ভিওআইপি ব্যবসায় হরিলুটঃ নিয়ন্ত্রক সংস্থাকেই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে


সরকারি প্রতিষ্ঠানের রহস্যজনক নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে একটি অর্থকরী খাত থেকে লোপাট হয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। যথারীতি এই টাকা ভাগবাটোয়ারা হচ্ছে নিম্নপর্যায়ের লুটেরা থেকে শীর্ষমহল পর্যন্ত। এ ধরনের মোটা দাগের দুর্নীতি এদেশে নতুন কিছু নয়।
কোনো কোনো খাতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন যুক্ত থাকায় তার অনেকটাই গোপন থেকে যায়; মাঝে-মধ্যে দু’একটা ফাঁস হয়ে গেলে আন্দাজ করা যায়, বস্তাকাটা ইঁদুর ঘাপটি মেরে আছে শক্তপোক্ত গুদামের ভেতরেই। সম্প্রতি এ ধরনের একটি ঘটনার জন্য অভিযোগের আঙুল উঠেছে সরকারি প্রতিষ্ঠান বিটিআরসির দিকে। অবৈধ ভিওআইপি (ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল) ব্যবসা থেকে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিলেও সংস্থাটি কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নিচ্ছে না। অথচ বিটিআরসিই ভিওআইপি ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

জানা গেছে, প্রশাসনের জ্ঞাতসারেই অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা থেকে বছরে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা লুটে নিচ্ছে একটি প্রভাবশালী চক্র। একসময় এই হাইটেক ব্যবসা গোপনে চললেও এখন তা অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। মাঝে-মধ্যে বিটিআরসি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে লোক দেখানো অভিযান চালালেও তাতে কোনো ফল হচ্ছে না। অভিযোগ আছে, খোদ বেড়াই সাবড়ে নিচ্ছে ক্ষেতের ফসল। সংস্থাটির শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তার মদতে প্রভাবশালীরা নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছে এই অবৈধ বাণিজ্য। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান র্যাব হানা দিয়েও দমন করতে পারছে না এই শক্তিশালী চক্রকে। এক হিসাবে দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে আন্তর্জাতিক কল হচ্ছে ৬ কোটি মিনিট। বছরে ৩ সেন্ট হারে এ খাত থেকে আয় হওয়ার কথা ৬৫ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার। কিন্তু দৈনিক যে টার্মিনেশন হচ্ছে তার মাত্র ৪১ দশমিক ৬৭ শতাংশ আসে বৈধ পথে, বাকিটা অবৈধ কল টার্মিনেশনের মাধ্যমে। বৈধ কল টার্মিনেশন থেকে সরকারের রাজস্ব আয় ২৭ কোটি ৩৭ লাখ ৫০ হাজার ডলার। বাকি প্রায় সাড়ে ৩৯ কোটি ডলার যাচ্ছে অবৈধ কল টার্মিনেশন ব্যবহারকারীদের পকেটে। এ অবস্থায় বিটিসিএলের দৈনিক আন্তর্জাতিক কলের সংখ্যা কমে এসেছে অবৈধ ব্যবসার কবলে পড়ে। এতসবের পরেও জেনেশুনে বিটিসিএল বা বিটিআরসি কল সেন্টারের লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে কোনো রকম যাচাই-বাছাই ছাড়াই ভুয়া ট্রেড লাইসেন্স দিচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। সমঝোতার মাধ্যমে এভাবে লাইসেন্স প্রাপ্তি অবৈধ ব্যবসা বাড়ার অন্যতম প্রধান কারণ। বর্তমানে বাংলাদেশে পাঁচ শতাধিক কল সেন্টারের অনুমোদন থাকলেও মাত্র চার থেকে পাঁচটি ছাড়া অন্যগুলো অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। প্রযুক্তিগত সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে ক্রমশ জমজমাট হচ্ছে এ ব্যবসা। বাইরে থেকে টের না পেলেও গোটা বাণিজ্যটির স্বরূপ হচ্ছে—‘বাইরে ফিটফাট, ভেতরে সদরঘাট’।
সম্প্রতি অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার বিরুদ্ধে বিটিআরসির নয়ছয় আচরণে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিও অভিযোগ এনেছে। কমিটির সভাপতি বলেছেন, বিটিআরসি চিহ্নিত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযান চালাচ্ছে না। একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি গঠন করায় যে কোনো সুফল বয়ে আনেনি, সে কথাও বলেছেন তিনি। বিটিসিএলের অভিযোগের তীরও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির দিকে। তবে টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, এই উভয় সংস্থার সহযোগিতা ছাড়া অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা চালানো অসম্ভব। এদিকে অবৈধ ভিওআইপি ধরতে র্যাবের বিশেষ টিমও বিটিআরসির কাছ থেকে যথেষ্ট সাড়া পাচ্ছে না বলে অভিযোগ আছে। এ সংক্রান্ত একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক আমার দেশ-এ ২১ জানুয়ারি।
উল্লেখ্য, জরুরি সরকারের আমলে শক্ত পদক্ষেপ নেয়ায় ব্যবসাটি বন্ধ হয়েছিল। কিন্তু বছরখানেক আগে থেকে বিটিআরসির শিথিলতার সুযোগে তথা যোগসাজশে তা আবার শুরু হয় পুরোদমে। গত তিন মাসে যা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। সরকার এ ব্যাপারে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও বিটিআরসি যথাযথ দায়িত্ব পালন করছে না। ফলে স্বভাবতই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, অদৃশ্য খুঁটির জোরেই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে এই নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এরই মধ্যে মন্ত্রিসভা অবৈধ ব্যবসার বহর কমিয়ে আনতে তথা এ ব্যবসায় প্রতিযোগিতা বাড়াতে নতুন আরও কয়েকটি কোম্পানিকে আন্তর্জাতিক কল আদান-প্রদানের জন্য লাইসেন্স দেয়ার কথা বলেছে। কিন্তু অভিজ্ঞমহল মনে করছেন, এতে কোনো সমাধান হবে না। কারণ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি আন্তরিক না হলে কাজে আসবে না কোনো পদক্ষেপই। কাজেই অসুখ যার, ওষুধ গেলাতে হবে তাকে। অর্থাত্ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিকেই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে শক্ত হাতে।

No comments

Powered by Blogger.