এক বছর পরও উপজেলা পরিষদ অকার্যকরঃ আঙুল বাঁকানোর ঘোষণা



উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে কোনো আনন্দ-উত্সব হয়নি। তবে উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানরা মিলিতভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীও তাদের ক্ষোভের তাপ থেকে রেহাই পাননি। সরকারের বছর পূর্তিতে তুলে ধরা সাফল্যের তালিকায় উপজেলা নির্বাচন থাকলেও নির্বাচিত উপজেলা পরিষদ কার্যকর হওয়ার উল্লেখ ছিল না।
মহাজোট সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েও উপজেলা চেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যানরা এক বছর পরও ক্ষমতা বুঝে পাননি। কার্যকর ও ক্ষমতাশালী স্থানীয় সরকারের দাবিতে তাদের চেষ্টা-তদবির এখন সভা-সমাবেশ ছাড়িয়ে ঘেরাও আন্দোলনের পথ ধরেছে। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠান থেকে তাদের আন্দোলনের কর্মসূচি ও আলটিমেটাম ঘোষিত হয়েছে।

‘অকার্যকর উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যানের এক বছর’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তারা সুশাসন ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যত্ নিয়ে গভীর হতাশা ও উত্কণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। নির্বাচিত সরকারের অধীনেও দেশে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা শক্তিশালী না হয়ে অকার্যকর থাকায় তারা সরকারের কঠোর সমালোচনা করে উপজেলা পরিষদে সংসদ সদস্যদের উপদেষ্টা রাখার বিধান বাতিলের দাবি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। জাতীয় সংসদে যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন, বাজেট আলোচনা ও পাস এবং মন্ত্রণালয়গুলোর কাজের নজরদারি করাতেই যেখানে সংসদ সদস্যদের মনোযোগী হওয়া উচিত, সেখানে স্থানীয় সরকারে তাদের নাক গলানো উদ্দেশ্যমূলক নিঃসন্দেহে। অন্যদিকে স্থানীয় সরকার পরিচালনা ও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদেরই সার্বিক ক্ষমতার অধিকারী হতে হবে। এজন্যই তারা নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, জনগণের প্রত্যাশার ওপর দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে সরকার উপজেলা পরিষদে সংসদ সদস্যদের উপদেষ্টা বানিয়ে সঙ্কটের জন্ম দিয়েছে। পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনগুলো উপদেষ্টা ছাড়াই যদি দায়িত্ব পালন করতে পারে, তবে উপজেলা পরিষদ কেন পারবে না—এই প্রশ্ন খুবই যুক্তিসঙ্গত। সংবিধানে উল্লিখিত স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত বিধি-বিধানের সঙ্গেও সরকারের ভূমিকা সাংঘর্ষিক হয়ে উঠেছে।
সংবিধান প্রণেতার দাবিদার হয়ে আওয়ামী লীগ কেন স্থানীয় সরকার সম্পর্কিত ধারা বাস্তবায়নে আগ্রহী নয়, সেটা এখন অনেকটাই পরিষ্কার। স্থানীয় সরকারে সব ক্ষমতার অধিকারী হবেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা—এর বিরোধিতা করে সংসদে উপজেলা পরিষদ আইন পাস করা হয়েছে। সেখানে সংসদ সদস্যরা উপদেষ্টা হিসেবে উপজেলা পরিষদে শুধু উপদেশই দেবেন না, পরিষদ তাদের উপদেশ ও পরামর্শ গ্রহণে বাধ্য থাকবে—এমনটাও বলা হয়েছে। এমনকি উপদেষ্টাদের অজান্তে উপজেলা পরিষদ সরকারের সঙ্গে কোনোরূপ যোগাযোগ করতেও পারবে না। এভাবে সংসদ সদস্যদের উপজেলা পরিষদে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী করে তোলা হয়েছে। অন্যদিকে উপজেলার সরকারি কর্মকর্তাদের এসিআর লেখাসহ গুরুত্বপূর্ণ দায়-দায়িত্ব ইউএনও’র হাতে রাখা হয়েছে। ফলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হয়েও উপজেলা চেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যানদের ঠুঁটো জগন্নাথ বানানো হয়েছে। এটা মেনে নেয়া তাদের জন্য আত্মহত্যার শামিল। এর ফলে সরকারের স্বরূপও উন্মোচিত হয়েছে। গণতন্ত্র, সুশাসন প্রভৃতি কথার সঙ্গে বাস্তবে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়ে মহাজোট সরকার আসলে কী স্বার্থ উদ্ধার করতে চাইছে, সেটা ভেবে দেখার বিষয়।
নির্বাচনী ইশতেহারে সুশাসন ও গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা এবং প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দেয়ার কথা বলা সত্ত্বেও স্থানীয় সরকারের অন্যতম স্তর উপজেলা পরিষদের অকার্যকর অবস্থা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। এক বছরে গণতন্ত্র সুসংহত হওয়া দূরে থাক, তার আশা জাগাতেও সক্ষম হয়নি মহাজোট সরকার। কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা অটুট রাখাই নয়, একে স্থায়ী রূপ দেয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে ক্ষমতাসীনরা। দলীয় ও আমলাতান্ত্রিক স্বার্থ এখানে গাঁটছড়া বেধেছে দেখা যাচ্ছে। এ অবস্থায় প্রতিবাদী উপজেলা চেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যানদের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকার প্রতি গণতন্ত্রকামী বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর সমর্থন থাকাই স্বাভাবিক। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর দীর্ঘ এক বছর লাগাতার চেষ্টা-তদবিরে কাজ না হওয়ায় আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণার বিকল্প আছে মনে হয় না। সোজা আযুলে ঘি না উঠলে আযুল বাঁকাতে হয়—এটা সবার জানা। সে অবস্থা এড়াতে সময় থাকতেই সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হওয়া মঙ্গল।

No comments

Powered by Blogger.