রাজনীতি-শুধু প্রশ্ন করলে হবে না, পথও দেখাতে হবে by আবদুল মান্নান

কিছুটা বাধ্য হয়েই যেতে হলো কক্সবাজারে। আমার প্রাক্তন ছাত্ররা তাদের দ্বিতীয় পুনর্মিলন এবং কনভেনশন করবে। দীর্ঘকাল আগে এরা আমার ছাত্র ছিল কিন্তু আমার প্রতি তাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা এতটুকু কমেনি। ওরা আমাকে তাদের মাঝে পেয়ে বেশ খুশি আর আমিও এত দিন পর তাদের মাঝ থেকে যে হারিয়ে যাইনি তা দেখে অভিভূত।


কক্সবাজারের বিলাসবহুল তারকাখচিত ‘ওশেন প্যারাডাইস’ হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। প্রায় সবাই পরিবার-পরিজন নিয়ে এসেছে। বিদেশ থেকেও এসেছে কেউ কেউ। এই অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যেরও আসার কথা ছিল কিন্তু তিনি খবর পাঠিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পরিস্থিতিতে তার পক্ষে আসা সম্ভব নয়। তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু রাখতে আর কিছু সংখ্যক ছাত্র নামধারী পাল্টা চেষ্টা করছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ কার্যক্রম ব্যাহত করতে তারা এখন অভিনব সুপার গ্লু থেরাপি ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। এটি হলো রাতের কোনো এক সময় শ্রেণীকক্ষ অথবা শিক্ষকদের কক্ষের তালায় তারা সুপার গ্লু ঢেলে দেয়, যাতে সকালে তালা খোলা না যায়। এটি তারা করছে পুলিশের উপস্থিতিতে এবং তাদের মুরব্বিদের পরামর্শে! অদ্ভুত কাণ্ড বটে।
আয়োজকদের প্রায় সবাই প্রতিষ্ঠিত। কেউ বড় মাপের ব্যবসায়ী তো কেউ আবার কোনো বহুজাতিক কোম্পানির শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা। কারও প্রতিষ্ঠানে ৩০ হাজার কর্মী কাজ করে, কেউবা বিদেশে বছরে কয়েক কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করে। তাদের এই সাফল্য দেখে শিক্ষক হিসেবে কার না ভালো লাগবে? তবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়, এ ধরনের ছাত্রের সংখ্যা এখন কমতির দিকে। এখনকার শিক্ষাটা অনেকটা সার্টিফিকেট বা গ্রেড-নির্ভর। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে যে কিছু জানার প্রয়োজন আছে তা বর্তমান কালের ছাত্ররা কদাচিৎ স্বীকার করে। আমার এই পর্যবেক্ষণ ভুলও হতে পারে।
রোববার সকালে হোটেলেই আমার কক্ষে কর্তৃপক্ষ দিয়ে গেল দৈনিক প্রথম আলো। প্রথম পৃষ্ঠায় সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহানের একটি উদ্ধৃতি যা তিনি ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেল পরীক্ষায় ভালো ফল করা শিক্ষার্থীদের এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে দিয়েছেন। অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলছেন, ‘এখন প্রায় সব শিক্ষার্থীই প্রকৌশলী ও চিকিৎসক হতে চায়। কিন্তু প্রায় কেউই সরকারি চাকুরে বা রাজনীতিবিদ হতে চায় না।’ তিনি আরও বলেন, আগের প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের অনেকেই সরকারি চাকুরে বা রাজনীতিবিদ হতে চাইত। অধ্যাপক রেহমান সোবহান স্যারের মন্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই।
স্যারের কথার সূত্র ধরে একটু আমার ছাত্রজীবনে ফিরে যাই। সেটি মধ্য ষাটের কথা। তখন আমার সঙ্গে যেসব ভালো ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছিল পেশা হিসেবে তাদের প্রথম পছন্দ ছিল সিএসপি হওয়া (বাংলাদেশে বর্তমানে তা বিসিএস)। একজন সিএসপি মানে একজন ডাকসাইটে আমলা এবং ধারণা করা হতো তারাই সরকার পরিচালনা করে। তখন সিএসপি হওয়ার জন্য যে প্রতিযোগিতা তা পাকিস্তানব্যাপী ছিল। এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান থেকে শফিউল আযম, কে এম আহসান, মনোয়ার উল ইসলাম প্রমুখ এই সিএসএস (সিএসপি হওয়ার পরীক্ষা) পরীক্ষায় সারা পাকিস্তানে প্রথম হয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ খুব ভালো ফল করেও শেষ পর্যন্ত নির্বাচিত হননি, কারণ পাকিস্তানিদের দৃষ্টিতে তিনি একজন রাষ্ট্রদ্রোহী। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর সাদউদ্দিনের কথা, যিনি খুব ভালো ফল করে সিএসপি হতে পারেননি, কারণ তিনি ছাত্রজীবনে বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তো আমাদের অনেকেই পণ করলাম সিএসপি পরীক্ষা দিতে হবে এবং ভালো ফল করে সরকারের অংশ হতে হবে। ঢাকা নিউ মার্কেট থেকে সংগ্রহ করলাম লাহোর থেকে প্রকাশিত ডগার ব্রাদার্সের সিএসপি হওয়ার সহজ উপায় (ইংরেজিতে)। সেটি আমাদের কাছে তখন একটি অমূল্য সম্পদ। সে বইয়ে সিএসপি পরীক্ষায় সম্ভাব্য কী কী প্রশ্ন আসতে পারে তা থেকে শুরু করে মৌখিক পরীক্ষার সময় কী রকম সাজগোজ করতে হবে তার বিস্তারিত বিবরণও ছিল। এর মধ্যে মেয়েদের একটি পত্রিকা (সম্ভবত ললনা) ঢাকার ইডেন কলেজের ছাত্রীদের ওপর একটি জরিপ চালিয়ে জানাল, বর হিসেবে সুন্দরী (তার সংজ্ঞা কী ছিল মনে নেই) মেয়েদের প্রথম পছন্দ সিএসপি, তারপর প্রকৌশলী, তিন নম্বরে ডাক্তার আর সব শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। জরিপের এমন একটি ফলাফল সামনে থাকলে কার না সিএসপি হওয়ার ইচ্ছা জাগে? অনেকটা নাওয়া-খাওয়া ভুলে প্রস্তুতি চলতে থাকল সম্ভাব্য হবু সিএসপিদের। এর মাঝে এসে গেল মুক্তিযুদ্ধ। প্রায় সব সম্ভাব্য সিএসপি চলে গেল যুদ্ধের ময়দানে। আগে দেশটাকে স্বাধীন করি তারপর দেখা যাবে কী হওয়া যায়। যুদ্ধ একদিন শেষ হলো। সঙ্গে সঙ্গে সিএসপি হওয়ার স্বপ্নটাও। আমার বিদ্যায় প্রকৌশলী বা ডাক্তার কোনোটাই হওয়া সম্ভব নয়। সাড়ে চার শ টাকার চাকরি নিয়ে প্রভাষক হিসেবে ঢুকলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। কোনো আক্ষেপ নেই। বরং তৃপ্তি আছে প্রচণ্ড। আর কোন পেশায় পাওয়া যাবে ছাত্রছাত্রীদের এমন শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা?
এবার আসি কেন প্রতিভাবানরা সরকারি চাকরিতে অথবা রাজনীতিতে আসে না, রেহমান সোবহান স্যারের সেই প্রশ্নে। শুরুতে তাঁর কথার সূত্র ধরে একটা প্রচলিত জোক বলে নিই। বলা হয় বর্তমানে সবচেয়ে ভালো ছাত্ররা পেশা হিসেবে বেছে নেয় ডাক্তারি বা প্রকৌশলী পেশাকে। তারপরের জনেরা হতে চায় এমবিএ। আর ছাত্রজীবনে সবচেয়ে যে খারাপ ছাত্র ছিল সে প্রথমে হয় ছাত্রনেতা, তারপর রাজনৈতিক নেতা এবং পরবর্তীকালে সেই সবার ওপর ছড়ি ঘোরায়। জোকটা নিশ্চয় রেহমান সোবহান স্যারের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে মিলে যায়। মেধাবী ছাত্ররা সরকারি চাকরিতে না যাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে অর্থনৈতিক দিকটা। একজন সরকারি চাকুরে তার চাকরিতে ঢোকার মুহূর্তে সর্বসাকল্যে বেতন হিসেবে বাড়ি নিয়ে যেতে পারে আনুমানিক আঠার হাজার টাকা। আমাদের আমলে যা ছিল আনুমানিক সাড়ে ছয় শ টাকার মতো। সত্তরের দশকে সেই অর্থ দিয়ে কোনো রকমে সংসার চালানো যেত, যা বর্তমানে প্রায় অসম্ভব। এ প্রশ্নের উত্তর আর কেউ দিতে না পারলেও রেহমান সোবহান স্যার ঠিকই দিতে পারবেন, কারণ তিনি অর্থনীতিবিদ। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কোনো বিভাগের শিক্ষকদের এ সমস্যার কিছুটা হলেও সমাধান করেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। আর অনেক সরকারি চাকুরে এই সমস্যার একটি চটজলদি সমাধান খোঁজার চেষ্টা করেছেন উপরি আয়ের মাধ্যমে।
রেহমান সোবহান স্যারের প্রত্যাশা অনুযায়ী মেধাবীদের সরকারে আনতে হলে তাদের সুযোগ-সুবিধা অনেকটা বাড়াতে হবে। বুঝতে হবে সরকারে যারা আসে তারা সরকার চালায়। এখানে যদি মেধাবীদের আকর্ষণ করা না যায় তা হলে প্রশাসনের গুণগত মান এখন যে নিম্ন পর্যায়ে আছে তা কখনো ভালো হবে না। একই কথা শিক্ষকতা পেশায় যাঁরা আসেন তাঁদের বেলায়ও প্রযোজ্য। একজন শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর। কারিগর ভালো না হলে তিনি যা তৈরি করেন তা কখনো ভালো হবে না। তা হবে নিম্ন বা মধ্য মেধার, যা বর্তমানে হচ্ছে। গ্রেড দিয়ে মেধা যাচাই করা নিছক বোকামি। অন্য কোনো পদ্ধতির কথা চিন্তা না করাতে এটা দিয়েই আমরা কাজ সারছি
রাজনীতি তো এখন আর রাজনীতিবিদদের হাতে নেই। সেটি পেশিশক্তি আর অর্থবলের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে বহু আগে। রাজনীতিতে তৃণমূল থেকে নেতৃত্ব গড়ে ওঠার দিন শেষ। নির্বাচন এলে এখন নিলামে নমিনেশন বিক্রি হয়, তা অনেকটা ওপেন সিক্রেট। রাতারাতি সাবেক সামরিক-বেসামরিক আমলা, ব্যবসায়ী, এলাকার বড় মাস্তান সবাই মনোনয়নপ্রত্যাশী হয়ে পড়েন। এখন জাতীয় সংসদে যাঁরা সদস্য আছেন তাঁদের কজন তৃণমূল থেকে এসেছেন যেমন এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু, সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীন, কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী বা আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তোফায়েল আহমেদ অথবা মতিয়া চৌধুরী? বিগত সংসদ নির্বাচনে একজন ছাত্রনেতাকে দেখা গেল বিলাসবহুল গাড়ির বহর নিয়ে তাঁর মনোনয়নপত্র জমা দিতে। এমন প্রার্থী সারা দেশে অসংখ্য। আর বছর দেড়েক পর বড় দলগুলো নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করবে। তখন দেশের মানুষ দেখবে কীভাবে বিত্তবানেরা কাতারবন্দী হচ্ছেন বড় বড় দলের পেছনে মনোনয়নের জন্য। এখানে মেধাকে সব সময় ছাড়িয়ে যাবে বিত্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ছাত্রজীবনে একবার ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল। সেবার ডাকসু ভিপি নির্বাচিত হয়েছিল ছাত্রলীগ হতে তোফায়েল আহমেদ (বর্তমানে সংসদ সদস্য)। তখন নির্বাচনের সময় সব ছাত্রসংগঠনই চেষ্টা করত সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রদের মনোনয়ন দিতে। আমি হলফ করে বলতে পারি তেমনটি এখন ঘটার সম্ভাবনা নেই। এখন সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, ধান্ধাবাজ, টেন্ডারবাজ, সুপারগ্লুবাজ আর ফেরেপবাজেরাই মনোনয়ন পাবে। এরাই একদিন দেশের রাজনীতিকে আরও কলুষিত করবে। এই লেখার মাধ্যমে আমি রেহমান সোবহান স্যারের বক্তব্যকে কোনো প্রকারে প্রশ্নবিদ্ধ বা বিতর্কিত করতে চাইছি না, তবে বাস্তব চিত্রটা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আশা করব তাদের মতো বিদগ্ধ ব্যক্তিরা কেবল সমস্যার কথা না বলে তার সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করবেন। আমাদের মতো অভাজনদের হাজার কথা তাদের এক কথার সমতুল্যও নয় ।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে শিক্ষক, ইউল্যাব, ঢাকা।

No comments

Powered by Blogger.