শিক্ষকদের শিক্ষা-শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা জরুরি হয়ে পড়েছে by সালমা আখতার

সম্প্রতি ‘সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব উইমেন’-এর নিজস্ব ক্যাম্পাস ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী প্রতিটি জেলায় একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছেন। কয়েক দিন আগে দেশে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।


বস্ত্রশিল্পের প্রসার, মানোন্নয়ন ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে এই বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানচর্চা ও সঞ্চালনের ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে বলে প্রত্যাশা করা যায়। উচ্চশিক্ষার জন্য অনেক ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কথা উচ্চারিত হলেও আজ পর্যন্ত শিক্ষক শিক্ষার জন্য ‘শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়’ বা ‘ইউনিভার্সিটি অব এডুকেশন’-এর প্রস্তাব কোথাও দেখা যায়নি। ‘সবার জন্য শিক্ষা’-এর লক্ষ্য অর্জনের নির্ধারিত সময়কাল এগিয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক এই অঙ্গীকারে আমরাও অংশীদার। ‘সবার জন্য শিক্ষা চাই’-এর সঙ্গে ‘মানসম্পন্ন শিক্ষা’ চাই আজকের বাংলাদেশে অত্যন্ত জোরালো দাবি। মানসম্পন্ন শিক্ষার বড় নিয়ামক হচ্ছেন শিক্ষক। উন্নত শিক্ষণ-শিখনের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হচ্ছে শিক্ষক তথা ভালো বা উন্নতমানের শিক্ষক।
বাংলাদেশে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, মাদ্রাসা, বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক ও অবকাঠামোগত অবস্থার প্রসার বাড়লেও শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে আমরা আজও অনেক পিছিয়ে। যেহেতু শিক্ষার মানের নিয়ামক হচ্ছেন শিক্ষক ও তাঁর শিক্ষা, তাই মানসম্পন্ন শিক্ষক পেতে হলে অন্যান্য শর্তের সঙ্গে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো উন্নতমানের শিক্ষায় শিক্ষিত শিক্ষকগোষ্ঠী। এই শিক্ষকগোষ্ঠী বা ‘পুল অব টিচার্স’ তৈরির ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় বা ইউনিভার্সিটি অব এডুকেশন। আজকাল বিশ্বের অনেক দেশেই ইউনিভার্সিটি অব এডুকেশন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে ভালো শিক্ষক তৈরির জন্য, শিক্ষায় নানা ধরনের গবেষণা ও উদ্ভাবনীমূলক কার্যক্রম পরিচালনা, নানা স্তরের শিক্ষাকে কী করে আরও সৃজনশীল, আনন্দদায়ক, জীবনধর্মী ও অগ্রসরমাণ করা যায়, তা নিয়ে নিরন্তর কাজ করার জন্য। শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ও সে লক্ষ্যেই কাজ করে থাকে এবং প্রস্তাবিত শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ও সেই লক্ষ্য নিয়েই ভবিষ্যৎ শিক্ষক-জনসম্পদ তৈরি করবে।

২.
আমরা জানি, সার্কভুক্ত দেশ তথা ভারত ও শ্রীলঙ্কার টিচার্স এডুকেশন অনেক প্রাগ্রসর, এমনকি নেপাল ও পাকিস্তান এ ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানে শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শিক্ষার মান বাড়ানোর জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষক তৈরি করার লক্ষ্যে বাংলাদেশে টিচার এডুকেশন তথা শিক্ষক (প্রশিক্ষণ) ব্যবস্থার প্রসারকেও দ্রুততালে এগিয়ে চলতে হবে। মোট ৮২ হাজার ৮২৮টি প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক তৈরির জন্য এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য মাত্র ৫৪টি সরকারি প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (পিটিআই) রয়েছে। তেমনিভাবে ১৮ হাজার ৭৫৬টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য মাত্র ১৪টি সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ এবং ৯৭টি বেসরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ রয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য একটি মাদ্রাসা শিক্ষক ট্রেনিং ইনস্টিটিউট রয়েছে (উৎস: ব্যানবেইস-২০১০)। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোর জন্য আলাদা কোনো শিক্ষক প্রশিক্ষণ স্কুল বা কলেজ নেই। প্রাক-প্রাথমিক স্তর, প্রাক-শিশু যত্ন ও শিক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষক তৈরি ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থার কথা নতুন শিক্ষানীতিতে গুরুত্ব পেয়েছে। বর্তমানে যতটুকু রয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল। শিক্ষকদের উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য বিশেষায়িত কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআর তথা শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট ছাড়া। সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একটি ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইইআর) ও বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট রয়েছে। তবে এ দুটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক শিক্ষা কার্যক্রম অত্যন্ত সীমিত ও প্রারম্ভিক পর্যায়ে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ সালের প্রতিবেদনেও বর্তমান শিক্ষক শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর ওপর কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে। কারণ, সীমিত সংখ্যক শিক্ষক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দিয়ে শিক্ষকতার জন্য উপযুক্ত বিশাল জনসম্পদ তৈরি করা সম্ভব নয়।

৩.
সরকারি ও বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজগুলো বাংলাদেশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় রয়েছে আরও শত শত সাধারণ কলেজ। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠক্রম ও সিলেবাস তৈরি, মূল্যায়ন, পরীক্ষা গ্রহণ, ডিগ্রি প্রদান ইত্যাদি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমের অংশ। একটি মাত্র জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন হাজারো সাধারণ উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (ডিগ্রি কলেজ), বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোর একাডেমিক কার্যক্রমের তত্ত্বাবধান ও মনিটরিং করা যেমন দুরূহ ব্যাপার, তেমনি দুরূহ শিক্ষক শিক্ষণ কলেজগুলোতে মানসম্মত একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনায় সহায়তা ও নেতৃত্ব প্রদান।
আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোনো শিক্ষা অনুষদ বা ফ্যাকাল্টি অব এডুকেশন নেই, যার অধীনে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজগুলো পরিচালিত হতে পারে। ভারতের প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা অনুষদ/ফ্যাকাল্টি অব এডুকেশন রয়েছে এবং এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা অনুষদের আওতায় শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজগুলোর সব কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন একটি ফ্যাকাল্টি অব এডুকেশন রয়েছে, যার কার্যক্রম অত্যন্ত সীমিত। দুঃখজনক হলেও সত্য, টেকনিক্যাল টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষ, অধ্যাপক কিংবা সহযোগী অধ্যাপক ‘ডিন-ফ্যাকাল্টি অব এডুকেশন’ হিসেবে পরিচিত। অথচ টেকনিক্যাল টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সংখ্যা মাত্র একটি।

৪.
শিক্ষার বিভিন্ন দিক নিয়ে লেখাপড়া, চর্চা, চিন্তাভাবনা, গবেষণায় কাজ করতে করতে এ দেশে শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় তথা ‘ইউনিভার্সিটি অব এডুকেশন’ প্রতিষ্ঠা নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। ২০১০ সালে নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়নকালে আমরা শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে শিক্ষক, শিক্ষা ও পেশাদারি, মর্যাদা ইত্যাদি বিষয়ের সঙ্গে ক. একটি শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়, খ. প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা অনুষদ খোলা, গ. প্রতিটি মহাবিদ্যালয়ে শিক্ষা (এডুকেশন) আলাদা বিষয় চালু করার সুপারিশ করেছিলাম। প্রস্তাবিত শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা বিজ্ঞানের নানা শাখার ওপর জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান-সঞ্চালন তথা শিক্ষার চলন্ত গবেষণাগার হিসেবে কাজ করবে। শিক্ষায় গবেষণা, উদ্ভাবনীমূলক কাজ, নানা পরীক্ষাসহ অন্যান্য কার্যক্রমও চলবে।
শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয় বা বিভাগ যেমন প্রাক-শিশু যত্ন ও শিক্ষা, প্রাথমিক শিক্ষা, মাধ্যমিক শিক্ষা, ভাষা শিক্ষা, ব্যবসায় শিক্ষা, শিক্ষা মূল্যায়ন ও গবেষণা, বিজ্ঞান, গণিত ও প্রযুক্তি শিক্ষা, সামাজিক বিজ্ঞান শিক্ষা, শিক্ষা মনোবিজ্ঞান, একীভূত শিক্ষা, জেন্ডার এডুকেশন, বিশেষ শিক্ষা, ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা, শেখন-শেখানো পদ্ধতি, মূল্যায়ন পদ্ধতি, শিক্ষানীতি বা পলিসি ও প্রশাসন, শিক্ষা পরিকল্পনা, শিক্ষা অর্থনীতি, শিক্ষায় নেতৃত্ব, উপানুষ্ঠানিক ও অব্যাহত শিক্ষা, আইসিটি ইন এডুকেশনসহ আরও অনেক বিভাগ থাকবে। ডিসিপ্লিন বা জ্ঞানের শ্রেণীকরণ অনুযায়ী কয়েকটি অনুষদও থাকবে। শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজগুলো এর আওতায় পরিচালিত হবে। তাহলে বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর যে দায়ভার তা শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ন্যস্ত করা যাবে। অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন, ব্যবস্থাপনা ও অর্থায়নের মতো এ বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য যে মানদণ্ড ও শর্তাবলি পূরণ করতে হয়, এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তা মানা হবে। এ ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট তথা আইইআর একটি অনন্য প্রতিষ্ঠান হওয়ায় প্রারম্ভিক ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রস্তাবিত শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়টি আইইআরকে কেন্দ্র করে কিংবা শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ, যেমন ময়মনসিংহের পুরুষ ও মহিলা টিচার্স ট্রেনিং কলেজগুলো অথবা নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে হতে পারে।
শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক রূপরেখা নিয়ে ভবিষ্যতে আরও উপস্থাপনের প্রত্যাশায় এই লেখার সমাপ্তি টানছি।
অধ্যাপক সালমা আখতার: পরিচালক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইআর), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.