বাংলাদেশে নজরুলচর্চা by ড. তুহিন ওয়াদুদ

চলতি বছর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে সারা দেশ যে পরিমাণ উৎসবমুখর হয়ে উঠেছিল, তা কবি নজরুলের জন্ম দিবস উদ্যাপনে লক্ষ করা যায়নি। রবীন্দ্রনাথের রচিত গান আমাদের জাতীয় সংগীত। কিন্তু নজরুলের মতো রাষ্ট্রীয় মর্যাদা রবীন্দ্রনাথকে আমরা দিইনি।


তার পরও তাঁর শিল্পের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কয়েক দিন আগে যে রবীন্দ্র উৎসব হলো, তা আমাদের জন্য গর্বের। কিন্তু বাংলাদেশের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামকে নিয়ে মলিন আনুষ্ঠানিকতা চোখে পড়ার মতো।
কবি নজরুল ইসলামের মূল্যায়ন অন্য সব কবির চেয়ে ভিন্ন মাত্রায় হওয়া জরুরি। বাংলাদেশ যখন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শোষণের শিকার ছিল, তখন কবি নজরুল ইসলাম তাঁর লেখনীর দ্বারা ব্রিটিশ শাসন-শোষণ-নির্যাতন-নিপীড়ন-বঞ্চনার বিরোধিতা করতে গিয়ে কারাবাসে গিয়েছিলেন। জাতীয় পর্যায়ে শুধু রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে নয়, তিনি বিশ্বমানবতার মুক্তির লক্ষ্যেও অনমনীয় প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা তাদের ঔপনিবেশিকতা থেকে ভারতবর্ষকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল। ব্রিটিশদের বিরোধিতায় যে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার মধ্যে নজরুলের ভূমিকা ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক জাল ছিন্ন করতে তিনি একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে কাজ করেননি, তিনি মানুষের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী চেতনা নির্মাণে কাজ করেছেন। তিনি অন্যায়, শোষণ ও সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের বিরুদ্ধে লিখে গেছেন। তাঁর লেখনীর কার্যকারিতা আজ অবধি কমেনি। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ বিভাগের পর থেকে একাত্তর পর্যন্ত পাকিস্তানি আগ্রাসন আমাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক বিকাশের পথে যে বাধা সৃষ্টি করেছিল, এর থেকে উত্তরণের জন্যও আমাদের খুব বেশি প্রয়োজনীয়তা মিটিয়েছিল নজরুলের সাহিত্য। ব্রিটিশদের সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে রচিত নজরুলের কবিতা ও গান মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে গিয়েছিল। সেই গান ও কবিতা পাকিস্তানি শোষকদের বিরুদ্ধেও গণমানুষকে আন্দোলিত করেছিল। তাঁর রচিত 'চল্ চল্ চল্!/ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল', 'কারারঐ লৌহকবাট_ভেঙে ফেল কর রে লোপাট' কিংবা 'দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু দুস্তর পারাবার' কিংবা 'আমরা শক্তি আমরা বল/আমরা ছাত্রদল'_এসব উদ্দীপনামূলক গান ও কবিতা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনচেতা মানুষের রক্তে বিপ্লবের বৃক্ষ রোপণ করে দিয়েছিল।
কবি নজরুল ইসলামকে ঐতিহাসিক কারণে কিংবা তাঁর সাহিত্য ও অনন্য গানের কারণে অনুশীলন করা জরুরি শুধু তা নয়, বরং নজরুল ইসলামকে আমাদের সমাজে এখনো অনিবার্যরূপে প্রয়োজন। আমাদের সমাজে এখনো অন্যায়-শোষণ-নির্যাতন-সাম্প্রদায়িকতা-ব্যক্তিস্বার্থ-হিংসা-ঈর্ষা-অসহিষ্ণুতা প্রকটতর হয়ে উঠছে। সমাজের নানা অনাচার থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য শুধু আইন করলেই হবে না, এর জন্য প্রয়োজন আমাদের চেতনাগত পরিবর্তন। কবি নজরুলের সৃষ্টি আমাদের চেতনায় ও মননে ইতিবাচক পরিবর্তন এনে দিতে পারে। অন্যায়ের সঙ্গে কোনো আপস নয়_আমরা যদি নজরুলের জীবন ও সাহিত্য থেকে এই আদর্শটুকু গ্রহণ করতে পারি, তাতেও সমাজ অনেকখানি স্বচ্ছতার দিকে এগিয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের দেশে নজরুল অনুশীলন অত্যধিক মাত্রায় কম হচ্ছে। নজরুল ইনস্টিটিউট নজরুলচর্চায় যে অবদান রাখছে, তাও খুব সামান্য। বাংলা একাডেমীও উল্লেখযোগ্য কোনো অবদান রাখছে না। বলা যায়, জাতীয় পর্যায়ে নজরুলচর্চা আমাদের দেশে হচ্ছেই না।
জাতীয় কবির নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি নজরুলজয়ন্তীতে যেসব আয়োজন করে থাকে, তা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের চেয়ে অনেক বড় এবং অনেক মানসম্মত। দেশব্যাপী ব্যাপক মর্যাদায় রাষ্ট্রীয়ভাবে এ বছর নজরুলজয়ন্তী উদ্যাপিত হয়নি। যেমন_রংপুর বিভাগীয় প্রশাসন ও জেলা প্রশাসন এ বছর নজরুলকে ঘিরে কোনো অনুষ্ঠানেরই আয়োজন করেনি। জাতীয় কবির প্রতি এ উপেক্ষা দুঃখজনক। নজরুলজয়ন্তী উপলক্ষে ত্রিশালে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা কিংবা নজরুল ইনস্টিটিউট নজরুলকে নিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেও নজরুলকে নিয়ে গবেষণা কিংবা তাঁর জন্ম-মৃত্যু দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় অর্থপূর্ণ করে পালন করার ক্ষেত্রে আমাদের অন্যতম ভরসা এখন নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়।
কবির স্মৃতিবিজড়িত ময়মনসিংহের ত্রিশালের এক প্রত্যন্ত গ্রামে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠালাভের পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টি নজরুলের জন্ম ও মৃত্যু দিবস উদ্যাপনে পরিকল্পিত ও গঠনমূলক অনেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি সত্যিকার অর্থে কবির নামের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি মর্যাদা প্রদর্শন করছে। সেখানে প্রতিটি বিভাগে তিন ক্রেডিট আওয়ারের একটি করে কোর্স বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি নজরুলবিষয়ক বিভিন্ন কাজে বিশেষজ্ঞ দুজনকে ২০০৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর সম্মাননা প্রদান করে আসছে। এখানে অনুষ্ঠানের সবচেয়ে গঠনমূলক দিকটি হচ্ছে অনেকগুলো সেমিনারের আয়োজন করা। এ বছর তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে মোট ১০টি প্রবন্ধ পাঠ করা হয়েছে এবং ১০ জন আলোচক এই প্রবন্ধগুলোর ওপর আলোচনা করেছেন।
প্রাথমিক-মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণী পর্যন্ত কবি নজরুল ইসলাম পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত। সেখানে কোথাও নজরুলের একটি কবিতা কিংবা একটি প্রবন্ধের মাধ্যমে নজরুলকে অধ্যয়ন করা হয়ে থাকে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যেখানে বাংলা বিভাগ রয়েছে, সেখানে নজরুল সাহিত্য থেকে স্বল্প পরিসরে কবি নজরুলকে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সংগীত বিভাগ থাকলে সেখানে নজরুলের গান পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত আছে। কিন্তু জাতীয়ভাবে নজরুলচর্চার কোনো ব্যবস্থা নেই। নজরুল আমাদের পুঁথিগত হয়ে উঠেছেন। আমরা তাঁকে চেতনায় ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছি।
লেখক : শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর এবং গবেষক
wadudtuhin@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.