রং চড়ানো ইতিহাস-৪ by মাহমুদ শামসুল হক


ভারতবর্ষীয় রাজরাজড়াদের যুদ্ধবিগ্রহ সম্পর্কে বিস্তর ভুল বার্তা লিপিবদ্ধ করে গেছেন এক শ্রেণীর ইতিহাস লেখক। অনেক ইচ্ছা করে কিংবা অজ্ঞতাবশত যুদ্ধ-লড়াই, দাঙ্গা, সংঘর্ষ, সংঘাত ইত্যাদি শব্দের তাত্পর্য অভিন্ন করে দেখেছেন। এসব ইতিহাসকে সাক্ষী মেনে ক্রমাগত ফায়দা লুটেছেন ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত ধূর্ত রাজনীতিকরা।
সজাগ না হলে এদের চক্রান্তে কেবলই ধূমায়িত হতে থাকবে জাতি-বিদ্বেষের আগুন। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত যত বড় বড় সাম্পদ্রায়িক দাঙ্গা হয়েছে তার অন্যতম উপকরণ হিসেবে কাজ করেছে এসব বিভ্রান্তিকর তথ্যাদি।

দীর্ঘকাল স্কুলপাঠ্য ইতিহাসে ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলিম শাসকদের লড়াইকে চিহ্নিত করা হয়েছে হিন্দু-মুসলিম লড়াই বলে। যুগযুগান্তর ধরে উভয় সম্প্রদায়ের মনোভূমিতে ছিটিয়ে দেয়া হয়েছে হিংসা-ঈর্ষা ও প্রতিশোধপরায়ণতার বীজ। ক্ষেত্রবিশেষে তা রূপ নিয়েছে বিষবৃক্ষে। এভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বীজান্তর ঘটেছে। যার মূল্য রক্ত দিয়ে শোধ করতে হয়েছে সাধারণ হিন্দু-মুসলিমদের। কখনওবা অমানবিক মর্যাদাহানি এবং অবদমনের শিকার হয়ে কাটাতে হয়েছে দুর্বিষহ জীবন। ভ্রান্ত ইতিহাসের প্ররোচনায় মন্দির-মসজিদ-গির্জা-প্যাগোডা-গুরুদুয়ারা ভাঙ্গার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ধর্মনৈতিক কারণ বলে চালিয়ে দেয়ার সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির অদৃশ্য উত্তাপ পোহিয়ে পোহিয়ে ক্ষেত্রবিশেষে হারিয়েছে মনুষ্যত্ববোধ। সম্প্রতি ভারত বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা এবং গুজরাটে রামমন্দির ইস্যুকে কেন্দ্র করে সংঘটিত দাঙ্গা তারই নির্মম জের।
এসব ঘটনার নায়করা মানুষকে এই বলে উস্কানি দিয়েছেন যে, ভারতের যুদ্ধবিগ্রহের ইতিহাস মানে হিন্দু-মুসলিম লড়াইয়ের ইতিহাস। কিন্তু ভারতবর্ষে আদৌ হিন্দু-মুসলমান যুদ্ধ বা লড়াই হয়নি, হয়েছে হিন্দু শাসক ও মুসলিম শাসনের মধ্যে। রাজ্যরক্ষা, রাজ্যস্থাপন, রাজ্যবিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রায়ই ছোট-বড় জঙ্গে ক্লান্ত থেকেছে বিশেষত মধ্যযুগীয় ভারত। যার কোনোটিই ধর্মনৈতিক বা জাতিভিত্তিক বিষয়কে কেন্দ্র করে নয়। নিছক রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের লড়াই মাত্র। অন্যদিকে হিন্দু-মুসলমান ও অন্যান্য সম্প্রদায়ে ধর্ম-সংস্কৃতি নিয়ে যেসব দাঙ্গা হয়েছে তা কোনোক্রমেই যুদ্ধের সমার্থক নয়। অথচ তাই করেছেন কিছু কিছু মতলববাজ ইতিহাস লেখক।
ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মাইলফলক হয়ে আছে যেসব যুদ্ধ-বিগ্রহ তার প্রায় সবগুলোই হয়েছে হিন্দু-মুসলমানের অংশগ্রহণে। সুলতান মাহমুদের সময় থেকে সুলতানি আমল এবং মোগল আমলের যুগান্তকারী যুদ্ধে উভয়পক্ষেই হিন্দু-মুসলমানের অংশগ্রহণ ছিল। মাহমুদের ভারত আক্রমণ ও মন্দির-মসজিদ ভাঙ্গার সঙ্গে যেমন অনেক হিন্দু অংশ নিয়েছিলেন, তেমনি সুলতানি আমলেও তারা অংশ নিয়েছিলেন মুসলিম সেনাবাহিনীতে। অর্থাত্ হিন্দুরা মুসলিম শাসকের পক্ষে থেকে হিন্দু শাসকের বিরুদ্ধেও লড়েছেন। রাজনৈতিক অঙ্ক কষেই হিন্দু রাজা ও সেনানায়করা মোগল সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে শত শত বছর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন, পরস্পরের পক্ষাবলম্বন করেছেন, সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন একে অন্যের দিকে। যেমন—১৫৩২ খ্রিস্টাব্দে গুজরাটের সুলতান আহমদ শাহ চিতোর আক্রমণ করেন। এসময় চিতোর-রানী কর্ণবতী ‘রাখি ভাই’ সম্বোধন করে মোগল সম্রাট হুমায়ুনের সাহায্য চেয়ে এক চিঠি পাঠান। হুমায়ুন তখন বিহারে বিদ্রোহী শেরখানকে দমন করতে ব্যস্ত। চিঠি পেয়ে তিনি চলে গেলেন চিতোরে। যদিও এরই মধ্যে রানী কর্ণবতী পরাজয়ের গ্লানি এড়াতে আত্মহত্যা করেছেন।
বিশ্রুত ঐতিহাসিকদের সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন, মোগল সম্রাটরা প্রধানত পাঠান সামন্তদের দুর্বল করতে রাজপুত্র ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের হিন্দুদের সেনাদলসহ উচ্চপদে নিয়োগ দিয়েছেন। কোনোই সংশয় নেই যে, আকবর থেকে শাহজাহান পর্যন্ত রাজপুত সেনাধ্যক্ষ ও সেনারাই মোগল রাজশক্তির প্রধান পরিচালক ছিলেন। বাংলার ‘বারভূঁইয়া’দের অন্যতম ঈশা খাঁকে দমন করতে এসেছিলেন মোগল সেনাপতি রাজা মানসিংহ। ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি আরেক ভূঁইয়া যশোরের প্রতাপাদিত্যকে পরাভূত করেন। বহুল আলোচিত হলদিঘাট যুদ্ধে সম্রাট আকবরের পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এ রাজপুত বীর। এ যুদ্ধে চিতোর-রাজ রানা প্রতাপসিংহের বাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যিনি, তিনি মুসলমান। নাম হাকিম খান শুর। অনেক ঐতিহাসিক সম্রাট আওরঙ্গজেবকে হিন্দু বিদ্বেষী বলেছেন। এ অভিযোগের পেছনেও প্রধান ছিল রাজনৈতিক কারণ। শিবাজি ও আওরঙ্গজেবের বহুল আলোচিত লড়াইয়ের অগ্রভাগে মোগল বাহিনীকে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের অন্যতম প্রধান ছিলেন রাজপুত শাসক রাজা জয়সিংহ। অন্যদিকে শিবাজিকে নানাভাবে সাহায্য করেছেন পাঠান সামন্তরা। তারা অনেকেই শিবাজির ফৌজে গুরুত্বপূর্ণ পদ অলঙ্কৃত করেছেন। শিবাজির ব্যক্তিগত সহকারী মৌলবী হায়দর খান নিশ্চয়ই হিন্দু ছিলেন না! অথচ পাঠ্য ইতিহাসে শিবাজি-আওরঙ্গজেব লড়াইকে হিন্দু-মুসলিম লড়াই বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটকরা তা-ই বলছেন এবং সাধারণ মানুষকে প্ররোচিত করছেন সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠতে। ১৬৬৭ খ্রিস্টাব্দে আসামরাজ চক্রধ্বজকে দমন করতে আসামের ভূতপূর্ব রাজার ছেলে রাম সিংহকে পাঠিয়েছিলেন আওরঙ্গজেব। যোধপুরের রাজা যশোবন্ত সিংহ মারা গেলে তার শিশুপুত্রকে দিল্লিতে এনে প্রতিপালনের নির্দেশ দেন সম্রাট এবং সেখানকার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন রাজবংশজাত ইন্দ্র সিংহকে। নাসিকের রামসেজ দুর্গ আক্রমণ করে মারাঠা সেনাপতি হাম্বির রাওকে দমন করতে মোগল বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন সেহাবউদ্দিন খাঁ এবং দলপত্ রাও।
এসব উদাহরণ টানার অর্থ কাউকে হিন্দু বা মুসলিম প্রেমিক বা বিদ্বেষী প্রমাণ করা নয়। বরং প্রমাণ করার জন্য যে, শাসকদের যুদ্ধ সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকও বটে। কোনোক্রমেই ধর্মনৈতিক নয়। কাজেই ইতিহাস পাঠককে বিবেচনায় রাখতে হবে, এসব যুদ্ধবিগ্রহ হিন্দু-মুসলমানের যুদ্ধ নয়। মিথ্যাচার করে কেউ যেন বিষয়টি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে না পারেন সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পাঠ্য ইতিহাসে খণ্ডিত নয়, প্রকাশ করতে হবে পূর্ণ ইতিহাস। নইলে এ থেকে ভবিষ্যতেও ফায়দা তুলবে ধুরন্ধর রাজনীতিকরা।

No comments

Powered by Blogger.