দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবস-আমরা কতটা প্রস্তুত? by মাহবুবা নাসরীন

আমাদের দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সুখ্যাতি দক্ষিণ এশিয়া ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু গবেষণা বলে, বাংলাদেশের শতকরা ৬০ ভাগ মানুষ সুপেয় পানিবঞ্চিত, আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছে দূষণভুক্ত এলাকার
প্রায় সব মানুষ আজ জাতীয় দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবস।


বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এ মাটির মানুষকে বহু যুগ ধরে শিখিয়েছে কীভাবে দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে হয়। বিশেষত উপকূলীয় অঞ্চলে ঝড়, জলোচ্ছ্বাসের কথা ষোড়শ শতকে আবুল ফজলের 'আইন-ই-আকবরী'তেই উল্লেখ আছে। ধ্রুপদী চলচ্চিত্র 'দুখাই'তে প্রতিফলিত হয়েছে উপকূলীয় অঞ্চলে বংশপরম্পরায় লড়াই করে বেঁচে থাকে নারী-পুরুষ-শিশু। তিনটি বৃহত্তম নদী পদ্মা, মেঘনা, যমুনা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এসে মিলিত হয়েছে। অথচ তাদের উৎস প্রতিবেশী দেশে। বন্যাবিধৌত নদীতীরের মানুষ নিজস্ব অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান দিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে বসবাস করছে। খরাপীড়িত অঞ্চলের নারীরা দূর-দূরান্তে হেঁটে যাচ্ছে পানির সন্ধানে। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে বসবাসের অভিজ্ঞতা তাদের শিখিয়েছে কীভাবে প্রতিকূলতাকে জয় করা যায়। বাঙালির এই লড়াকু মানসিকতার জন্য ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধেও তারা পেয়েছে মানচিত্রে নিজ দেশের চিত্র আঁকতে। স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের উপর্যুপরি দুর্যোগ মোকাবেলা কৌশল তবু কেন কখনও কখনও থমকে যায়? খতিয়ে দেখলে গবেষণালব্ধ জ্ঞান বলে, এখন যে এর শুধু প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই নয়, মানুষের কর্মকাণ্ডে সৃষ্ট নতুন নতুন অজানা দুর্যোগও এ দেশের মানুষকে নাজুক করে তুলছে। বিশ্বায়ন, শিল্পোন্নত ভোগবিলাসী মানুষের দ্বারা বিশ্ব উষ্ণায়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ন, কৃষিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার, ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত উত্তোলন, জলাশয় ভরাট, বন নিধন, ত্রুটিপূর্ণ বাঁধ নির্মাণ ইত্যাদি নানাবিধ কারণে দুর্যোগ এখন প্রাকৃতিক কারণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বরং মানুষের কর্মকাণ্ড জলবায়ুর ওপর প্রভাব ফেলে ও অন্যান্য উপায়ে বাড়িয়ে দিচ্ছে দুর্যোগের ঘনঘটা। দুর্যোগের সময়, স্থায়িত্ব, পরিমাণ ও ধরন পাল্টো যাচ্ছে। নতুন নতুন দুর্যোগ দরিদ্র মানুষকে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বের হতে দিচ্ছে না। নাগরিক জীবনেও মানুষ থাকছে আতঙ্কগ্রস্ত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় আর্সেনিক দূষণের কথা। বাংলাদেশের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষই দুর্যোগের ভয়াবহতার মধ্যে আছে, আবার ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছে কমবেশি পুরো দেশটা। এই দুটি দুর্যোগের সঙ্গে বসবাস করার অভিজ্ঞতা এই অঞ্চলের মানুষের বংশানুক্রমে হয়নি, তাই এই ঝুঁকি মোকাবেলায় তাদের প্রস্তুতিও কম। আমাদের দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সুখ্যাতি দক্ষিণ এশিয়া ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু গবেষণা বলে, বাংলাদেশের শতকরা ৬০ ভাগ মানুষ সুপেয় পানিবঞ্চিত, আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছে দূষণভুক্ত এলাকার প্রায় সব মানুষ। ভূমিকম্প প্রতিরোধে ৬২ হাজার স্বেচ্ছাসেবককে প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা জানি, কিন্তু প্রকৃতই যদি ভূমিকম্প হয় তবে ত্রুটিপূর্ণ ভবনগুলো উদ্ধারের আগেই পরিণত হবে ধ্বংসস্তূপে। সাধারণ মানুষের প্রস্তুতি বা সচেতনতা একেবারে নেই বললেই চলে। প্রয়োজন কঠোর পদক্ষেপ আর জনসচেতনতা যে কোনো দুর্যোগ মোকাবেলায়।

মাহবুবা নাসরীন :অধ্যাপক ও সমন্বয়ক, সেন্টার ফর ডিজাস্টার অ্যান্ড ভালনারিবিলিটি স্টাডিজ সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.