আজ-কাল-পরশু-তাঁকেই সব বিষয়ে কথা বলতে হবে কেন? by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর

গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে বাগ্যুদ্ধ হবে, সেটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের রাজনীতিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘গণতান্ত্রিক রাজনীতি’ বলা হলেও বাস্তবে তা মোটেও ‘গণতান্ত্রিক’ নয়। গণতন্ত্র ও সংসদীয় গণতন্ত্রের বেশির ভাগ শর্তই আমাদের সরকার বা প্রধান দলগুলো পূরণ করে না।


এ ব্যাপারে তীব্র কোনো অভিযোগ ও সমালোচনা চোখে পড়ে না। অন্যান্য রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও মিডিয়া কী এক অজ্ঞাত কারণে এই পরিস্থিতি মেনে নিয়েছে। মাঝেমধ্যে খুব সামান্য সমালোচনা শোনা যায়। দুই প্রধান দলের নেত্রী গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে যে আসলে ‘একনায়ক’, তা প্রায় সবাই অনুভব করলেও এটা নিয়ে খুব বেশি সমালোচনা শোনা যায় না।
আমাদের দেশের প্রত্যাশিত উন্নতি না হওয়া, কার্যকর সংসদ না হওয়া, সুশাসন প্রতিষ্ঠিত না হওয়া, নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা না পাওয়া, প্রশাসনকে দলীয়করণ করা এবং দেশের আরও নানা সমস্যার জন্য অনেকে অনেক কারণ চিহ্নিত করেন। কিন্তু দুই প্রধান দলের দুই নেত্রী একক কর্তৃত্বে দল ও সরকার পরিচালনাও যে এ জন্য অনেকটা দায়ী, তা তেমনভাবে আলোচনায় আসে না।
সীমিতভাবে হলেও দেশে একধরনের গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রয়েছে। গণতান্ত্রিক পরিবেশে দুই প্রধান দলের মধ্যে রাজনীতি ও সরকার পরিচালনা নিয়ে বাগ্যুদ্ধ হবে—এটা খুবই স্বাভাবিক। সারা পৃথিবীতেই হচ্ছে। পৃথিবীর দেশে দেশে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে বাগ্যুদ্ধ হচ্ছে। এর মধ্যে কেউ কোনো দোষ খুঁজে পায়নি। খুব ব্যতিক্রম ঘটনা ছাড়া।
আমাদের দেশের রাজনীতি ও সরকার প্রধানত দুটি দলের মধ্যে সীমিত হয়ে পড়েছে। আরও কয়েকটি দল রয়েছে, যারা সরকার গঠন ও পরিচালনাকে প্রভাবিত করতে পারে। প্রভাবিত করার চেয়ে বেশি শক্তি তাদের নেই। বাকি দলগুলো নেতাসর্বস্ব, প্যাডসর্বস্ব ও বিবৃতিসর্বস্ব। এতে তাদের আত্মসম্মানে কোনো ব্যাঘাত হয়নি। এসব নেতা কে কী বললেন, তা নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন কেউ মনে করেননি। পত্রিকা ও টিভির সাংবাদিক ছাড়া আর কেউ তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন না। সাংবাদিকেরা কেন তাঁদের গুরুত্ব দেন তা এক রহস্য।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সংসদে বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মধ্যে প্রায়ই বাগ্যুদ্ধ হয়ে থাকে। এটা গণতান্ত্রিক রাজনীতির অংশ। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে মাঝেমধ্যে সীমা ছাড়িয়ে যান। শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হলেও তাঁর একটা বড় সীমাবদ্ধতা হলো, তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী পদে বরিত হওয়ার পর রাজনৈতিক দলের পরিচয় আনুষ্ঠানিকভাবে রাখা সম্ভব হয় না, উচিতও নয়। কারণ, দেশের তুলনায় দল খুব ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান। প্রধানমন্ত্রী তখন ১৬ কোটি মানুষকে প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি সব বিরোধী দলকেও প্রতিনিধিত্ব করেন। দলীয় রাজনীতি, দলীয় বক্তব্য তখন প্রধানমন্ত্রীকে মানায় না—খুব বড় রাজনৈতিক বা সরকারের সংকট উপস্থিত না হলে। এ জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশে দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী এক ব্যক্তি হন না। দলের প্রধান নিত্যদিনের রাজনৈতিক বাগ্যুদ্ধে অংশ নিয়ে থাকেন, যা প্রধানমন্ত্রীকে মানায় না।
আমাদের প্রধান দুই দলে তা হতে পারেনি। কারণ, দুই নেত্রীর একনায়কসুলভ মনোভাব ও পারিবারিক উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া নেতৃত্ব (ও প্রধানমন্ত্রিত্ব) পাওয়ায় তাঁরা দলের অন্য নেতাদের ভেড়া বানিয়ে রেখেছেন। দুই দলেই স্তাবকের অভাব নেই। তাই কেউ জোর করে এ কথা বলতে পারছেন না, দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী এক ব্যক্তি না হওয়াই ভালো। দলের জন্য ভালো, সরকারের জন্যও ভালো।
এসব গণতান্ত্রিক আচরণে দুই নেত্রীই আগ্রহী নয়। তাঁদের এ কথা বোঝাবেন এমন ‘সাহসী নেতা’ দুই দলে একজনও নেই। কার ঘাড়ে দুটি মাথা? দুই দলের স্তাবক নেতারা দুই নেত্রীকে আধুনিককালের ‘হীরক রাজা’ বানিয়ে ছেড়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের পরম সুহূদ খ্যাতনামা কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী লিখেছেন: ‘জিহ্বাই শেখ হাসিনার পরম শত্রু।’ পরম সুহূদের কথায় শেখ হাসিনা কর্ণপাত করেননি। আমার লেখাকে যে তিনি কোনো গুরুত্ব দেবেন না, এ ব্যাপারে আমি এক শ ভাগ নিশ্চিত। তবু পাঠকদের অবগতিরর জন্য লিখে যাই।
দেশের রাজনীতিতে প্রতিদিন কত ছোট-বড় ঘটনা ঘটে। সব ঘটনা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীকে কথা বলতে হবে? বেশি কথা বললে একটু উল্টাপাল্টা কথা তো হতেই পারে। দেশের প্রধানমন্ত্রী উল্টাপাল্টা কথা বললে মানুষ তা পছন্দ করবে কেন? শেখ হাসিনা যদি শুধু আওয়ামী লীগের নেত্রী হতেন তাহলে কিছু উল্টাপাল্টা কথা লোকে সহ্য করে নিত। কিন্তু বেশি উল্টাপাল্টা কথা বললে ও প্রতিনিয়ত বললে জনগণ তা-ও সহজভাবে নিত না। এমনকি দলীয় লোকেরাও বিরক্ত হতেন। (হয়তো এখনো হচ্ছেন।)
প্রধানমন্ত্রী সরকার পরিচালনা করেন। সব মন্ত্রণালয়ের কাজের মধ্যে সমন্বয় করেন। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণে সহায়তা দেন। পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নে বড় ভূমিকা রাখবেন। বিদেশের রাষ্ট্রনায়ক, সরকারি প্রতিনিধি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে বাংলাদেশের জন্য দেনদরবার করবেন। প্রধানমন্ত্রীর কত কাজ। কত নীতিনির্ধারণী গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তিনি যদি সব বাদ দিয়ে, সব কাজ উপদেষ্টাদের ঘাড়ে চাপিয়ে নিজে দেশের দলীয় রাজনীতির দৈনন্দিন ঘাত-প্রতিঘাত সম্পর্কে মন্তব্য করতে থাকেন, জনসভা করতে থাকেন, রাজনৈতিক দলীয় সভা করতে থাকেন, তাহলে তাঁকে অন্য মন্ত্রণালয়ের মতো শুধু প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর দেখার জন্য একজন ‘উপদেষ্টা’ নিয়োগ দেওয়া দরকার।
দেশের ভবিষ্যৎ, উন্নয়ন ও নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়ন খুব কঠিন কাজ। এসব কাজের ভেতরে ডুবে যেতে হয়। শুধু সংবাদপত্র ও টিভির জন্য ফটোসেশন করলেই বড় উন্নয়নকাজ করা সম্ভব হয় না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদের চেয়ে আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর পদকে বড় করে দেখেন বলে মনে হয়। হয়তো তিনি ভুলে যান, সভানেত্রীর পদটা তিনি ‘ইচ্ছা’ করলেই আবার পাবেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর পদটা আবার পেতে অনেক আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজন হবে। আবার তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন কি না, এর এক ভাগ নিশ্চয়তাও কেউ দিতে পারবেন না। কিন্তু তিনি যত দিন খুশি দলের সভানেত্রী থাকতে পারবেন। কেউ তাঁকে সরাতে পারবেন না। অন্তত আওয়ামী লীগের বর্তমান দলীয় কাঠামোয় তা কখনো সম্ভব হবে না। কাজেই ‘সভানেত্রীর’ কাজটা তিনি সারা জীবন করতে পারবেন। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বটা এই পাঁচ বছর ভালোভাবে, মনোযোগের সঙ্গে করলে কি ভালো হতো না? এ সময়ে দলীয় রাজনীতি, প্রাত্যহিক রাজনৈতিক বাগিবতণ্ডা করার জন্য কিছু বাচাল লোক রাখলেই তো হয়। প্রধানমন্ত্রীকে কেন এই বাচালতায় অংশ নিতে হবে?
রাজনৈতিক মহলের ধারণা, প্রধানমন্ত্রী নিজের মুখে যা বলতে চান না তা তাঁর আস্থাভাজন কোনো নেতাকে দিয়ে বলান। এ জন্য মিডিয়ার কাছে সেই নেতার গুরুত্ব বেশি। সবাই জানেন, সেই নেতার কথা মূলত শেখহাসিনারই কথা। এই ধারণা যদি সত্য হয়, তাহলে আমি শেখ হাসিনার প্রশংসা করব। তিনি ঠিক কাজটি করেছেন।
অনেকে বলতে পারেন, ‘এসব রাজনৈতিক তর্কবিতর্ক তো দুই দলের মহাসচিবের মধ্যে হলেই মানানসই হতো। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ কেন একজন অধস্তন নেতাকে এত গুরুত্ব দিচ্ছে?’ এর ঠিক উত্তর আওয়ামী লীগই ভালো দিতে পারবে। তবে আমার ধারণা, এসব অরুচিকর কথা সৈয়দ আশরাফ হয়তো বলতে রাজি নন।
প্রতিদিনের রাজনৈতিক বাগিবতণ্ডা অনুগত কোনো নেতাকে দিয়ে করাতে পারলে প্রধানমন্ত্রীর জন্য মঙ্গল হবে। সরকারি নীতিগত বিষয় ছাড়া অন্য বিষয়ে পারতপক্ষে প্রধানমন্ত্রীর কথা না বলাই ভালো। সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর বাইরে দলও যে একটা বড় শক্তি, তা মানুষকে অনুভব করতে দিন। এতে আখেরে দলেরই লাভ হবে।
আওয়ামী লীগের সমর্থক কোনো পাঠক হয়তো বলতে পারেন, ‘প্রধানমন্ত্রী কখনো উল্টাপাল্টা কথা বলেন না।’ আমার ধারণা, আমাকে এই অভিযোগ প্রমাণ করতে হবে না। পত্রিকার বেশির ভাগ পাঠকই তা জানেন। সবার স্মৃতিশক্তি দুর্বল নয়। শুধু গত ১০ দিনের মধ্যে প্রচারিত একটি উদ্ধৃতি দিই। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর গুম হওয়ার ঘটনা নিয়ে সারা দেশ যখন তোলপাড়, তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, ‘বিরোধীদলীয় নেত্রী হয়তো আন্দোলনের ইস্যু তৈরি করতে ইলিয়াস আলীকে লুকিয়ে থাকতে বলেছেন।’ কী অদ্ভুত কথা!
কোনো গবেষক যদি আগ্রহী হন, গত এক বছরের পত্রিকা ঘেঁটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উক্তির একটি তালিকা প্রকাশ করতে পারেন। পাশাপাশি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং তাঁদের দেশের রাজনীতি নিয়ে কী ধরনের মন্তব্য করেছেন, তারও একটা তালিকা করা যেতে পারে। দুই তালিকা পাশাপাশি রেখে একটা বিশ্লেষণ হতে পারে। অবশ্য কোনো ক্ষেত্রেই দুই দেশের তুলনা করা উচিত নয়।
আমার ধারণা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উল্টাপাল্টা কথার একটা তালিকা করে দেখালে তিনি নিজেও বিব্রত হবেন। রাজনীতিতে উল্টাপাল্টা কথা যত কম বলা যায়, ততই ভালো। তবু যদি কিছু কাদা ছোড়াছুড়ি করতেই হয়, সেখানে অনুগত নেতারা তো রয়েছেনই। তাঁদের কাজে লাগান। ‘প্রধানমন্ত্রী’ পদটি খুব সম্মানীয় ও গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিটি মন্তব্য ওজনদার হওয়া বাঞ্ছনীয়। সব ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য করার প্রয়োজন নেই।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।

No comments

Powered by Blogger.