সংঘাত-রাজনীতিবিদেরা যা পারেন না by ফারুক ওয়াসিফ

গল্পটা এ রকম: স্বাধীনতার পরের কথা। এক দেশপ্রেমিক ভালো মানুষের স্বপ্নে দেখা দিলেন এক দরবেশ। দরবেশ তাঁকে বললেন, ‘যুদ্ধ করে নতুন দেশ পেয়েছ। বলো, দেশের জন্য তুমি কী চাও? যা চাইবে তা পাবে।’ ভালো মানুষ তো ভালোই মানুষ। এক পলক ভেবে তিনি বললেন, ‘হে দয়াল দরবেশ, আমি চাই যে আমার দেশের সব মানুষ সৎ হবে, জ্ঞানী হবে
আর রাজনীতি করবে।’ কথা শুনে দরবেশের কপালে চিন্তার রেখা ফুটল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনি বললেন, ‘বড় কঠিন দাবি রে! যাক, আমি বর দিলাম, তোর দেশের মানুষের মধ্যে ওই তিনটি গুণই থাকবে, তবে কেউই একসঙ্গে দুটির বেশি গুণ পাবে না।’ তখন থেকে দেশে সৎ ও জ্ঞানী মানুষের অভাব নেই, অভাব নেই রাজনীতির লোকেরও। কিন্তু মুশকিল হলো, রাজনীতির সৎ মানুষটি জ্ঞানী হন না, সৎ ও জ্ঞানী যিনি তিনি রাজনীতিতে ব্যর্থ হন। আর যিনি রাজনীতিতে সফল তিনি জ্ঞানী হলে সৎ হন না আর সৎ হলে জ্ঞানী থাকেন না।
জ্ঞানী ও সৎ মানুষেরা আর সংসদেও যেতে পারেন না; নির্বাচনে তাঁদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। এই সুবাদে সেখানে সরকারি-বেসরকারি উভয় দলের সাংসদেরা গালিগালাজের অভিধান রচনা করে চলেছেন। যেসব কথা পুরুষেরা হরহামেশা বলে থাকেন, সেসব কথা নারীকণ্ঠে উচ্চারিত হওয়ায় পুরুষের কানে তা আরও তেজস্ক্রিয় লাগল। হিংসাই গালির জনক এবং তা প্রায়শই নারীবিদ্বেষী। এক নেত্রীর প্রশংসায় অন্য নেত্রীর যে নিন্দা হয়, তাও সাধারণত নারীবিদ্বেষী। সেই হিংসা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে প্রতিহিংসায়। গণতন্ত্রের শত্রু কম নয়, কিন্তু ঘৃণা আর প্রতিহিংসার দোনলা বন্দুকের সামনে দাঁড়ায় সেই সাধ্য তার নেই। অতীতেও উভয় দল ঘৃণা আর প্রতিহিংসাকে আদর্শ, লক্ষ্য, কর্মসূচি বানিয়ে সহমরণে রওনা হলে জনগণ বিব্রত বোধ করেছিল। জরুরি অবস্থা জারির আগে ও পরের সেই ঘটনাবলি আমরা জানি।
মোগল রাজপণ্ডিত আবুল ফজল বাংলা অঞ্চলের নাম দিয়েছিলেন ‘বুলঘাখানা’ বা ‘চির-অশান্তির দেশ’। আমাদের রাজনীতিবিদেরা সেই কথা বারে বারে প্রমাণ করে চলেছেন। এই অবস্থায় রাষ্ট্র-সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি এবং অধিকার ও কল্যাণ—সবই দ্বিদলীয় ক্ষমতাকেন্দ্রের দোনলা বন্দুকের ‘ক্রসফায়ারে’।
দুই. এশিয়া কাপে ক্রিকেটারদের খেলা শেষ; এখন শুরু হয়েছে সেটা নিয়ে রাজনীতির খেলা। মহাকাব্যিক ওই পরাজয় নিয়ে আমাদের ক্রিকেটাররা পরস্পরকে না দুষলেও, রাজনীতিবিদগণ পরাজয়ের ‘রাজনৈতিক কারণ’ আবিষ্কারে নেমেছেন! এ ব্যাপারে শ্রীলঙ্কার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বরাতে ক্রিকেটার আর রাজনীতিবিদদের একটা তুলনা প্রাসঙ্গিক: ক্রিকেটাররা দেশকে ঐক্যবদ্ধ করেন আর রাজনীতিবিদেরা করেন বিভক্ত। ক্রিকেটাররা কঠিন পরিশ্রম করেন; রাজনীতিবিদেরা পরিশ্রমের ভান করেন। ক্রিকেটাররা শৃঙ্খলাবদ্ধ; বেশির ভাগ রাজনীতিবিদ এর সঙ্গে অপরিচিত। ক্রিকেটাররা জয়ের স্বার্থে হাত-পা ভাঙার ঝুঁকি নেন; আর রাজনীতিবিদেরা নিজেদের স্বার্থে কর্মী-সমর্থকদের হাত-পা মায় জীবন নষ্টের পরিস্থিতি তৈরি করে নিজেরা নিরাপদ থাকেন। ক্রিকেটাররা যোগ্যতাবলেই পুরস্কার পান; আর জনগণ যেমন, তেমন রাজনীতিবিদই তাঁরা পান। ক্রিকেটাররা অন্যায্য হলেও আম্পায়ারের রায় মেনে নেন; আর রাজনীতিবিদেরা অপছন্দের রায়দাতাদের বদলি বা বরখাস্ত করেন। ক্রিকেটাররা জয়-পরাজয়ে দলত্যাগ করেন না, রাজনীতিবিদেরা প্রায়শই পরাজিত দল ছেড়ে জয়ী দলে নাম লেখান।
তিন. মার্কিন চলচ্চিত্রকার স্টিভেন স্পিলবার্গের দাসব্যবস্থাবিরোধী অসাধারণ চলচ্চিত্র অ্যামিস্ট্যাড। ভিন্ন ইতিহাস ও সমাজের দুটি চরিত্র সেখানে মুখোমুখি হয়। একদিকে থাকেন একদল কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান এবং তাঁদের নেতা সিঙ্কুই, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা পিতাদের অন্যতম জন অ্যাডামসের পুত্র সিনেটর অ্যডামস। দুজন দুই জাতির দুই মেরুর মানুষ হলেও ঘটনার ধারা তাঁদের এক কাতারে এনে ফেলে। সিঙ্কুই ও তাঁর সঙ্গীদের বিচার হচ্ছিল বিদ্রোহের অপরাধে, অন্যদিকে সিনেটর অ্যাডামস ও তাঁর গোষ্ঠীর দাসপ্রথাবিরোধী সংগ্রাম ঠেকাতে গৃহযুদ্ধের হুমকি দিচ্ছেন দক্ষিণের দাসমালিকেরা। এ রকম এক সংকটের কিনারে দাঁড়িয়ে অ্যাডামস সিঙ্কুইকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘তুমিও তো একজন গোত্রপতি, এমন সংকটে তুমি কী করো?’ সিঙ্কুইয়ের জবাব, ‘বুকের গভীর থেকে শ্বাস নিই, সেই শ্বাসটানে তুলে আনি আমার সব পূর্বপুরুষের আত্মাকে। তাঁদের শুধাই, কী আমার করণীয় হে পিতৃগণ?’ আফ্রিকান দলপতি আসলে ইতিহাসের থেকে শিক্ষার কথাই বলেছিলেন। আজকের বাংলাদেশ ক্রমশ সংকটের চোরাবালি সবখানে ওঁত পেতে আছে। প্রধান দুটি রাজনৈতিক জোট মরণপণ দ্বন্দ্বে লিপ্ত। এ রকম অবস্থায় ইতিহাসের কোনো শিক্ষা আমাদের কাজে লাগবে কি? এ রকম বাস্তবতাতেই ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা ঘনিয়ে এসেছিল। উপমহাদেশের রাজনীতির ধারা খেয়াল করলেও দেখব, এ রকম বাস্তবতাতেই রক্তপাত, হানাহানি, রাষ্ট্রবিপর্যয় ইত্যাদি হয়েছে। অষ্টম শতাব্দীতেও এ রকম অবস্থা বাংলায় নেমে এসেছিল। দেশজুড়ে নৈরাজ্য চলছিল। বড় মাছের গ্রাসে ছোট মাছের গ্রাসিত হওয়ার যে দশাকে মাৎস্যন্যায় বলা হয়, সেটা চলছিল। দিশেহারা মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছিল নতুন নেতা।
এ রকম অবস্থার সুযোগ নিয়ে সেনাপতি বা উজির-নাজিরদের রাজা বনে যাওয়ার নজির অজস্র। এমনকি বিদেশি শক্তিও এ রকম সুযোগের জন্য তক্কে তক্কে থাকে। কোনো উপায় যখন পাওয়া গেল না, তখন জনগণের ভেতর থেকেই সমাধান এল। প্রকৃতিপুঞ্জ, তথা জনগণ একজন নেতা নির্বাচন করে নিলেন। তিনি হলেন পাল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রাজা গোপাল—বিশ্বের প্রথম নির্বাচিত রাজা। অনেকে বলেন, সে সময় নির্বাচন তো দূরের কথা, গণতন্ত্রের ধারণাই বাংলায় অচল ছিল। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ইতিহাসবিদ আহমেদ কামালের মতে, ‘বাংলায় তখন বৌদ্ধপ্রাধান্য চলছিল। নির্বাচনের সংস্কৃতি খুব ভালো করে জানা ছিল বাঙালি বৌদ্ধদের। বৌদ্ধবিহার ও ধর্মসংঘের প্রধান সংঘের সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হতেন এবং রাজা গোপালও ছিলেন বৌদ্ধ।’
যে দেশে নির্বাচন ও সমঝোতার সংস্কৃতি এত পুরোনো, সে দেশে অগণতান্ত্রিকতা ও অসহিষ্ণুতা রাজনীতির মধ্যে এত গেড়ে বসল কী করে? সমাজের আর কোনো অংশে এমন দাঁতে দাঁতে ঠকাঠকি বিবাদ দেখা যায় না। সবচেয়ে বেশি প্রতিযোগিতা হওয়ার কথা ব্যবসায়ীদের মধ্যে। কিন্তু বিভিন্ন রকম প্রতিষ্ঠান, সমিতি-অ্যাসোসিয়েশন বানিয়ে তাঁরা কিন্তু ঠিকই খেলার নিয়ম সাব্যস্ত করে নিয়েছেন। দুর্নীতি-অনিয়ম সত্ত্বেও একধরনের পেশাদারি তাঁদের মধ্যে আছে। এ কারণেই বলা যায়, বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-পুঁজিপতি শ্রেণী মোটামুটি সংগঠিত। সামাজিক ক্ষেত্রেও অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আমাদের অর্জন ঢনঢনা। এমনকি চোর-ডাকাত-মাফিয়ারাও পরস্পরের এখতিয়ার মান্য করে। অথচ রাজনীতিতে পরস্পরকে মান্য করার রেওয়াজ সম্পূর্ণ বর্জিত। রাজনৈতিক ঐতিহ্য এত সুপ্রাচীন হওয়া সত্ত্বেও সেখানে আজ অবধি খেলার কোনো নিয়ম দাঁড়াল না। সে কারণেই বারবার আমাদের রাজনৈতিক বিপর্যয় ও হানাহানির জরুরি পরিস্থিতির মুখে পড়তে হচ্ছে, বারবার গোপাল রাজা খুঁজতে হচ্ছে। কিন্তু ইতিহাসের গোপাল ছিলেন প্রজাপুঞ্জের নির্বাচিত, ভবিষ্যতের গোপাল রাজা কাদের হাত থেকে ক্ষমতার দণ্ড গ্রহণ করেন, তা তাই দেখার অপেক্ষা। ইতিহাস সর্বদাই লীলাময়, ইতিহাস পুনরাবৃত্তিপ্রবণও বটে; এবং ইতিহাসে প্রথমবার যা ট্র্যাজেডি হয়ে আসে, দ্বিতীয়বার তা হয়ে ওঠে পরিহাস।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.