মিসর-সেনাবাহিনী কি জনগণের পক্ষে কাজ করবে? by টম পোর্টেয়াস

মিসরে দৃশ্যত সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসছে। দোকানপাট আবার খুলেছে, ধুলোবালি আবার হয়ে উঠছে শ্বাসরুদ্ধকর, জনজীবনের কোলাহল যেন আবার কানে তালা লাগিয়ে দিচ্ছে। সড়কের মহাযানজট এড়াতে মোটরসাইকেল চালকেরা ফুটপাতের ওপর দিয়ে চলার বিপজ্জনক অভ্যাস ফিরে পেয়েছে আবার।


শনিবার আমি বাব এল-লুক এলাকায় হুরিয়াত ক্যাফেতে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলাম। এক সপ্তাহ আগেই ওই এলাকায় হোসনি মোবারকের ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির ভাড়াটে গুন্ডাদের সঙ্গে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল বিক্ষোভকারী জনতা।
সেই বৈপ্লবিক মুহূর্তের আশাবাদ এখনকার পরিবেশেও অটুট রয়েছে। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের পদত্যাগে মিসরের জনগণ আনন্দে-উল্লাসে কলরব করেছে, সেই উদ্যাপনের রেশ চলেছে পরের কয়েক দিন ধরে। স্বৈরশাসককে পদত্যাগে বাধ্য করায় এই সাফল্য মিসরীয়দের মনকে ভরিয়ে তুলেছে আত্মশক্তি আবিষ্কারের আনন্দে, সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় উদ্দীপিত হয়ে উঠেছে তারা।
কিন্তু বাইরের এসব দৃশ্যপটের গভীরে প্রকৃত পরিস্থিতি মোটেও স্বাভাবিক নয়। বিক্ষোভকারীদের বিজয়ের মধ্য দিয়ে এক রাজনৈতিক শূন্যতাও সৃষ্টি হয়েছে, দেখা দিয়েছে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনিশ্চয়তা ও শঙ্কা। এই শূন্যতা এখন পূরণের চেষ্টা চলছে দুটি অসম ও অনিচ্ছুক পক্ষের দ্বারা, যারা অস্বস্তি ও সংশয়-সন্দেহ সত্ত্বেও পরস্পরের অবস্থান মেনে নিয়ে সহাবস্থানে সম্মত হয়েছে।
এক দিকে আছে সর্বোচ্চ সামরিক পরিষদ (সুপ্রিম মিলিটারি কাউন্সিল), যার সদস্যদের অধিকাংশই ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা, যাঁদের বয়স অবসর গ্রহণের কাছাকাছি চলে এসেছে। মিসরের জনগণের সঙ্গে তাঁরা এখন যোগাযোগ করছেন প্রাত্যহিক সামরিক ইশতেহার, রাষ্ট্রীয় বেতার ও টেলিভিশনের মাধ্যমে।
অন্য দিকে আছে প্রতিবাদী বিক্ষোভকারী যুবসমাজ, গণমাধ্যমের সচেতন কর্মীরা এবং রাজনৈতিকভাবে সৃজনশীল জনগোষ্ঠী, যাঁরা মানবাধিকারের প্রতি মর্যাদার ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত সর্বজনীন গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নির্মাণের পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাদের এই জন-অভ্যুত্থান যেমন একটি প্রজন্মগত বৈপ্লবিক পরিবর্তনকে দৃশ্যমান করেছে, তেমনই একটি রাজনৈতিক রূপান্তরের ইঙ্গিতও বহন করছে। তারা জনগণকে তাদের কথাগুলো জানাচ্ছে স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষায় স্লোগান দিয়ে, আর ফেসবুক ও টুইটারের মাধ্যমে।
মিসরীয় সামরিক বাহিনী ও মিসরীয় সচেতন যুবসমাজ—এই দুটি মেরুর মধ্যকার সম্পর্কের টানাপোড়েন দৃশ্যমান হয়ে উঠল রোববার সকালে, যখন সামরিক পুলিশের দল কায়রোর তাহরির স্কয়ারে এসে চত্বরটিকে জনসাধারণের চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দিল এবং অবশিষ্ট বিক্ষোভকারীদের সেখান থেকে চলে যেতে বলল (প্রেসিডেন্ট মোবারক পদত্যাগ করার পর বিক্ষোভকারীদের অনেকে তাহরির স্কয়ার ছেড়ে চলে যায়, তবে বেশ কিছুসংখ্যক বিক্ষোভকারী সেখানে অবস্থান অব্যাহত রাখে এই বলে যে তাদের সব দাবি এখনো পূরণ করা হয়নি। গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্যে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে, এ বিষয়ে তারা সরকারের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট বক্তব্য দাবি করছিল।) কিন্তু বিক্ষোভকারী যুবসমাজ সেখান থেকে চলে যেতে অস্বীকৃতি জানালে সামরিক পুলিশের সঙ্গে তাদের বাগিবতণ্ডা শুরু হয়। হইচই শোরগোল চলে কয়েক ঘণ্টা ধরে এবং অবশেষে সামরিক পুলিশ সেখান থেকে চলে যায়।
সেদিনই আরও পরের দিকে সামরিক ইশতেহার নম্বর ৫ প্রকাশ করা হলো: জানানো হলো সংবিধান স্থগিত করা হয়েছে এবং পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়া হয়েছে। বিক্ষোভকারীদের অনেকে এবং তাঁদের সমর্থকেরা দুটি পদক্ষেপকেই স্বাগত জানাতে পারে, কারণ এই সংবিধান ও এই পার্লামেন্টকে তারা মনে করে মোবারক-যুগের দূষিত পদার্থের মতো।
সবকিছু মিলিয়ে মনে হচ্ছে, যানবাহন চলাচলের চাপ ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ার ফলে তাহরির স্কয়ারে বিক্ষোভকারীদের শারীরিক অবস্থান যদি আরও কমে যায়, তবু বিক্ষুব্ধ জনতা ও সামরিক বাহিনীর মধ্যকার রাজনৈতিক দূরত্ব সামনের মাসগুলোতেও থেকে যাবে।
কিন্তু নিপীড়নমূলক মোবারক-যুগ থেকে (কতটা নিপীড়নমূলক, তা বেশ ভালোভাবেই দেখা গেছে গত কয়েক সপ্তাহে বিক্ষোভকারী জনতার ওপর চালানো সহিংসতার মধ্য দিয়ে) বেরিয়ে এক নতুন গণতান্ত্রিক যুগে মিসরের প্রবেশ ঘটবে—এটা কোনোভাবেই নিশ্চিত নয়। কারণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে সামরিক বাহিনীর প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করার পরেও মিসরের অনেক মানুষ এমন আশঙ্কা করছেন যে এই নতুন সামরিক শাসকেরা সেই পুরোনো শাসনযন্ত্রেরই স্বার্থরক্ষা করে চলবে। তাঁদের এই আশঙ্কার সংগত কারণও রয়েছে। তা ছাড়া, সংবিধান স্থগিত করা ও পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার ফলে সর্বোচ্চ সামরিক পরিষদ এখন দেশ শাসন করবে আনুষ্ঠানিক কোনো জবাবদিহি ছাড়াই।
অবশ্য প্রতিবাদী যুবসমাজ জানে তাদের সামর্থ্য কতটা। গণতান্ত্রিক রূপান্তরের লক্ষ্যে তাদের দাবিদাওয়াকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না—এটা বুঝিয়ে জনগণকে তারা আবার রাজপথে নামাতে কতটা সক্ষম তার কিছুটা প্রমাণ তারা সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতায় পেয়েছে। তারা জানে, সামরিক ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার একমাত্র কার্যকর ক্ষমতা রয়েছে কেবল জনগণের হাতে।
নিপীড়নমূলক স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে গণতন্ত্রে রূপান্তরের লক্ষ্য অর্জনের জন্য অবশ্য অনেক কাজ করা বাকি রয়ে গেছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, আটক ব্যক্তিদের মুক্তি দেওয়া, বর্বর নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা পরিহার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, জনসমাবেশের স্বাধীনতা ইত্যাদি সম্পর্কে সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে পরিষ্কার অঙ্গীকার, কথায় ও কাজে সেসব অঙ্গীকারের প্রতিফলন—বর্তমান পরিস্থিতিতে এগুলোই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ব্যাপক জনসমর্থনপুষ্ট এই গণতান্ত্রিক আন্দোলন এসব অঙ্গীকার দাবি করছে। অন্তর্বর্তীকালীন সামরিক কর্তৃপক্ষ যদি অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায়, তবে তাদের পক্ষ থেকে এই অঙ্গীকারগুলো প্রকাশ ও পূরণ করা অত্যন্ত জরুরি। এ ধরনের অঙ্গীকার এই ঝুঁকিপূর্ণ সামরিক শাসন চলাকালে জনগণের আস্থা অর্জনে ও সমাজে স্থিতিশীলতা রক্ষায় সহায়ক হবে। আমরা আশা করতে চাই, পরবর্তী সামরিক ইশতেহারে মানবাধিকার রক্ষা ও ক্ষমতা ব্যবহারে জবাবদিহি সম্পর্কে কিছু সত্যিকারের অঙ্গীকার থাকবে।
ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মশিউল আলম
টম পোর্টেয়াস: হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর লন্ডন কার্যালয়ের পরিচালক। ২৫ বছর সাংবাদিকতা করেছেন, একসময় কায়রোতেও ছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.