সারা দেশে হরতাল: দূরপাল্লার বাস চলেনি, যাত্রীদুর্ভোগ, ভাঙচুর, সংঘর্ষে বিভিন্ন স্থানে আহত ২২৩, আটক ২৩৪-বিএনপির সঙ্গে আ.লীগ-পুলিশ সংঘর্ষ

রাজশাহী, পটুয়াখালী, ঝিনাইদহ, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গতকাল সোমবার হরতাল-সমর্থক বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সংঘর্ষ হয়েছে। ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে।


ভাঙচুর করা হয়েছে অন্তত ১৭টি যানবাহন, পাঁচটি দোকান এবং একটি করে ছাপাখানা, খামার ও বাড়ি।
সংঘর্ষ ও পুলিশের লাঠিপেটায় আহত হয়েছেন বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ২২৩ নেতা-কর্মী। হরতালে আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ ও নাশকতার অভিযোগে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠন এবং জামায়াতে ইসলামীর ২৩৪ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
হরতাল চলাকালে দূরপাল্লার বাস চলেনি। রিকশা, অটোরিকশা, ইজিবাইক চললেও সংখ্যায় ছিল কম। ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক ছিল। ঢাকার বাইরে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক, আঞ্চলিক কার্যালয় ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:
রাজশাহী: সকাল ১০টার দিকে জেলা বিএনপির সভাপতি নাদিম মোস্তফার নেতৃত্বে নগরের মনি চত্বর থেকে হরতালের সমর্থনে মিছিল বের হয়। মিছিলটি কলেজিয়েট স্কুলের সামনে যেতেই পুলিশ পেছন থেকে লাঠিপেটা করে মিছিলকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এতে বিএনপির ১০ নেতা-কর্মী আহত হন। পরে তাঁরা সাহেববাজার জিরো পয়েন্ট এলাকায় সমবেত হওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশের লাঠিপেটায় আবার ছত্রভঙ্গ হন। সেখানে আহত হন পাঁচ নেতা-কর্মী।
এর আগে সকাল সোয়া ছয়টার দিকে হরতালের সমর্থনে বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে নগরের উপশহর এলাকা থেকে মিছিল বের হয়। মিছিলটি আমবাগান এলাকায় মৎস্য ভবনের সামনে পৌঁছালে পুলিশ বাধা দেয়। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে পুলিশ রাবার বুলেট ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে। এ ছাড়াও নগরের বিভিন্ন স্থানে হরতাল-সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশের বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ হয়। হরতালকারীরা বেশ কয়েকটি অটোরিকশা ও টেম্পো ভাঙচুর করে।
পটুয়াখালী: জেলার দশমিনা উপজেলার বহরমপুর ইউনিয়নের আমতলা বাজার এলাকায় গতকাল সকাল সাতটার দিকে হরতাল-সমর্থকেরা জোর করে দোকানপাট বন্ধ করতে গেলে যুবলীগ-সমর্থক কবির হোসেন মোল্লা বাধা দেন। হরতাল-সমর্থকেরা তাঁকে বেধড়ক পেটায়। এর জের ধরে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ এবং পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। আহত হন অন্তত ১৫ জন। সংঘর্ষের সময় পাঁচটি দোকান ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। পটুয়াখালী শহরে গতকাল হরতালের সমর্থনে মিছিল শেষে বাসায় ফেরার পথে জেলা শ্রমিক দলের সভাপতি মো. হারুন-অর-রশিদকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
ঝিনাইদহ: শহরে হরতালের পক্ষে-বিপক্ষে মিছিল করা নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে গতকাল ব্যাপক সংঘর্ষে উভয় পক্ষের অর্ধশতাধিক লোক আহত হয়েছে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে হরতালবিরোধী একটি মিছিল জেলা বিএনপির কার্যালয়ের সামনে গেলে এ সংঘর্ষ বাধে। একপর্যায়ে গোটা শহরে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কাঁদানে গ্যাসের ১৮টি শেল ছোড়ে। সংঘর্ষের সময় বেসরকারি টেলিভিশন এনটিভির চিত্রগ্রাহক সবুজকে পিটিয়ে তাঁর ক্যামেরা কেড়ে নেওয়া হয়। ভাঙচুর করা হয় দৈনিক অর্থনীতি পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি সাজ্জাদ আহমেদের মোটরসাইকেল।
মাগুরা: হরতাল-সমর্থকেরা সন্ধ্যা সাতটার দিকে শহরের পারনান্দুয়ালি সেতু এলাকায় পাঁচ-সাতটি গাড়িতে ইটপাটকেল ছোড়ে। এ সময় ইটের আঘাতে চার পুলিশ সদস্য আহত হন। পরে পুলিশ ১৮টি ফাঁকা গুলি ও পাঁচটি কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে হরতাল-সমর্থকদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
ধুনট (বগুড়া): উপজেলার এলাঙ্গী বাজারে গতকাল এলাঙ্গী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবদুল মজিদকে (৩৭) পিটিয়ে মাথা ফাটিয়ে দেয় বিএনপির নেতা-কর্মীরা। বিষয়টি জানতে পেরে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এলাঙ্গী ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমানের মুরগির খামার ও সদস্য মাজেম হোসেনের বাড়িঘর ভাঙচুর করেন। মজিদকে পেটানোর অভিযোগে পুলিশ এলাঙ্গী ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি নাজমুল হককে গ্রেপ্তার করেছে।
শিবগঞ্জ (বগুড়া): শিবগঞ্জে মহাস্থান সেতুর কাছে বগুড়া-রংপুর মহাসড়কে গত রোববার ভোরে চালবোঝাই ট্রাকে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ৩২ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন ট্রাকচালক। অগ্নিসংযোগের অভিযোগে পুলিশ স্থানীয় বিএনপির চার কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে।
শেরপুর (বগুড়া): জেলার শেরপুর বাসস্ট্যান্ডে গতকাল বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষে দুজন পুলিশসহ ১৮ জন আহত হয়েছে।
ঠাকুরগাঁও: সকাল নয়টার দিকে ঠাকুরগাঁও শহরের বঙ্গবন্ধু সড়কের আর্ট গ্যালারি মোড়ে পুলিশ বিএনপির নেতা-কর্মীদের লাঠিপেটা করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পুলিশের ধাওয়া খেয়ে জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের নেতা-কর্মীরা বঙ্গবন্ধু সড়কের একটি ভবনের দোতলার ছাদে যান। ঠাকুরগাঁও পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক তারেক আদনান অভিযোগ করেন, পুলিশ ওই সময় মহিলা দলের চার নেত্রীকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়। বর্তমানে তাঁরা ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
অভিযোগ অস্বীকার করে ঠাকুরগাঁওয়ের ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার নাহিদুল ইসলাম বলেন, পুলিশ ধাওয়া দিলে নারী কর্মীরা আত্মরক্ষার জন্য ছাদ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
বরিশাল: সকাল ছয়টার দিকে নগরের কালীবাড়ি সড়কে একটি অটোরিকশা পুড়িয়েছে হরতাল-সমর্থকেরা। একই সময়ে দপ্তরখানা সড়কে একটি পিকআপ ভ্যানে আগুন দেওয়া হয়। সকালে মহানগর ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ইয়াছির আরাফাতসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
রায়পুর (লক্ষ্মীপুর): উপজেলার রাখালিয়া এলাকায় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এতে পুলিশের এক এসআইসহ উভয় দলের অন্তত আটজন আহত হয়। এ ছাড়া উপজেলার কেরোয়ার জোড়পুল এলাকাসহ কয়েকটি স্থানে উভয় দলের কর্মীদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। এতে আরও চারজন আহত হয়। অপর দিকে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা রায়পুর পৌর ও উপজেলা বিএনপির কার্যালয়ে হামলা চালান।
রাঙামাটি: বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাঙামাটি শহরের কাঁঠালতলী এলাকায় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির রাঙামাটি জেলা সাধারণ সম্পাদক অনুপম বড়ুয়ার ছাপাখানা ভাঙচুর করে হরতাল-সমর্থকেরা। দুপুরে জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের সামনে কালিন্দীপুর মোড় ও কাঁঠালতলীর আলম ডকইয়ার্ড সড়ক মোড়ে হরতাল-সমর্থকদের ওপর ইটপাটকেল ও কাচের বোতল ছোড়েন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা। এ সময় সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে দুই পক্ষ। আহত হন উভয় পক্ষের ১০ কর্মী।
খাগড়াছড়ি: দুপুরে জেলার মহালছড়ি উপজেলার জয়সেন পাড়ায় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষে অন্তত ১৭ জন আহত হয়েছে। দুই দিনের হরতালে পুলিশ মোট ২০ জনকে আটক করেছে।
নারায়ণগঞ্জ: সকাল সাড়ে নয়টার দিকে বিএনপির নেতা-কর্মীরা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল মোড়ে হরতালের সমর্থনে মিছিল বের করলে পুলিশ বাধা দেয়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বাগিবতণ্ডা ও ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে পুলিশ লাঠিপেটা করে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এতে অন্তত ১০ জন আহত হয়। গ্রেপ্তার করা হয় যুবদলের দুজনকে। এর আগে সকালে নারায়ণগঞ্জ শহরের ২ নম্বর রেলগেট এলাকায় বিএনপির কার্যালয়ের সামনে সভা করার চেষ্টা করলে পুলিশ দুজনকে গ্রেপ্তার করে।
এদিকে রোববার রূপগঞ্জ উপজেলায় বাসে অগ্নিসংযোগ ও উপজেলা অফিসে হামলার অভিযোগে বিএনপির ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
গাজীপুর: গাজীপুর পৌরসভায় গতকাল বিকেলে বিএনপির সমাবেশ শেষে মিছিল করার চেষ্টাকালে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে দুই সাংবাদিক, পুলিশসহ অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছে। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে গাজীপুর শহরের বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এদিকে নাশকতা সৃষ্টির আশঙ্কায় রোববার রাতে জেলার জয়দেবপুর, টঙ্গী ও কাপাসিয়া এলাকা থেকে বিএনপির ২৮ জন নেতা-কর্মীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।
চাঁদপুর: জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার বর্ডারবাজার এলাকায় বেলা ১১টার দিকে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় ছয়জন আহত হন। কিছুক্ষণ পর হাজীগঞ্জ উপজেলায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কর্মীদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়।
কুষ্টিয়া: বেলা সাড়ে ১০টার দিকে কুষ্টিয়া সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে বিএনপি মিছিল বের করলে পুলিশ লাঠিপেটা করে নেতা-কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এতে অন্তত পাঁচ নেতা-কর্মী আহত হন।
ফেনী: ফেনী ও দাগনভূঁঞা থেকে গতকাল পাঁচ হরতাল-সমর্থককে আটক করেছে পুলিশ। ফেনীতে হরতাল-সমর্থক ও হরতালবিরোধীদের মধ্যে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষে ছাত্রলীগের তিন কর্মী আহত হয়েছেন।
নরসিংদী: শহরের বাজির মোড়ে বিএনপির মিছিলে পুলিশের লাঠিপেটায় জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সাংসদ খায়রুল কবিরসহ ২০ নেতা-কর্মী আহত হয়েছে। পিকেটিং করার সময় পুলিশ আট নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করে। এদিকে পলাশে হরতাল-সমর্থকেরা একটি মালবাহী ট্রাকে অগ্নিসংযোগ করে।
এ ছাড়া হরতালে আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ ও নাশকতার আশঙ্কায় রোববার রাতে ও গতকাল সকালে রাজবাড়ীতে ২২ জন, পাবনায় ১৮ জন, ফরিদপুর ও নোয়াখালীতে ১৬ জন করে, মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ ও কুলাউড়া উপজেলায় ছয়জন, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া ও কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে পাঁচজন করে, বরগুনার আমতলীতে চারজন এবং লালমনিরহাট ও নেত্রকোনার বারহাট্টায় বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠন এবং জামায়াতে ইসলামীর দুজন করে নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.