এই নগরীর দিনরাত্রিঃ শীত জমে আছে ঘন হয়ে by রেজোয়ান সিদ্দিকী


আজ বুধবার। সকালের দিকে ঝকঝকে সূর্য উঠেছে। ফলে শীতের প্রকোপ গত দিনদিনের চেয়ে আজ কিছুটা কম। নাগরিকদের জবুথবু দশা খানিকটা কমেছে। তার আগের তিনদিন সূর্যের মুখ দেখা যায়নি। ফলে নগর জনপদে শীত জমাট বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে।
দেশের কোথাও কোথাও তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে গিয়েছিল। শিশু ও বয়স্কদের মধ্যে শীতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। দরিদ্র মানুষেরা শীতকে অভিসম্পাত দিচ্ছে। গত দিন-দশকে এবার শীত জানান দিয়েছে যে, শীত ঋতু আছে বাংলাদেশে। আমরা নাগরিকরা হিসাব কষতে বসেছি, এর আগে কোন বছর এমন শীত পড়েছিল। অনেকেই কম্পিউটারে বসে গুগলস ইয়াহু খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি, এ অঞ্চলে এর আগে আর কখন এতটা শীত পড়েছিল। এবার শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর গোটা উত্তর গোলার্ধ্বেই অনেক বেশি শীত পড়েছে। অনেক বেশি তুষারপাত ঘটেছে। অনেক বেশি বরফ পড়েছে। আবার দক্ষিণ গোলার্ধ্বে গরম পড়েছে বেশি, গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি।

পরিবেশবাদীর মধ্যে যারা গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে খুব সোচ্চার তারা হয়তো বলবেন, এটা প্রকৃতির খামখেয়ালি। প্রকৃতিকে অতি বেশি পীড়ন করায় সে এমন অদ্ভুত আচরণ করছে। কিন্তু এই শীতে তো পর্বতের শিখরে শিখরে আরও বেশি বরফ জমবে। ক্ষতিটা হয়তো পুষিয়েই যাবে। এই ভেবে কেউ কেউ খানিকটা আশ্বস্ত বোধ করতে পারেন। বিশেষ করে যারা কার্বনডাই-অক্সাইড নিঃসরণ কিছুতেই কমাতে রাজি নয়, তারা বাংলাদেশসহ দরিদ্র দেশগুলোকে এ যুক্তি দিতে পারবে।
কিন্তু বিগত বেশ কয়েক বছর যে নগরীতে এমন শীত পড়েনি, সেটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। আর শীত না পড়তে পড়তে আমরা শীতের প্রস্তুতি একেবারেই নিতে পারিনি। ফলে শীতকালে দুম করে যখন শীত এসেই পড়ল তখন একেবারে হি হি করে কাঁপতে শুরু করে দিয়েছি।
এখন যারা মাঝবয়সী নাগরিক, তাদের বেশিরভাগেরই শৈশব-কৈশোর কেটেছে পল্লীগ্রামে। সেখানে শীতের কমতি কখনও ঘটেনি। কার্তিক-অগ্রহায়ণেই শীত ঘরে ঘরে জানান দিয়েছে। লেপ-কাঁথা নামতে শুরু করেছে। চৌকির ওপর তোষক বা মোটা কাঁথার নিচে খড় বা নাড়া বিছিয়ে নিচ থেকে শীতের আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা হয়েছে। পা আর গরম হয় না। আইলায় তুষ বা কয়লা জ্বালিয়ে গনগনে আগুনের আইলা লেপ-কাঁথার নিচে দেয়া হয়েছে। ওর ওপরে পা রেখে বা পাশে পা ছুঁইয়ে পা গরম করা হয়েছে। কখনও কখনও আইলার আগুন থেকে ঘর পুড়ে ছাই হয়েছে।
এর ভেতর দিয়ে শৈশব-কৈশোর পেরিয়েছি। ভোরবেলা খেজুরের রসের হাঁড়ি নামানো হলে পরিবারের সবাই হাঁড়ির পাশে বসেছি। একগ্লাস করে খাব বলে। খেজুরের রস দিয়ে হয়েছে নলেন গুড়। শীতের সকালে লেপ-কাঁথার নিচে বসে নলেন গুড় দিয়ে মুড়ি খেয়েছি। খেজুরের গুড়ের ক্ষীর বা পায়েস। রাত জেগে মায়েরা বানিয়েছেন পিঠাপুলি। সকালে জমাটবাঁধা দুধের ভেতরে পুলি বা দুধ পিঠা। অগ্রহায়ণ-পৌষের রাতে বসেছে যাত্রার আসর। অভিভাবকের চোখে ধুলা দিয়ে গিয়েছি যাত্রা দেখতে—শীতের মধ্যে হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে। শীত বেশি পড়লে উইন্টার ভ্যাকেশন হতো স্কুলে। আমরা পায়ে হেঁটে খালার বাড়ি, ফুপুর বাড়ি, মামার বাড়ি বেড়াতে গেছি। সেখানেও পিঠার উত্সব। এভাবেই শীত ঋতু পার করে দিয়েছি।
নগরীর বৃক্ষ নিধন করে, সুউচ্চ ভবন তুলে, গাদাগাদি বসতি গেড়ে, কল-কারখানা বসিয়ে নগরী থেকে আমরা শীত তাড়িয়েছি। তাই শীত এলে বড় ভয়। থরহরি কম্প। কিন্তু এবার শীতকে দূরে ঠেলে রাখতে পারিনি। ঘন
কুয়াশা মেঘের কাছে বিশাল স্তর তুলে সূর্যের আলো ঠেকিয়ে দিয়েছে। নিচে বাতাসের উড়াউড়ি শীতকে ঠেলে ঠেলে ঘরের ভেতরে নিয়ে এসেছে। যেখানে সামান্য গাছপালা আছে সেখানেই যেন শীতের সৈনিকরা ব্যুহ রচনা করে দাঁড়িয়ে পড়েছে। তারপর হাওয়ার ইঙ্গিতে ছড়িয়ে পড়েছে জনপদে। শীতের অস্তিত্ব অনুভব করেছে নাগরিকরা।
রাতের দৃশ্য ছিল আরও বিষণ্ন। দৃষ্টিসীমা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে সুউচ্চ ভবনগুলো। সেখানকার জানালায় আলো আছে। ম্লান। মনে হলো, গোটা নগরীই যেন দখল করে নিয়েছে শীতের কুয়াশা।
এর বোধ করি আলাদা সৌন্দর্যও আছে। এটি শরত্, হেমন্ত বা বসন্তের রূপ নয়। ফুলে ফলে শোভিত নয়। কিন্তু এ সৌন্দর্য ভিন্ন। শান্ত, স্থির, সৌম্য, ঘন, আচ্ছাদিত। শীত যদিও কষ্ট দেয়, কিন্তু রূপ-স্বাদও কিছু দেয়। শীত আসুক শীতের মতো। শীত থাকুক শীতের মতো।

No comments

Powered by Blogger.