চারদিক-শ্রমে কেনা অন্ন by নেয়ামতউল্যাহ

শীত গিয়ে ফাগুন এসেছে। দখিনা বাতাস বয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ভোর তা বলে না। ভোরে ঘন কুয়াশা। শীত কিছু কমে এসেছে সত্য, তবু ভোর-বিহানের শীত উদোম শরীরে চিকন দাঁতে কামড়ে ধরে। তেল চিটচিটে কাঁথার নিচ থেকে বের হতে ইচ্ছে করে না। মা তাড়া দেন, ‘ওঠ!’ না উঠলে বকুনি। বকা খেয়ে আট বছরের আইরিন উঠে পড়ে।


তাকে আর কাঁথা ধরে রাখতে পারে না। অনিচ্ছায় বিছানা ছেড়ে ওঠা, আলস্য ভাব। মুখে বিরক্তি। অনেক দিন ওই বকুনিতে কেঁদে ফেলে। মুখ না ধুয়ে, দাঁত না মেজে খালি পা কুঁচকে কুঁচকে সে চলে যায় সাত-বছুরে শিরিনার বাসায়। ডাকে, ‘ওই শিরিনা, ওটছোস! খ্যাতে যাবি না? শিরি! কিরে জালা (বোরো ধানের চারা) তোলতে যাবি না? আমি গেলাম গিয়া!’
শিরিনার ঘর বলতে পাখির বাসা। তবে তা বাবুই পাখির বাসার মতো শৈল্পিক মজবুতভাবে তৈরি নয়। কাকের বাসার মতো দুর্বল হোগলা পাতার বেড়া, নাড়া-কুটার (ধানগাছ) ছাউনি। হোগলা পাতার বিছানা। বাতাস আসা-যাওয়া করে। ঠান্ডায় পাতা বিছানা মাটির বিছানায় হয় পরিণত। আইরিনের ডাক শুনে শিরিনা উঠে আসে চোখ ডলতে ডলতে। শিরিনার বাড়ির পাশেই আরিফ হোসেন, ঝুমি, সোহাগ ও নাসিমাদের ঘর। সবারই বাস দারিদ্র্যসীমার নিচে। বাবা শ্রমিক। দিনমজুর। মা শাক, লতাপাতা কুড়ায়। এই শিশুদের এ বয়সে ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করে, হাত-মুখ ধুয়ে নাশতা সেরে মক্তবে নয়তো কিন্ডারগার্টেনে যাওয়ার কথা। নয়তো বসার কথা পড়ার টেবিলে। কিন্তু ওই ছয়টি শিশু এগুলো কিছুই করে না। তারা ঘুম থেকে উঠে কাজ করতে চলে যায় খেতে ।
এতটুকু শিশু খেতে আবার কী কাজ করে? তারা তো লাঙল ধরতে পারে না, যে হালের বলদের লেজ ধরে ‘ঠাই ঠাই’ করবে, হাতে থাকবে পাঁচন। পারে না ট্রাক্টর চালানোর কাজ, যে ব্রেক কষে ডানে-বাঁয়ে করে খেতটা মুহূর্তেই চষে ফেলবে। তারা সহজ কাজটিই করে। সেটা হচ্ছে বোরো ধানের বীজতলা থেকে ধানের চারা তোলা। আর প্রতিদিন তাই ভোর-বিহানে মা-বাবার বকুনি খেয়ে তারা ঘুম থেকে ওঠে। তাদের মধ্যে কথা আছে, যে ঘুম থেকে আগে উঠবে, সে সবাইকে জাগাবে।
আইরিন, আরিফ, সোহাগ, শিরিনা, ঝুমি ও নাসিমার বাড়ি ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার রসুলপুর ইউনিয়নের শশীভূষণ গ্রামে। ভালো করে বুঝে ওঠার পর থেকে তারা সংসারের জন্য শ্রম দিয়ে আসছে। বর্ষা ও শীত মৌসুমে তারা বীজতলা থেকে ধানের চারা তোলার কাজ করে। স্থানীয় ভাষায় ধানের চারাকে জালা বলে। তারা দিনমজুরিতে কাজ করে না। মালিকপক্ষ খুবই চতুর। দিনমজুরিতে কাজ করাতে দুবেলা খাইয়ে ২০০ টাকা দিতে হয়। একজন বয়স্ক মজুর যে কাজ করবে, তা যদি শিশুশ্রমিককে দিয়ে করানো যায় এবং খরচ যদি আরও কম লাগে, তবে শিশুশ্রমিকই ভালো। এখানে টেকনিক একটু আলাদা। এ জন্য মুঠি চুক্তিতে ধানের চারা ওঠায় শিশুশ্রমিকেরা। ১০০ মুঠি ৩০ টাকা। মুঠি মানসম্পন্ন হতে হবে। আরিফ হোসেন বলে, ‘মুডা ছোডো অইলে হেইডা ইসাবে (হিসাব) দরে না (ধরে না) মহাজন। হ্যার লাইগ্যা মুডা ছোডো কইর্যা লাব (লাভ) নাই।’
কুয়াশাঢাকা ভোরবেলায় যখন ওই ছয় শিশুকে দেখেছি, তখন সাড়ে পাঁচটা কি ছয়টা। ফিরতি পথে আবার দেখলাম। তখন সকাল আটটা। তখনো তারা কিছু খায়নি। ১০টার দিকে তাদের জন্য পানি-পান্তা কিছু আসবে।—জানাল সবচেয়ে খুদে শ্রমিক নাসিমা। আবার বলল, ‘অনেকসুম একলগে দুরপে বাড়িত গিয়া খাই।’ অনেকক্ষণ তাদের চারা তোলা দেখে বোঝা গেল, ধানের চারা তোলাও কম কঠিন নয়। দু-একটা করে তুলতে হয়। অনেকগুলো জড়ো করে মূল থেকে মাটি ছাড়াতে হয়। প্রত্যেকের সঙ্গে একটি বাঁশের চিকন কাঠি আছে। ওই কাঠি দিয়েই মাটি ছাড়ানো হয়। মাটি ছাড়াতে হবে সাবধানে। যেন মূল বেশি ছিঁড়ে না যায়। বেশি ছিঁড়লে মহাজনের বকুনি। মাটি ছাড়িয়ে পাশে রাখে। এক মুঠি পরিমাণ হলে সামনে রাখা ধানগাছের শুকনো রশি দিয়ে মুঠি বাঁধা হয়। শিরিনা জানাল, ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত তারা প্রত্যেকে ৮০-৯০ মুঠি তুলতে পারে। যেদিন স্কুল থাকে না, সেদিন দুবেলা এ কাজ করে। সেদিন দেড় শ মুঠিও তুলতে পারে। সেদিন বেশি আয়।
কোন স্কুলে পড়ো? জানতে চাইলে ওরা সবাই জানাল, তারা ব্র্যাক স্কুলের প্রথম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রী। সারা দিন কাজ সেরে বিকেলে পড়তে যায়। ধানের চারা তোলার কাজ ছাড়াও বছরে তারা মরিচ, খেসারি ও মুগ তোলার কাজ করে। সেখানেও একই নিয়মে মজুরি। তবে নগদ টাকা নয়, তুলে দেওয়া শস্যের একটি অংশ পায়। ধান কাটার সময় তাদের কাজ থাকে না। ঝুমি বলে ওঠে, ‘হেসুম দান (ধান) কুরাই, য্যা পাই হেইডাই লাব!’ তারা লাভ-লস খুব ভালো বুঝে ফেলেছে বোঝা যায়।
ভোলার চরফ্যাশনে উন্নয়নের জোয়ার বইছে। বাতাসের মতো এ খবর ভোলাবাসীর কানে কানে। কিন্তু রসুলপুর ইউনিয়নের শশীভূষণ গ্রামে ঢুকতে এবড়োখেবড়ো মেঠোপথ আমাদের হাঁটতে বাধ্য করল। তবে চারদিকে অসাধারণ দৃশ্য। নীল আকাশ। দেশি পাখিদের অবাধ সমাগম। বিশেষ করে বক, শালিক আর চড়ুইয়ের ফুড়ুত-ফাড়ুত ঝাঁক বেঁধে উড়ে চলা যে কারও জন্য অপূর্ব দৃশ্য। চারদিকে সবুজ-ধূসর ধানের খেত। কৃষকেরা কেউ ট্রাক্টরে, কেউ গরুতে জমি চষে শক্ত মাটি গুঁড়ো করছেন। গুঁড়ো মাটি থেকে বের হচ্ছে পোকা-কেঁচো। সে পোকা খাওয়ার জন্য ঝাঁক ঝাঁক বক ওড়ে হালের গরু আর ট্রাক্টরের আশপাশে। চষা মাটিতে কেউ সেচ দিয়ে মই দিচ্ছে খেতের বুক সমান করতে। তার ওপরে ধানের চারা সার সার রোপণ করছে। সেখানেও শিশু শ্রম বেচে কিনে আনে অন্ন।

No comments

Powered by Blogger.