চেপে বসবে কি না, তা দেখার জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে কোনো গণ-আন্দোলনই বৃথা যায় না। মিসরের গণবিপ্লব অবশ্যই মৌলিক অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠিত করবে। ১৯৫২ সালের বিপ্লব যেমন আরব বিশ্বের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করেছিল, এবারের বিপ্লবও পার্শ্ববর্তী আরব দেশগুলোতে গণতন্ত্রের সূচনা ঘটাবে বলে আশা করা যায়।
মিসরের বার্তা হলো গণতন্ত্র। আর বাংলাদেশের সামনে মূল বিবেচ্য হলো চলতি গণতন্ত্রকে জনগণের জীবনে অর্থবহ করতে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ। চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম, বিদ্যুৎ, গ্যাস, আইনশৃঙ্খলা—এ সবই হলো আজকের বাংলাদেশের সামনে চ্যালেঞ্জ। সরকার যদি এসব সমস্যা সমাধানে সঠিক পদক্ষেপ নেয়, ভালো। যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে জন-অসন্তোষ বাড়বে। এই মুহূর্তে সবকিছু সমাধান হয়ে যাবে, তা নয়। সময় দিতে মানুষ প্রস্তুত। কিন্তু আজ না হলেও আগামীকাল যে সমাধানের পথ খুলবে, তার লক্ষণ আজকের কাজকর্মে থাকতে হবে। সমস্যা হলো, সেখানেও সরকার খুব একটা সফলতা দেখাতে পারছে না।
দেশে গণতন্ত্র কতটুকু আছে? বিএনপির নেতারা বলছেন, একটুও নেই। তাহলে সংসদে সরকারদলীয় সাংসদেরা তাঁদেরই মন্ত্রীদের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে কথা বলছেন কীভাবে? শেয়ারবাজারে কেলেঙ্কারির জন্য বিরোধী দলকে দায়ী করে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের ব্যাপারে দলের অন্যতম সাংসদ লোটাস কামাল সংসদীয় কমিটির সভায় ভিন্নমত প্রকাশ করেন কীভাবে? সরকারদলীয় সাংসদ রহমত আলী যে বলেছেন, এই মন্ত্রিসভাকে স্থবির মন্ত্রিসভা বলছে মানুষ, এ কথা তো একেবারে ভিত্তিহীন নয়। প্রথম আলোর অনলাইন জরিপে ৯০ শতাংশ মানুষ এই মন্তব্য সমর্থন করেছে। এসব তিক্ত সত্য কথা বলা বা নিজ দলের সমালোচনা করার জন্য কিন্তু তাঁদের দল থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে না। দলীয় সভায় তাঁরা তোপের মুখে পড়ছেন, কিন্তু বি চৌধুরীর মতো অসম্মানজনক বিদায় বরণ করতে হচ্ছে না।
সংসদে সরকারের সমালোচনা করবে মূলত বিরোধী দল। তারা যখন যাচ্ছে না, তখন সরকারি দলের সাংসদেরাই যদি সমালোচনার কাজটি করেন, তাহলে তো সেটা উৎকৃষ্ট গণতন্ত্র। আর বিরোধী দল বলে কিনা, গণতন্ত্র নেই! সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ যদি পরিবর্তন করা যায়, তাহলে তো আরও ভালো। সংসদের ভেতরে সাংসদেরা নিজ দলের বিরুদ্ধে নির্ভয়ে অবস্থান নিতে ও ভোট দিতে পারবেন। কিন্তু এখনো ৭০ অনুচ্ছেদে যা আছে, তাতে সংসদে নিজ দলের কর্মকাণ্ড ও নীতি-অবস্থানের বিরুদ্ধে কথা বলতে বাধা নেই, ভোট দিতে বাধা আছে। তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ওবায়দুল কাদের, রহমত আলী বা লোটাস কামাল যে মাঝেমধ্যে মন্ত্রীদের কাজকর্মের সমালোচনা করে কথা বলেন এবং তার পরও বহাল তবিয়তে দলের মধ্যে রয়েছেন, সেটা গণতন্ত্রের সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে তাঁদের কথাবার্তার ব্যাপারে মৌন সম্মতি প্রকাশ করছেন, সেটা উন্নত গণতান্ত্রিক মানসিকতার পরিচয়। এই ধারা যত দৃঢ় হবে, বাংলাদেশ মিসর থেকে তত দূরে অবস্থান করবে।
তবে কিছু ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। বিগত নির্বাচনে যে বিএনপির ভরাডুবি হয়েছিল, তার অন্যতম কারণ ছিল বেশুমার দুর্নীতি ও দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির ব্যবস্থা করা। হাওয়া ভবন এরই প্রতীকে পরিণত হয়েছিল। সত্যিকারের গণতন্ত্র শক্তিশালী হলে, যে ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলা হয়, তা বাস্তবে কার্যকর হতে থাকলে, সব পর্যায়ে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হলে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে। দুর্নীতি ঠিক করতে পারলে সাফল্যের একটি বড় মাইলফলক স্থাপিত হবে। তখন উন্নয়ন বলুন বা দ্রব্যমূল্য বলুন, অনেক কিছুরই সমাধানের রাস্তা খুলে যাবে। কিন্তু দুদককে যেভাবে দুর্বল করা হচ্ছে, তাতে মনে হয় না যে এই সহজ বিজয় অর্জনে সরকারের উৎসাহ আছে। বাজারে নানা রকম কানাঘুষা আছে। সরকার ডিজিটাল কানের ব্যবস্থা করলে সব শুনতে পারবে। আর বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ থাকলে কালবিলম্ব না করে তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তস্থানীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নত করা। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের কথা বলা হয়েছিল। সে কথা রাখতে হবে। এখন যদি সরকার মনে করে যে ওই কথা রাখা সম্ভব নয়, তাহলে জনগণের সামনে ব্যাখ্যা করে বলা হোক। কিন্তু আইনের বাইরে কিছু করলে নিশ্চয়ই সমালোচনা হবে। সেই সুযোগ বন্ধ করা যাবে না। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান যে নিজস্ব ধারায় এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলে যাচ্ছেন, সেদিকে সরকারের মনোযোগ দিতে হবে।
দেশের ভেতর বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনাগুলো সরকার যেমন ফাইলচাপা দিয়ে রাখে, তেমনি সীমান্তে বিএসএফের গুলি করে হত্যার ব্যাপারেও খুব বেশি সোচ্চার নয়। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সাপ্তাহিক দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকায় (৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১১) ‘ফেলানীস লাস্ট স্টেপ’ নামে নিবন্ধে বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। ৭ জানুয়ারি শেষ রাতে বিএসএফের গুলিতে নিহত ফেলানীর লাশ পরদিন সকাল পর্যন্ত পাঁচ ঘণ্টা তারকাঁটার বেড়ায় ঝুলে ছিল। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় এই করুণ মৃত্যুর দৃশ্য ছাপা হয়। বাংলাদেশ সরকারের প্রতিক্রিয়া ছিল বিলম্বিত। যে সরকার নিজ দেশের ভেতর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিচারে দ্রুত ব্যবস্থা নেয় না, তার পক্ষে এসব ব্যাপারে কিছু বলার নৈতিক শক্তি থাকে কী?
সীমান্ত পারাপারের বিষয়টি সবাই জানে। ফেলানীর বাবা তাদের নিরাপদে সীমান্ত পার করে দেওয়ার জন্য ভারতের একজন দালালকে তিন হাজার রুপি (৬৫ মার্কিন ডলার) দিয়েছিলেন (দেখুন, দ্য ইকোনমিস্ট)। তাঁর মেয়েকে যে এভাবে মেরে ফেলা হবে, সেটা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। সীমান্তে এই নির্মম হত্যাকাণ্ড চলছে নির্বিচারে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের হিসাব অনুযায়ী, গত ১০ বছরে এক হাজার বাংলাদেশিকে এভাবে হত্যা করা হয়েছে। ভারত প্রায় নিশ্চুপ। বাংলাদেশের প্রতিবাদের ভাষা দুর্বল। নিজ দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ না করলে সীমান্তে হত্যা বন্ধে জোরালো অবস্থান গ্রহণ করা সরকারের পক্ষে কঠিন।
মানুষ ভারতের ব্যাপারে সব সময় একটু সমালোচনামুখর। এর একটি ন্যায্য ভিত্তিও আছে। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে ভারতকে কার্যকর সহায়তা দিচ্ছে, তাহলে কেন ভারতের কাছ থেকে সীমান্তে সহনশীল আচরণ পাওয়া যাবে না? এই প্রশ্নটি সরকারের পক্ষে জোরেশোরে তোলা উচিত। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ১২ ফেব্রুয়ারি ব্লাস্ট আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এ বিষয়ে সোচ্চার বক্তব্য দিলে সেখানে উপস্থিত ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী কলিন জনসালভেজ তাঁর দেশে এ বিষয়ে জনস্বার্থে মামলা করার কথা বলেছেন।
এসব স্পর্শকাতর বিষয়ে সরকারের বলিষ্ঠ ভূমিকা না থাকলে মানুষ বিভ্রান্ত হতে পারে। তখনই জনগণের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এর ফলে মিসরের মতো পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটবে, এমন বলা যায় না। তবে জন-অসন্তোষের ফলে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সরকারের পরিবর্তন ঘটতে পারে। দেশে বিগত কয়েক মেয়াদে সুষ্ঠু নির্বাচন ও ভোটের রায়ের যথাযথ প্রতিফলন ঘটায় এটা বলা যায় যে মানুষ রাস্তায় নেমে সরকার পরিবর্তনের চেয়ে বরং নির্বাচনে ভোটের রায়ের মাধ্যমে সরকারের পরিবর্তন ঘটাতে বেশি আগ্রহী হবে। তাই সরকারের সব সময় মনে রাখা দরকার, মিসরের সঙ্গে বাংলাদেশের ভৌগোলিক দূরত্ব বেশি হলেও নিশ্চিন্তে থাকার সুযোগ নেই।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.