ভক্তিতেই মুক্তি by কবির হোসেন

রওশনারা ও রশিদা ফকিরানীর স্মরণে তিন দিনব্যাপী ৪৮ ঘণ্টার লালন সাধুসঙ্গ হয়ে গেল কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থানার প্রাগপুর গ্রামে ফকির নহির সাঁইজির হেমাশ্রমে। দিন কয়টি ছিল ২৭ থেকে ২৯ ফাল্গুন ১৪১৮ বঙ্গাব্দ। ৪৮ ঘণ্টার অধিবাস শুরু হয় গুরু মা রিজিয়া ফকিরানীকে ভক্তির বিনয়ী অনুমতির মাধ্যমে।


সাঁইজির নিয়মানুসারে বিকেল চারটায় শুরু হয় সাধুসঙ্গের মূল অধিবাস। অধিবাস শুরু হওয়ার আগেই ফকির লালন সাঁইজির পাঁচ ঘরের পসরা সাজানো হয় মাটির ঘটির মধ্যে পাঁচ ধরনের ফুল, ফল, মিষ্টি, গামছা ও চাল দিয়ে। সাঁইজিকে সামনে রেখে মূল প্রার্থনা আসনে পাঁচ সাধকের নামে মাটির ঘটির পসরাগুলো আসনে সাজান বুড়ি ফকিরানী। শুরু হয় পূর্ণ ৪৮ ঘণ্টার অধিবাস। আখড়াসংগীতের মাধ্যমে প্রবীণ ভেক খেলাফত সাধু গুরুদের যন্ত্রসংগীতে সুরের মূর্ছনায় ভরে ওঠে আখড়াবাড়ি। শুরু হয় সাঁইজির জীবলীলার করণ ও কারণ। এটি সাধুসঙ্গের আদি রীতি। আখড়াসংগীতের পরপরই শুরু হয় গুরুর প্রতি দৈন্য বাণী, আগমনী ও প্রবক্ত্য সংগীত। সাধু গুরুদের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই সাঁইজির দৈন্য ও আগমনী সংগীতের সাধনা শুরু হয় (এসো হে শ্রী গৌর চন্দ নিত্যানন্দ সঙ্গে করি, সময় গেলে সাধন হবে না, দিন থাকিতে দিনের সাধন কেন করলে না)—এই বাণীতে শেষ হয় দিনের অধিবাসকর্ম। শুরু হলো ৪৮ ঘণ্টার অধিবাস-পর্ব। গুরুকর্ম, দৈন্যকর্ম, প্রবক্ত্য, আগমনী, দিন ডাকা, চাল-পানি, সন্ধ্যা ভক্তি, বাল্যসেবা, গোষ্ঠ গান ও পুণ্যসেবা দিয়ে শেষ ৪৮ ঘণ্টা প্রহর। দিনের প্রথম অধিবাসকর্মের এক ঘণ্টা চা-মুড়ির বিরতির পর শুরু হয় সান্ধ্য পর্ব। চাল-পানি গ্রহণ করার পর শুরু হয় ভক্তিকর্ম। ফকির লালন সাঁইজির মূল বিষয় হচ্ছে গুরুবাদী ধর্ম। গুরুকে ভজনা করলেই নিজের দেহে অচিন মানুষকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। গুরু দৈন্য বাণীর মাধ্যমে সাঁইজির প্রতি আরাধনায় মগ্ন থাকেন সাধু গুরু ও ফকিরানী মায়েরা—(গুরু দেহাই তোমার মনকে আমার লওগো সুপথে, গুরু তুমি পতিতপাবন পরমও ঈশ্বর, গুরু আমারে কি রাখবেন তোমার চরণও দাসী)। দৈন্য বাণী উচ্চারণের মাধ্যমে সাঁইজিকে ডাকেন। বাদ্যযন্ত্র ছাড়াই সাধু-গুরুরা সন্ধ্যাকালীন দৈন্যসংগীত পরিচালনা করেন। এর ঘণ্টা খানেক পরই শুরু হয় আমন্ত্রিত সাধু গুরু ও শিল্পীদের লালন সাঁইজির গীতজ্ঞান সুধা মূল গানের আসর। আখড়াসংগীত পরিচালনা করেন শামছুল ফকির ও উদ্বোধনী দৈন্য করেন দরবেশ নহির শাহ। রাত চারটা পর্যন্ত চলে সাঁইজির দৈন্য গানের আসর (কোথায় হে দয়াল কাণ্ডারি, এসো হে ওপারের কাণ্ডারি, রাখিলেন সাঁই কুপজল করে আন্ধেলা পুকুরে)—সাঁইজির এই দৈন্য গানগুলো পরিবেশন করেন দরবেশ নহির শাহ, মোহরম শাহ, ওয়াজ শাহ, বুড়ি ফকিরানী, শামছুল ফকির, রওশন ফকির, মোজাম শাহ ও নাহিদা আক্তার। ভরা চাঁদরাতে সাধুসঙ্গের সংগীত চলে রাত তিনটা পর্যন্ত। ঢাকা থেকে আসা আমরা সবাই জোনাকির মধুর রাতে আদি ঘরানার সাধুসঙ্গের গানের আসর উপভোগ করি। সঙ্গের নিয়মানুসারে ভোর-সকাল থেকে শুরু হয় গোষ্ঠ গানের আসর। দিনকে স্বাগত জানানোই এই গোষ্ঠ গানের মূল উদ্দেশ্য। তুমি গোষ্ঠে চলো হরি মুরারি, আর আমারে মারিসনে মা, বনে এসে হারালাম কানায়—দিনের কর্মশক্তিকে সুদিয়ভাবে অর্জন করাই গোষ্ঠ গানের মুখ্য উদ্দেশ্য। লালন সাধুগুরু, ভক্ত অনুসারী ও আখড়াবাড়ির সবাই অংশগ্রহণ করে এই গোষ্ঠ গানে। গোষ্ঠ পর্ব শেষ হলেই শুরু হয় বাল্যসেবা। সকাল ১০টা থেকে শুরু হয় লালন সাঁই ও অন্য সাধু-গুরুদের গানের বিশ্লেষণপর্ব।
এই বিশ্লেষণ আসরে গানের বিভিন্ন বিষয়ে মতবিনিময় করেন সাধু-ফকিরেরা। বিশ্লেষণ আসরের মধ্য দিয়ে শেষ হয় পালাক্রমে যুগল মিলনের পর্ব। আসরের মধ্যমণি সাধু-ফকিরেরা। আনন্দ মোহরার মধ্য দিয়ে সাধু গুরুদের স্নান-গোসল শেষে শুরু হয় ধ্যান ভক্তি ও পুণ্যসেবার আয়োজন। এমনিভাবেই পরবর্তী ২৪ ঘণ্টাসহ মোট ৪৮ ঘণ্টা অতিবাহিত হয়। সাধুসঙ্গ সাধুসঙ্গ সর্বলোকে কয়, সাধুসঙ্গ পাওয়া মাত্র জীব পরম প্রাপ্তি হয়। সাঁইজির ভক্ত-অনুসারীরা এই বাণীর পরম প্রাপ্তির আশায় থাকেন আগামী সাধুসঙ্গের।

No comments

Powered by Blogger.