যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যারা প্রতিহত করতে চায় তারাও অপরাধী by এ এন রাশেদা

আমারা অতিক্রম করলাম বিজয়ের ৪০ বছর। সময়টি একেবারে কম নয়। আমাদের অনেকের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনা। ১৯৭১-এর ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চের ভয়াল রাত- কামান, গোলা, মর্টারের মুহুর্মুহ শব্দ, গগণবিদারী স্লোগান, চিৎকার, তার পর কবরের নিস্তব্ধতা। মার্চ ২৭ তারিখ থেকে ঢাকাত্যাগী মানুষের কাফেলা।


রাজারবাগ পুলিশ লাইনে মেয়েদের ওপর পাশবিক নির্যাতন, ক্রমান্বয়ে গ্রামগঞ্জে, রাজাকার বাহিনীর লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, ব্রাশফায়ারে হত্যা, কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা, দিনের পর দিন নির্যাতন করে হত্যা- ৯ মাস ধরেই যা চলেছিল।
আর একদিকে ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ, ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকার গঠন, বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী, জেনারেল ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি এবং অন্যদের নানা দায়িত্ব দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা- আজ কলমের এক খোঁচায় যত সহজভাবে লেখা গেল; ১৯৭১ সালে ওই সময় তা তেমন ছিল না। পদে পদে বাধা-বিঘ্ন ও প্রচুর রক্তক্ষরণের মধ্য দিয়ে তা সাধিত হয়েছে। সাধিত হয়েছে সমগ্র জাতির মুক্তির অদম্য বাসনা, সাহস, নিরন্তর নতুন পথ খোঁজা ও বন্ধুর পথ চলার মধ্য দিয়ে। ৯ মাস কোনো কুসুমাস্তীর্ণ পথ ছিল না। যুদ্ধকালীন ভারতের আশ্রয় দান, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বব্যাপী জনমত গঠন, সোভিয়েত ইউনিয়নের জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ, সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো এবং তাদের কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর সমর্থন- এসবই ছিল আমাদের বিজয়ের কারণ।
১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট একটি স্বাধীন দেশ গড়ে তোলার জন্য যথেষ্ট তো নয়, তাও আবার যুদ্ধবিধ্বস্ত। পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের বহু কিছু ধ্বংস করেছিল, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়েছিল। পুড়িয়েছিল কারেন্সিও। তাই এই যুদ্ধবিধস্ত দেশকে পুনর্গঠিত করতে প্রথমেই টাকা ছাপানো, যোগাযোগব্যবস্থার পুনর্গঠন, স্কুল-কলেজ ও পুড়িয়ে দেওয়া বাসস্থান মেরামত, নির্যাতিত নারীদের চিকিৎসাসেবা দান কার্যক্রম, যুদ্ধসন্তানদের দত্তক দান, তাদের পুনর্বাসন, সারা বিশ্বের স্বীকৃতি আদায়- অত সহজ ছিল না। তারপর যুদ্ধাপরাধী-মানবতাবিরোধী শক্তি রাজাকার-আল বদর-আল শামসদের গ্রেফতার ও বিচার প্রক্রিয়া শুরু- সবই তো হচ্ছিল। ২১ হাজার যুদ্ধাপরাধী বন্দি ছিল। ৭৩টি আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল; একজনের ফাঁসিও কার্যকর হয়েছিল। কিন্তু ওই ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করে স্বাধীন দেশের অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক পথের যাত্রাকে রুদ্ধ করে পাকিস্তানি ধ্যান-ধারণা প্রতিষ্ঠায় সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। সামরিক বাহিনীর আইন লঙ্ঘন করে চাকরিতে থাকা অবস্থায় রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন। ভুয়া হ্যাঁ-না ভোটের আয়োজন করে ৯৮ শতাংশ ভোট প্রদান দেখানো হয়েছিল। সারা বিশ্বেই যার নজির আজও বিরল। জিয়াউর রহমান সব রাজাকারকে যেমন মুক্তি দিয়েছিলেন, তেমনি ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার অধিকার দিয়েছিলেন, যা ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী পাকিস্তানি ধারণাপ্রসূত। জেনারেল জিয়া প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপদমর্যাদায় তাদের বসিয়েছিলেন আর মুক্তিযোদ্ধাদের জেলে প্রেরণ করেছিলেন। যে জাসদ তাঁকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল সেই জাসদনেতা কর্নেল তাহেরকে প্রহসনমূলক বিচার করে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়েছিলেন। আর তাঁর প্রতিষ্ঠিত সেই দলটি তো সেনাবাহিনীর গর্ভ থেকেই ভূমিষ্ঠ হয়েছিল। তাই সে দলের চেহারাও গণতান্ত্রিক না হয়ে একনায়কোচিত হয়েছিল। জিয়াউর রহমান আরো এক প্রহসনের নির্বাচন করেছিলেন ১৯৭৯-এর ফেব্রুয়ারিতে, যেখানে আওয়ামী লীগকে ৪০টি আসন দেওয়া হয়েছিল। কাজেই নির্বাচনে কিভাবে কারচুপি হয়, করা যায় বা তাকে প্রহসনে পরিণত করা যায় তা জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত দলের নেতাদের ভালো করেই জানা। তাই দেখা যায় অনবরত তাঁরা তাঁদেরই মনগড়া কথাগুলো অবলীলায় বলে চলেছেন, যা বিবেকবান মানুষদের আহত করে চলেছে।
আমরা যারা জিয়াউর রহমানের শাসনামল দেখেছি, তা ছিল রীতিমতো কলঙ্কজনক অধ্যায়। তিনি ক্ষমতা দখল করে জেল থেকে ছেড়ে দিলেন সাত খুনের আসামি যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত শফিউল আলম প্রধানকে। জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিদেশে চলে যেতে সাহায্য এবং বিদেশি দূতাবাসে চাকরি দিয়েছিলেন। আর রাজাকার শিরোমনি শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রীর পদে বসিয়েছিলেন, রাজাকার আবদুল আলীমকে শিল্পমন্ত্রী এবং রাজাকার মাওলানা মান্নানকে শিক্ষামন্ত্রীর পদে বসিয়েছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে বেগম খালেদা জিয়া জামায়াতে ইসলামের আমীর রাজাকার নেতা মতিউর রহমান নিজামীকে শিল্পমন্ত্রী ও আল বদর বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা মুজাহিদকে সমাজকল্যাণমন্ত্রীর পদে বসিয়ে বাংলাদেশের পতাকা তাদের গাড়িতে তুলে দিয়েছিলেন। চট্টগ্রামের কুখ্যাত রাজাকার পরিবারের রাজাকার সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ওরফে সাকা চৌধুরীকে রাজনৈতিক উপদেষ্টা বানিয়েছেন।
১৯৭১-এ ৩০ লাখ শহীদের এক সাগর রক্তের বিনিময়ে যা কিছু অর্জিত হয়েছিল, মেজর জিয়াউর রহমান তা বিসর্জন দেওয়া শুরু করেছিলেন। সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে। তাই তাদের পক্ষ থেকে আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রতিহত করার সব ষড়যন্ত্র হবে- এটাই স্বাভাবিক। প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রতিহতের দাবিতে তারা যা বলছে, টিভি চ্যানেলগুলো ২৪ ঘণ্টা ধরে তা প্রচার করছে। বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে প্রশ্ন আসে, বর্তমানে যাদের বিচার কার্যক্রম শুরু হয়েছে, তারা কি তাহলে প্রকৃত যুদ্ধাপরাধী নয়? আর নিরপেক্ষ ট্রাইব্যুনাল হবে কিভাবে? রাজাকারদের সন্তানদের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিলে? আজ যারা এসব চিহ্নিত ঘৃণীত অপরাধীর পক্ষ নিয়েছে ইতিহাস তাদেরকে ক্ষমা করবে না। এরাও সমভাবে ঘৃণিত হবে। কবির ভাষায় :
'অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে/তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।'

লেখক : শিক্ষা গবেষক

No comments

Powered by Blogger.