সড়ক ও নদীপথে দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে by বদরুদ্দীন উমর


সড়ক দুর্ঘটনা এখন বাংলাদেশে প্রতিদিনের ব্যাপার। সকালে সংবাদপত্রের পাতায় চোখ রাখলেই দেখা যায় দেশের কোনো না কোনো জায়গায় সড়ক দুর্ঘটনার খবর। কোনো কোনো দিন পাওয়া যায় দুই, তিন, চার সড়ক দুর্ঘটনার খবর। দুই ঈদ অথবা অন্য কোনো ছুটির সময় লঞ্চ দুর্ঘটনাও ঘটে থাকে প্রায়ই।
এসব দুর্ঘটনায় প্রতিদিন চার, পাঁচ, দশজন থেকে নিয়ে ত্রিশ-চল্লিশ জনেরও মৃত্যু হয়। লঞ্চ দুর্ঘটনা হলে তাতে মৃত্যু হয় শত শত মানুষের। সড়ক ও নদীপথে এই দুর্ঘটনার হিসাব নিয়ে দেখা যাবে বছরে তিন-চার হাজার লোক এভাবে যাতায়াতকালে নিহত হন। এই সংখ্যা ইরাক যুদ্ধের সময় ইরাকে এবং এখন আফগানিস্তানের যুদ্ধে সেখানে বেসামরিক লোকদের মৃত্যুর সংখ্যা থেকে অনেক বেশি।

এটা ভাবলে খুব অবাক হতে হয়। কিন্তু এই ভয়াবহ অবস্থা নিয়ে কোনো উদ্বেগ যে শুধু সরকারের মধ্যে, বাস ও লঞ্চ মালিকদের মধ্যেই অনুপস্থিত তাই নয়, জনগণের কোনো অংশের মধ্যেও এর কোনো চিহ্ন দেখা যায় না। এটা যে শুধু অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার তাই নয়, রীতিমত বিপজ্জনক ব্যাপারও বটে। আজকের দিনে মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতা ও ভালোবাসা যে কী পরিমাণে অনুপস্থিত, সড়ক ও নদীপথে দুর্ঘটনাজনিত হাজার হাজার মানুষের এই মর্মান্তিক মৃত্যুর প্রতি ঔদাসীন্য থেকে এটা বোঝার অসুবিধে নেই।
বাস-ট্রাকের মধ্যে, বাসের সঙ্গে বাসের বা ট্রাকের সঙ্গে ট্রাকের এবং প্রাইভেট গাড়ির সঙ্গে বাস-ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষের কারণে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে যাদের মৃত্যু হয় বা আহত হয়ে যারা পঙ্গু হলো তাদের বিপুল অধিকাংশই একেবারে গরিব। এর মধ্যে নিম্ন মধ্যবিত্তের সংখ্যাও কম নয়। এসব পরিবারের লোকরা নিহত হলে শুধু যে তাদের জীবন যায় তাই নয়, এর ফলে উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের মৃত্যু সমগ্র পরিবারকেই চরম আর্থিক সঙ্কট ও দুরবস্থার মধ্যে নিক্ষেপ করে। অনেক পরিবার ভেঙেচুরে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
আশির দশকে এরশাদের শাসন আমলে এসব দুর্ঘটনার সংখ্যা খুব বৃদ্ধি পাওয়ায় দুর্ঘটনায় নিহতদের জন্য ক্ষতি পূরণের নির্দেশ দেয়া হয়। তার জন্য যাত্রীদের বীমার ব্যবস্থার কথাও বলা হয়। সে সময় অনেক গাড়ির গায়ে লেখা থাকতে দেখা যেত দুর্ঘটনায় মৃত্যু অথবা অঙ্গহানি হলে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু সরকারি নির্দেশ এবং বাস-লঞ্চ মালিকদের এই সব বিজ্ঞাপন সত্ত্বেও এমন একটি দৃষ্টান্তও তেমন দেখা যায়নি, যাতে দুর্ঘটনায় নিহতদের জন্য কোনো বাস কোম্পানি কারও পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। শুধু এরশাদের আমলেই নয়, পরবর্তী কালেও এদিক দিয়ে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। ১৯৯২ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক কবির কাসেম বরিশাল থেকে পাবনা যাওয়ার পথে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হওয়ার পর বরিশাল শেরেবাংলা হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। কবির কাসেম বরিশালের একজন পরিচিত ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। বাস কোম্পানি নিজে থেকে উদ্যোগী হয়ে তার পরিবারকে কোনো ক্ষতিপূরণ তো দেয়ইনি, উপরন্তু এর জন্য মিটিং-মিছিল করা সত্ত্বেও তাদের থেকে কিছু আদায় করা সম্ভব হয়নি। কয়েকদিন তারা নিজেদের অফিস বন্ধ রেখে পালিয়ে ছিল। আন্দোলন করে অন্য কোনো ফল পাওয়া যায়নি। সরকার এ ব্যাপারে কিছুই করেনি। এর থেকে স্পষ্টই বোঝা গিয়েছিল যে, সরকার বাস মালিকদেরই পক্ষে এবং সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত-আহতদের জন্য ক্ষতিপূরণ ব্যবস্থার তারা বিরোধী।
বাংলাদেশে সড়ক ও নদীপথে গাড়ি এবং লঞ্চ দুর্ঘটনা হয়েই চলেছে। এটা এক নিয়মিত ব্যাপার। নিয়মিত হওয়ার কারণে এবং ও নিয়ে সরকার ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল কোনো উচ্চবাচ্য না করায় জনগণের মধ্যেও এর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। একে ‘স্বাভাবিক’ ব্যাপার মনে করে সবাই নীরব থাকে। এই নীরব মৃত্যু মিছিলের মতো করে সারা বছর ধরে প্রতিদিনই ঘটে চলে। এর ফলে হাজার হাজার নিরীহ মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হন এবং তাদের পরিবার-পরিজন পড়ে অর্থনৈতিক ও সামাজিক দুরবস্থায়।
সরকারের তরফ থেকে নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার কোনো ব্যবস্থা তো নেইই, উপরন্তু কী কারণে নিয়মিতভাবে বাংলাদেশের সড়ক পথে এত দুর্ঘটনা ঘটছে সেটা নিয়ে কোনো তদন্ত তাদের পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকেও করা হয় না। দুর্নীতি যেখানে রাজত্ব করে সেখানে জনহিতকর বিষয়ে কোনো চিন্তা-ভাবনার পরিপূর্ণ অনুপস্থিতি অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। শুধু সরকারের একটি মন্ত্রণালয়ই নয়, সমগ্র সরকারের, যে কোনো সরকারেরই এই অবস্থা। এ কারণে কোনো সরকারের আমলেই এদিক দিয়ে পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয় না।
রাস্তার অবস্থা দুর্ঘটনার একটা কারণ। অনেক জায়গায়ই রাস্তা পরিবহন ঠিকমত চলার মতো প্রশস্ত নয় ও মেরামতির মধ্যে থাকে না। তাছাড়া অনেক জায়গায় রাস্তা এমন বাঁকিয়ে নেয়া হয়, যাতে এসব বাঁক পার হতে গিয়েই দুর্ঘটনা ঘটে। নানা তদবিরের কারণে একেকজনের জমি বাঁচিয়ে অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়ার ফলেই এসব বাঁক সৃষ্টি হয়। হাইওয়েতে এটা তেমন সম্ভব না হলেও ভেতরের অন্য অনেক সড়কে এ কাজ করা হয়ে থাকে।
গাড়ির চালকদের দুই অবস্থার জন্যই অবশ্য অধিকাংশ দুর্ঘটনার সৃষ্টি হয়। প্রথমত, এই চালকদের গাড়ি চালানোর উপযুক্ত ট্রেনিং থাকে না, তাদের কারও কারও লাইসেন্স থাকলেও সে লাইসেন্স তারা ট্রেনিংসম্পন্ন করে পায় না, সংগ্রহ করে ঘুষের মাধ্যমে। বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটে হাইওয়েতে এবং হাইওয়েতে গাড়ি চালানোর মতো যোগ্যতা এসব দুর্নীতিবাজ চালকের থাকে না। দ্বিতীয়ত, এই চালকদের মধ্যে যাদের হাইওয়েতে গাড়ি চালানোর যোগ্যতা থাকে তারা অনেকে এ ক্ষেত্রে কোনো রীতিনীতি না মেনে বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালায়। প্রায়ই দেখা যায়, এ কারণে গাড়ির সঙ্গে গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় অথবা অন্য গাড়িকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে।
কোন রাস্তায় কী গতিতে গাড়ি চালানো যাবে এর কোনো নির্দেশ কোথাও থাকে না। অর্থাত্ গাড়ির গতিসীমা নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা হাইওয়েগুলোতে নেই। ঢাকা শহরে যানজট নিয়ন্ত্রণের জন্য এখন একেক ধরনের গাড়ির জন্য স্বতন্ত্র লেন নির্ধারণ করে দেয়া সত্ত্বেও এই নিয়ম পালনের থেকে লঙ্ঘন হচ্ছে বেশি। এর ওপর সচিত্র রিপোর্ট সংবাদপত্রে প্রায়ই দেখা যায়। এই পরিস্থিতিতে হাইওয়েগুলোতে গাড়ির গতিসীমা অনির্ধারিত থাকা অবস্থায় চালকরা সে গাড়ির গতির ব্যাপারে দায়িত্বপূর্ণ আচরণ করবে, এটা মনে করা এক অবাস্তব ব্যাপার। কাজেই হাইওয়েগুলোতে বাস, ট্রাক, এমনকি প্রাইভেট গাড়িগুলোর গতি অনিয়ন্ত্রিত থাকে। এটা যে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ হবে, এটাই স্বাভাবিক।
এসব দুর্ঘটনার অন্য একটি বড় কারণ, যে গাড়িগুলো রাস্তায় চলাচল করে সেগুলোর অকেজো অবস্থা। দেখা যাবে যে, এগুলোর মধ্যে অনেক গাড়ি পরিবহনের উপযুক্ত নয়। এগুলো অনুুপযুক্ত এবং এদের মেরামতও ঠিকমত হয় না। কাজেই এসব গাড়ি জড়ধফ ধিত্ঃযু নয়। কিন্তু পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে এমন কোনো তদারকি ব্যবস্থা নেই, যাতে এই অকেজো বাস-ট্রাক রাস্তায় নামা বন্ধ করতে অথবা যেগুলো রাস্তায় নামে সেগুলোকে তারা পাকড়াও করতে পারে। এর মাধ্যমে বাস-ট্রাক মালিকরা দুর্ঘটনার শর্ত তৈরি করে নিজেদের মুনাফা কামায়। এই মুনাফার জন্য নতুন গাড়ি রাস্তায় না নামিয়ে এবং গাড়ির নিয়মিত মেরামত না করে এ ক্ষেত্রে যে বিনিয়োগ তাদের করা দরকার সেটা তারা করে না।
এ সবকিছুই এভাবে ঘটা ও চলতে থাকার কারণ পরিবহন মালিকরা নিজেরাই ক্ষমতাসীন লোক, অথবা ক্ষমতাসীন সরকারের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। এটা অবস্থান ও যোগাযোগের কারণে পরিবহন ক্ষেত্রে সাধারণ যাত্রীদের জন্য বিপদ তৈরির শর্ত তৈরি করে রেখে এরা নিজেদের বিনিয়োগের তুলনায় মুনাফার হার অনেক বেশি রাখতে সক্ষম হয়।
এখানে সড়ক ও লঞ্চ দুর্ঘটনা একই মূল কারণে ঘটে বলে এবং এর জন্য বাস ও লঞ্চ মালিকদের অপরাধমূলক তত্পরতা অবশ্যই দায়ী। কিন্তু এটাও আবার ঠিক যে, এ ব্যাপারে সরকারের উদাসীন্য এবং এর সঙ্গে সরকারি লোকদের স্বার্থ জড়িত থাকার কারণেই মালিকরা বেপরোয়াভাবে নিজেদের এই তত্পরতা চালিয়ে যায়। কাজেই সবদিক বিবেচনা করলে বলা যায়, যে নিয়মিত এবং অব্যাহত সড়ক দুর্ঘটনা বাংলাদেশের সড়ক ও নদীপথে ঘটে তার মূল দায়িত্ব সরকারের, সে সরকার যে দলেরই হোক। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর এবং তথাকথিত সিভিল সোসাইটির ভদ্রলোকদের কোনো আন্দোলন তো নয়ই, এমনকি উদ্বেগের লক্ষণ পর্যন্ত কোথাও দেখা যায় না।

No comments

Powered by Blogger.