ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার প্রতিবাদে বিএনপির হরতাল-হরতালে সারা দেশে সহিংসতা

বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষ, পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার মধ্য দিয়ে গতকাল মঙ্গলবার সারা দেশে হরতাল পালিত হয়েছে। হরতালের সময় ও আগের দিন সোমবার রাতে অর্ধশত বাস, ট্রাক, মোটরসাইকেল, টেম্পো, অটোরিকশা ভাঙচুর করেছে হরতাল-সমর্থকেরা। পুড়িয়েছে নয়টি যানবাহন।


তএসব ঘটনায় সারা দেশে বিএনপি ও জামায়াতের ১২৪ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার ও আটক করেছে পুলিশ। সংঘর্ষ ও পুলিশের লাঠিপেটায় আহত হয়েছে ১৫১ জন।
প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক, আঞ্চলিক কার্যালয় ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:
কেরানীগঞ্জ (ঢাকা): সকাল সাড়ে নয়টার দিকে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া এলাকায় মিছিল বের করেন। একপর্যায়ে তাঁরা দুটি বাসসহ আটটি গাড়ি ভাঙচুর করেন। এ সময় পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে তাঁদের বাধা দিলে উভয় পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত ১৫ জন আহত হয়। দুপুর দুইটার দিকে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা আবারও একই স্থানে তিনটি গাড়ি ভাঙচুর করেন। পরে পুলিশ ধাওয়া করলে তাঁরা পালিয়ে যান।
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক অর্পণা রায় অভিযোগ করেন, পুলিশের সহায়তায় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা শুভাঢ্যা ইউনিয়ন বিএনপির একটি কার্যালয়ে ইটপাটকেল ছোড়ে ও ব্যানার-পোস্টার ছিঁড়ে ফেলেন। এ ছাড়া তাঁরা শুভাঢ্যা ইউনিয়ন ছাত্রদলের নেতা মো. ইকবালের মালিকানাধীন দোকান ভাঙচুর করে লক্ষাধিক টাকার মালামাল লুটপাট করে। এ সময় দোকানে থাকা সাদ্দাম (২২) নামের একজনের মাথা রড দিয়ে ফাটিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁকে গুরুতর অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
টঙ্গী (গাজীপুর): সকাল সাতটার দিকে টঙ্গীর চেরাগআলী থেকে কলেজগেট এলাকায় বিএনপির কর্মীরা এলোপাতাড়ি ইটপাটকেল ছুড়ে অন্তত ২০টি বাস, টেম্পো, মিশুক, রিকশা ভাঙচুর করেছেন। পরে পুলিশ লাঠিপেটা করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এসব ঘটনায় অন্তত ৩০ জন যাত্রী ও হরতাল-সমর্থক আহত হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে বিএনপির চার কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ ছাড়া যুবদলের নেতা শহিদুল ইসলাম, সোহেল সিদ্দিকীসহ ছাত্রদল-তাঁতী দলের আরও চার নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে টঙ্গী মডেল থানার পুলিশ।
বরিশাল: সোমবার রাত ১১টার দিকে বরিশাল নগরের নথুল্লাবাদ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে হিমেল-হীরক নামের একটি বাসে অগ্নিসংযোগ করে হরতাল-সমর্থকেরা। ওই সময় বাসে ঘুমিয়ে ছিলেন বাসচালকের সহকারী মো. সোহেল। তিনি বলেন, ‘হঠাৎ আগুন জ্বলতে দেখে ঘুম ভেঙে যায়। সঙ্গে সঙ্গে জানালার গ্লাস ভেঙে বের হয়ে আসি।’
পরে ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। ওই রাতে নগরের সিঅ্যান্ডবি রোডের ইনফ্রা পলিটেকনিক কলেজের সামনে থামানো একটি ট্রাকে আগুন দেয় হরতাল-সমর্থকেরা। এদিকে গতকাল দিনভর নগরের বিভিন্ন স্থানে একটি বাস, একটি টেম্পো ও একটি রিকশায় ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করে হরতাল-সমর্থকেরা।
এ ছাড়া গতকাল দুপুরে নগরের বটতলা এলাকায় জেলা বিএনপি বিক্ষোভ মিছিল বের করলে তাদের ওপর হামলা চালান পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মীরা। এতে অন্তত পাঁচজন আহত হন।
রাজশাহী: গতকাল নগরের কয়েকটি ভবন ও গাড়িতে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে কাচ ভাঙচুর করে বিএনপির কর্মীরা। রাজশাহী কলেজের সামনে ও লক্ষ্মীপুর মোড়ে দুটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। সকাল ছয়টার দিকে মহানগরের কাদিরগঞ্জে সরকারি মহিলা কলেজের সামনে হরতাল-সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। নগরের বিভিন্ন স্থান থেকে বিএনপির ১১ কর্মীকে আটক করে পুলিশ। সকাল নয়টার দিকে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও মহানগর সভাপতি মিজানুর রহমান দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে গ্রেপ্তার হওয়া নেতা-কর্মীদের মুক্তি, তাঁদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার প্রত্যাহার, গভীর রাতে নেতাদের বাড়িতে তল্লাশির প্রতিবাদ জানান।
টাঙ্গাইল: হরতাল-সমর্থকেরা সকালে টাঙ্গাইল প্রেসক্লাবের সামনে ও তালতলা এলাকায় সিএনজিচালিত দুটি অটোরিকশা পুড়িয়ে দেয়। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের নগরজালফৈ ও ঢাকা-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে টাঙ্গাইল শহর বাইপাসে পিকআপভ্যান ও অটোরিকশাসহ ছয়-সাতটি যানবাহন ভাঙচুর করেছে।
মির্জাপুর (টাঙ্গাইল): মির্জাপুরে মিছিলে লাঠিপেটা করলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে বিএনপির নেতা-কর্মীরা। পুলিশ দুটি কাঁদানে গ্যাসের শেল ও প্রায় ২৫টি শটগানের গুলি ছোড়ে। এসব ঘটনায় বিএনপির সাবেক সাংসদ আবুল কালাম আজাদ সিদ্দিকী ও মির্জাপুর থানার ওসি গোলাম মোস্তফাসহ অন্তত ৭০ জন আহত হয়েছে। তিনজনকে আটক করেছে পুলিশ।
ঝালকাঠি: গতকাল সকালে জেলার কাঠালিয়া উপজেলা জামায়াতের সেক্রেটারি নাসির উদ্দিনকে তাঁর বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। রাতে ঝালকাঠি-পিরোজপুর আঞ্চলিক মহাসড়কের ইছানীল স্কুলের সামনে হানিফ পরিবহনের একটি বাস ভাঙচুর করে হরতাল-সমর্থকেরা। ওই ঘটনায় জেলা বিএনপির কার্যালয় থেকে যুবদলের দুই নেতাকে আটক করেছে র‌্যাব। গতকাল সকালে রাজাপুর থেকে ছাত্রদলের তিন নেতা ও নলছিটি থেকে শ্রমিক দলের দুই নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
বগুড়া: জেলার কাহালু উপজেলা সদরে গতকাল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে পুলিশ কর্মকর্তাসহ পাঁচজন আহত হয়েছেন। এ সময় উভয় পক্ষের চার-পাঁচটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর এবং বিএনপির দুই কর্মীর মোটরসাইকেল হারিয়ে যায়।
ধুনট (বগুড়া): বগুড়ার ধুনট উপজেলায় সোমবার আওয়ামী লীগের নেতার ওপর হামলার জের ধরে দলের ক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা গতকাল উপজেলার এলাঙ্গী বাজারে বিএনপির নেতা-কর্মীদের নয়টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও মালামাল লুট করেছে। অপরদিকে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ছবি ভাঙচুর করায় উপজেলার সুরুগ্রামে বিএনপি-সমর্থিত গ্রামবাসীর সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ হয়েছে। এতে উভয় পক্ষের আটজন আহত হয়।
নেত্রকোনা: সোমবার রাত আটটার দিকে জেলা শহরের ছোট বাজারে হরতালবিরোধী মিছিল থেকে বিএনপি কার্যালয় ভাঙচুর করা হয়। হামলাকারীরা সদর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক আবদুল মোতালেব তালুকদারকে মারধর করে ডান হাত ভেঙে ফেলে। রাত সাড়ে আটটার দিকে ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী নেত্রকোনা বড় স্টেশন এলাকায় বিএনপির কর্মী মো. এনামুল হক খানের মক্কা মদিনা টেলিকম সেন্টার ভাঙচুর করেন।
ঠাকুরগাঁও: দুপুরে ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলায় আওয়ামী লীগের কর্মীদের সঙ্গে বিএনপির কর্মীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। তখন একটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করেন বিএনপির কর্মীরা।
নাটোর: নাটোরের নলডাঙ্গা থানা বিএনপির সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মো. আতিকুর রহমান তালুকদারকে লাঠি দিয়ে পিটিয়েছেন যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা। গতকাল দুপুর ১২টা দিকে বাসুদেবপুরে তাঁর নিজ বাড়ির সামনের চায়ের দোকানে এই ঘটনা ঘটে।
গাইবান্ধা: গতকাল দুপুরে জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলা শহরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষ হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ১০টি রাবার বুলেট ও একটি কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে। এ সময় পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালত তাঁদের প্রত্যেককে দুই দিন করে কারাদণ্ডাদেশ দেন। এদিকে জেলা শহরের ডিবি রোডের ফকিরপাড়া মসজিদের সামনে হরতাল-সমর্থকেরা একটি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ করে। শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে হরতাল-সমর্থক বিএনপির আট কর্মীকে আটক করেছে পুলিশ।
খাগড়াছড়ি: হরতাল-সমর্থক ও হরতালবিরোধীদের মধ্যে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে খাগড়াছড়ি সদরের কলাবাগান এলাকায় ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। ঘটনা নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ১২টি কাঁদানে গ্যাসের শেল ও ২৪টি রাবার বুলেট ছোড়ে।
বাগেরহাট: গতকাল সদর উপজেলার মেহগনিতলায় খুলনা-বাগেরহাট সড়ক ও দড়িতালুক স্থানে দুটি যাত্রীবাহী বাস ভাঙচুর করেছে হরতাল-সমর্থকেরা। বেলা ১১টার দিকে মোল্লাহাট বাজারের খান সুপার মার্কেটের নিচতলার টয়লেটের পাশ থেকে একটি টাইম বোমাসদৃশ বস্তু উদ্ধার করেছে পুলিশ। এ ব্যাপারে পুলিশ সুপার খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, পুলিশ বস্তুটি উদ্ধার করে পানিতে ভিজিয়ে রেখেছে। জেলা পুলিশে বোমা নিষ্ক্রিয় কাজে দক্ষ সদস্য নেই। তাই বস্তুটি বোমা কি না, তা এখনো পরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি।
ফরিদপুর: বেলা পৌনে ১১টার দিকে সদরের গেরদা ইউনিয়নের কেশবনগর এলাকায় ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক অবরোধ করে হরতাল-সমর্থকেরা। এ সময় তারা দুটি টেম্পো ভাঙচুর করে। পরে পুলিশ এলে অবরোধকারীরা পালিয়ে যায়। বিভিন্ন স্থান থেকে পুলিশ জেলা ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদকসহ ২১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এর আগে সোমবার রাত সাড়ে আটটার দিকে শহরের টেপাখোলা ও আলীপুর গোরস্থান এলাকায় দুটি ইজিবাইকে আগুন ধরিয়ে দেয় হরতাল-সমর্থকেরা।
নোয়াখালী: সকাল সাতটার দিকে শহরের দত্তবাড়ীর মোড়ে একটি ট্রাক ভাঙচুর করে হরতাল-সমর্থকেরা। সোমবার রাতে নোয়াখালী শহরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে বিএনপির ১৬ কর্মী-সমর্থককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এ ছাড়া কুড়িগ্রামে ১৫ জন, পাবনায় ১০ জন, গাজীপুরে সাতজন, দিনাজপুরে ছয়জন, নারায়ণগঞ্জে পাঁচজন ও চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় বিএনপি ও জামায়াতের এক নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

No comments

Powered by Blogger.