ঢাবি ক্যাম্পাসে অস্ত্রধারীদের তাণ্ডবঃ বিরোধী পক্ষকে দমন সুখকর হবে না


অবশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও অস্ত্রের ঝন্ঝনানি ও উন্মত্ত হামলার ঘটনা দেখতে হলো। কিছু দিন ধরেই দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারপন্থী ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে প্রতিপক্ষের সংঘর্ষের ঘটনা প্রায় নিয়মিত হয়ে উঠেছে। গত সোমবার ঢাবিতে ছাত্রদলের দুই পক্ষের সংঘাত এবং তাতে ছাত্রলীগের অংশগ্রহণের সচিত্র খবর ছবিসহ পত্রপত্রিকায় ফলাও প্রচার করা হয়েছে।
সরকার সমর্থকরা ঘটনাকে ছাত্রদলের কোন্দলের বহিঃপ্রকাশ বললেও বিভিন্ন পত্রিকা এতে বহিরাগত সন্ত্রাসী ও ছাত্রলীগ ক্যাডারদের সক্রিয় ভূমিকা পালনের অনুসন্ধানি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। গতকালের আমার দেশ-এ অস্ত্রধারী ছাত্রলীগ ক্যাডারদের নাম-পরিচয়সহ ছবি ছাপা হয়েছে। ঘটনার পরদিনও এসব ছাত্রলীগ কর্মীকে ক্যাম্পাসে মিছিল-মিটিংয়ে দেখা গেছে। এসব থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, বিরোধী ছাত্র সংগঠনের কোন্দল জিইয়ে রাখতে এবং তা ব্যবহারের কৌশল গ্রহণ করেছে সরকার পক্ষ। ক্যাম্পাসে একক আধিপত্য কায়েমে এ ধরনের অপচেষ্টা অবশ্য নতুন নয়। তবে এতে করে শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার পরিবেশই শুধু বিঘ্নিত হবে না, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও অশান্ত হয়ে উঠবে, এটা মাথায় রাখা দরকার।
সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় বহিরাগত ও অস্ত্রধারীরা সবার সামনেই ক্যাম্পাস দাপিয়ে বেরিয়েছে। তাদের প্রতিহত করার কোনো আগ্রহ ছিল না পুলিশের। ছাত্রদলের পদবঞ্চিতদের ক্ষোভ থাকতেই পারে। কিন্তু বহিরাগত সন্ত্রাসীদের সহায়তায় কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ওপর হামলা এবং এতে ছাত্রলীগ ক্যাডারদের অংশগ্রহণ কারও কাছেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ছাত্রদল সভাপতির ওপর আঘাত হানার সময় অবশ্য পুলিশ এগিয়ে এসেছিল। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ফলে পুলিশ কর্মকর্তাও হামলার শিকার হয়েছেন। সোমবারের সংঘর্ষে ঢাবির প্রক্টর, ছাত্রদল সভাপতি, পুলিশ, সাংবাদিকসহ অর্ধশতাধিক আহত এবং মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণ হলেও পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে একজনকেও গ্রেফতার ও একটি অস্ত্রও উদ্ধার করতে সক্ষম হয়নি। পত্রিকায় প্রকাশিত পুলিশের সামনে হামলার ছবিতে পুলিশকে নির্বিকার দেখা গেছে। ফলে খোদ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারও বিস্ময় চেপে রাখতে পারেননি। পুলিশ কেন অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করল না, সে প্রশ্নও তুলেছেন তিনি। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে—তার এমন আশ্বাস থেকে বোঝা যায় সংঘর্ষস্থলে পুলিশের ভূমিকা মোটেই স্বাভাবিক ছিল না। তবে কি ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ওপর হামলা এবং এতে ছাত্রলীগের ভূমিকার কথা সংশ্লিষ্ট পুলিশদের আগে থেকেই জানা ছিল?
সংঘর্ষের ঘটনায় ঢাবি কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু এ ধরনের ঘোষণার ফলাফল কী হতে পারে সেটা কারও অজানা নয়। স্বাধীনতার পর থেকে ঢাবি ক্যাম্পাসে অসংখ্য সংঘর্ষের ঘটনার যেগুলো নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে তার প্রায় ৯৯ ভাগেরই রিপোর্ট দিনের আলো দেখেনি। ৭২টি হত্যাকাণ্ডের মধ্যে ৭০টিরই সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হয়নি। দলীয় সংশ্লিষ্টতা ও সরকারি হস্তক্ষেপই যে এর কারণ সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এবার কি আমরা এর ব্যতিক্রম আশা করতে পারি?
ছাত্র রাজনীতি ও ছাত্র আন্দোলনকে শিক্ষাঙ্গনের সুস্থতার বাহন মনে করা হলেও যখন দলীয় লেজুড়বৃত্তি ও স্বার্থ উদ্ধারই প্রাধান্য পায়, তখন ছাত্র রাজনীতি সন্ত্রাসী ও বহিরাগতদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২টি আবাসিক হলে অস্ত্র থাকার কথা গতকালের একটি দৈনিকের ভেতরের পাতায় ছাপা হয়েছে। সরকার সমর্থক পত্রিকাটির রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, প্রতিটি হলের ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের তত্ত্বাবধানেই অস্ত্র রয়েছে। এসব অস্ত্রের উত্স এবং সোমবারের সংঘর্ষে ছাত্রদল নেতৃত্বের বিরুদ্ধে এর ব্যবহারের কথাও রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটি এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের দৃষ্টি থেকে এ ধরনের খবর এড়িয়ে যাওয়ার কথা নয়। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত ছবি ও টিভি ক্যামেরার ফুটেজ থেকেও অস্ত্রধারী ও হামলাকারীদের শনাক্ত করা সম্ভব। শিক্ষাঙ্গনের স্বাভাবিক পরিবেশ বিনষ্টকারীদের চিহ্নিত করা ও তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণের ওপরই এখন সবকিছু নির্ভর করছে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধার ও বিরোধী পক্ষকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করা হলে পরবর্তী পরিস্থিতি সুখকর নাও হতে পারে—এটা ক্ষমতাসীনদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়।

No comments

Powered by Blogger.