সংলাপ-ড. নুরুল ইসলামের অর্থনীতির ক্লাসে এক বিকেল by আবদুল মান্নান

নূরুল ইসলাম বাংলাদেশে খুবই পরিচিত নাম। হাটবাজারে ডাক দিলে দু-চারজন ফিরে তাকাবে। তবে দুজন নূরুল ইসলাম আছেন, যাঁদের খ্যাতি তাঁদের কর্মের কারণে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বাইরেও বিস্তৃত হয়েছে। এঁদের একজন আমাদের জাতীয় অধ্যাপক ডা. নূরুল ইসলাম, অন্যজন বিশিষ্ট অথনীতিবিদ ড. নুরুল ইসলাম (তিনি এই বানানই লিখেন)।


প্রথমজন দেশে থাকেন আর দ্বিতীয়জন দীর্ঘদিন ধরে থাকেন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে। বছরে একবার দেশে আসেন। তাঁদের বাড়িও আবার ঘটনাচক্রে চট্টগ্রামের একই এলাকায়। ডা. নূরুল ইসলাম দেশে থাকেন বলে তাঁর পরিচিতি অনেক বেশি। আর ড. নুরুল ইসলামের পরিচিতি সুধী মহলে সীমাবদ্ধ। কিন্তু এ দেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাসের সঙ্গে তাঁর নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে।
ড. নুরুল ইসলাম পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে, সেই ১৯৫৫ সালে। পরে যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তান অর্থনৈতিক উন্নয়ন সংস্থায় (Pakistan Institute of Development of Economics) একজন গবেষক হিসেবে। সে সময় তিনি কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে চরম অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানকে পরিকল্পিত শোষণ ও বঞ্চনা। সে সময় ড. ইসলাম তাঁর অবস্থান থেকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যমূলক নীতির প্রতিবাদ করেছেন এবং গবেষণার মাধ্যমে তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা ঘোষণা করেন, যার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের ইতিহাস। সত্তরের নির্বাচনে এই ছয় দফাই হয়ে ওঠে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার। এ সময় বঙ্গবন্ধু অন্য বাঙালি অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে ড. নুরুল ইসলামের শরণাপন্ন হন ছয় দফার অর্থনৈতিক দফাগুলোর সহজ সরল ব্যাখ্যার জন্য। একাত্তরের মার্চ মাসে যখন জেনারেল ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করার জন্য ঢাকায় আসেন, তখন আলোচনার বাইরে যে কয়েকজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু আলোচনায় যাওয়ার আগে প্রস্তুতিমূলক পরামর্শ করতেন, তাঁদের মধ্যে ড. ইসলাম ছিলেন অন্যতম। ২৬ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকায় গণহত্যা শুরু করলে তিনি এক ছাত্রনেতার সহায়তায় ভারতে চলে যান। সেখান থেকে যুক্তারাষ্ট্রে গিয়ে বাংলাদেশের স্বাধনীতার পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে অগ্রনী ভূমিকা রাখেন।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে ড. নুরুল ইসলাম বাংলাদেশে ফিরে আসেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পর তিনি ড. নুরুল ইসলামকে খুঁজে বের করেন এবং বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেন এবং তাঁর হাতে নতুন স্বাধীন দেশের একটি যথোপযুক্ত পরিকল্পনা কমিশন গঠনের দায়িত্ব অর্পণ করেন। বঙ্গবন্ধুর একটি বড় গুণ ছিল, কোনো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব কাকে দিলে কাজ হবে তা তিনি বুঝতে পারতেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যাঁরা সে সময় কাজ করেছেন, তাঁরা এখনো বলেন, তিনি তাঁর দপ্তরকে যে ধরনের মানুষ দ্বারা সাজিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে অন্য কোনো শাসক তা পারেননি। ১৯৭৪ সালের শেষের দিকে ড. নুরুল ইসলাম পরিকল্পনা কমিশন ছেড়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ফেলোশিপ নিয়ে চলে যান।
১৫ নভেম্বরের অপরাহ্নে প্রথম আলো সভাকক্ষে কিছুটা বৈঠকি আমেজে ড. নুরুল ইসলাম বসেছিলেন কয়েকজন অর্থনীতিবিদ, সাংবাদিক ও লেখককে নিয়ে। প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান পরিচয় পর্বে কিছুটা হালকা মেজাজে সবাইকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় বললেন, ‘এখানে যাঁরা সমবেত হয়েছেন, তাঁদের দুভাগে ভাগ করা যায়। এক ভাগ ঠিক করেছেন পত্রিকায় কলাম লিখে দেশকে পথ দেখাবেন আর অন্য দল মধ্যরাতে দেশের মানুষকে জাগিয়ে রেখে টক শো করে দেশ উদ্ধার করবেন।’ ড. ইসলাম হাসতে হাসতে বললেন, এখন বুঝি বাসায় কেন লোকজন এত দেরিতে সকালে ঘুম থেকে ওঠে। আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম সেই বৈঠকে। ড. ইসলাম আরো জানালেন, আগের দিন তিনি এমন একটা বৈঠক করেছিলেন একাত্তর পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে। সেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। তাঁদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন তাঁরা ইতিহাস পড়েন কি না। তাঁরা জানালেন পড়েন না। এ ব্যাপারে তাঁদের তেমন কোনো আগ্রহ নেই। তিনি অবাক হয়েছেন এমন অপ্রত্যাশিত উত্তর শুনে।
এরপর ড. ইসলাম আমাদের কাছে তিনটি বিষয়ের ওপর মতামত জানতে চাইলেন। এক. তরুণ প্রজন্ম কেন ইতিহাস পড়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে; দুই. ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এবং বাংলাদেশের অর্থনীতি। তাঁর প্রশ্ন ছিল, সবাই বলে বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা খুবই খারাপ। তারপরও শুনি এই খারাপের মধ্যেও এ দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। তা কীভাবে হয়?
সব বিষয় নিয়ে আলোচনা দীর্ঘায়িত হবে বলে লেখাটা একটি বিষয়ে সীমাবদ্ধ রাখতে চাই। সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং বর্তমান সময়ের একটি বহুল আলোচিত বিষয় জ্বালানিতে ভর্তুকি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে একজন বাম ঘরানার অর্থনীতিবিদ জানালেন, এই প্রবৃদ্ধির পেছনে তিনটি খাতের অবদান সবচেয়ে বেশি। এক. ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, দুই বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশির পাঠানো অর্থ, তিন আমাদের তৈরি পোশাকশিল্প। তাঁর মতে, এই তিনটি খাতে সরকারের তেমন কোনো ভূমিকা নেই।
ভর্তুকি প্রসঙ্গে আলোচনার অবতরণ করলেন ড. ইসলাম নিজেই। সরকার সম্প্রতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে জ্বালানি তেলের ওপর ভর্তুকি কমিয়ে তেলের মূল্য বৃদ্ধি করবে। বর্তমানে সরকার সব ধরনের জ্বালানির ওপর বছরে ২০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে থাকে। গত অর্থবছরে পেট্রোলিয়াম করপোরেশন আট হাজার ২০০ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির ফলে তেল খাতে লোকসানের পরিমাণ চার হাজার কোটি টাকা কমবে। এ ব্যাপারে সবাই একমত, তেলের এই মূল্য বৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশে যখন কোনো পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করা হয় অথবা বাড়ে, তখন সরকার থেকে দুটি কথা বলা হয়। এক. আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধি এবং দুই বাংলাদেশে কোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের চেয়ে কম রাখলে সেই পণ্য ভারতে পাচার হয়ে যাবে। অন্য পণ্যের কথা না হয় বুঝলাম কিন্তু তেল কীভাবে আমাদের সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরীদের ফাঁকি দিয়ে পাচার হবে, তা বুঝতে অনেকেই অক্ষম। আরেকটি কথা প্রায়ই বলা হয়, পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আমাদের দেশে অমুক পণ্যের মূল্য এখনো কম। যে কথাটি কখনো বলা হয় না, ওই দেশের সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা আমাদের তুলনায় দ্বিগুণ।
ড. ইসলামের মতে, আমাদের দ্রুত ভর্তুকি সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তিনি বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলের একটি ঘটনা বললেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর সঙ্গে একমত হয়েছেন সারের ওপর দেয় ভর্তুকি কমাতে হবে। পরদিন তা ঘোষণা করা হবে। মাঝরাতে বঙ্গবন্ধু ড. ইসলামকে ফোন করে জানালেন ভর্তুকি কমানোর সিদ্ধান্তটা আগামী কাল জানানো যাবে না। কারণ, তাঁর কেবিনেটের প্রায় সব সদস্যই এই সিদ্ধান্তের ঘোর বিরোধী। ড. ইসলাম বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করলেন তাঁর কেবিনেটের সদস্যদের সঙ্গে তিনি কথা বলতে চান। পরদিন বৈঠকের ব্যবস্থা হলো। ড. ইসলাম একজন ঝানু শিক্ষকের মতো সবাইকে বোঝাতে সক্ষম হলেন কেন ভর্তুকি কমানোর প্রয়োজন আর না কমালে সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর কী বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে। সেবার ভর্তুকি কমানো হয়েছিল এবং কেবিনেট সদস্যরা তা জনগণকে ব্যাখ্যা করেছিলেন। বর্তমানে সরকারের কোনো সিদ্ধান্তকে জনগণের সামনে তুলে ধরার তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। জ্বালানির ক্ষেত্রে জ্বালানি উপদেষ্টা মাঝেমধ্যে দু-একটা কথা বলেন বটে, তবে বাজারে যেকোনো কারণেই হোক জনগণের কাছে তাঁর ইমেজ খুব ভালো নয়।
ড. ইসলামের মতে, ঠিক করতে হবে টাকা ছাপিয়ে বা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সরকার তার দৈনন্দিন ব্যয় মেটাবে, নাকি সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করে এবং ভর্তুকি কমিয়ে সেই কাজটি করবে। প্রথমটি করলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে আর দ্বিতীয়টি করলে মানুষের সাময়িক কষ্ট হবে তবে তার দীর্ঘমেয়াদি ফল প্রথম ব্যবস্থার চেয়ে ভালো হবে। বর্তমানে সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক খরা চলছে। ইউরোপে সরকারের পতন হচ্ছে, দেশ দেউলিয়া হচ্ছে। সবাই বলছে, বিপর্যয় রুখতে সরকারের কৃচ্ছ্র সাধনের বিকল্প নেই। ড. ইসলামের মতো অনেকেই সে দিন বললেন, সাংসদদের বিনা শুল্কে দামি গাড়ি আমদানি করতে দেওয়ার কোনো যুক্তি নেই। মন্ত্রিপরিষদেও সদস্যরা আয় কর দেবেন একটি ভালো সিদ্ধান্ত। তবে এই সিদ্ধান্ত সরকারের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়া উচিত। সরকারকে আয় বাড়ানোর আরও নতুন নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবনের বিকল্প নেই।
আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়লে আমাদের দেশে তেলের দাম বাড়াতে হবে, সেই যুক্তি এক শ ভাগ সত্য নয়। হিসাব করে দেখতে হবে, বিপিসির অদক্ষতা দাম বাড়ার পেছনে কতটুকু অবদান রাখে। দুটি জাহাজ কুয়েত থেকে এল জাহাজভর্তি তেল নিয়ে। দুই সপ্তাহ সেই জাহাজ বহিঃসমুদ্রে ঘোরাফেরা করল। কারণ, তেল রাখার জায়গা নেই। প্রতিদিন বাড়তি জাহাজ-ভাড়া বাবদ লাখ লাখ টাকা ডেমারেজ (ক্ষতিপূরণ) গুনতে হলো। এই অর্থের জোগানদাতা নিশ্চয় ভোক্তা। এ রকম উদহারণ অনেক। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এখনো অনেক অপদার্থ লোকজন বসে আছে। তাদের কারণে মানুষের চরম ভোগান্তি হয়। ভর্তুকি দিতে হবে। তবে তা কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহূত জ্বালানিতে। কৃষকেরা এখনো আমাদের অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি। জ্বালানি তেলের মূল্য, ভর্তুকি নিয়ে বিরোধী দল বেহুদা রাজনীতি করছে। কেউ বলছেন, ক্ষমতায় গেলে দাম কমাবেন। ক্ষমতায় যখন ছিলেন তখন কি কমাতে পেরেছেন? একজন আবার এক কাঠি ওপরে। ঢাকা স্টক একচেঞ্জের সামনে গিয়ে বললেন, ক্ষমতায় গিয়ে পুঁজিবাজারে যাঁরা পুঁজি হারিয়েছেন, তাঁদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। যিনি বলছেন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক শিক্ষক। বাংলাদেশে সাংঘর্ষিক রাজনীতি নিয়ে ড. ইসলামের মন্তব্য ‘বাঙালি খাদের কিনারায় গিয়ে কীভাবে ফিরে আসতে হয় তা ঠিকই জানে।’
সব শেষে প্রথম আলো কর্তৃপক্ষকে এ ধরনের একটি বৈঠক আয়োজন করার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ। অনেক দিন এরকম একজন ভালো শিক্ষকের ক্লাসে বসিনি।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে শিক্ষক, ইউল্যাব, ঢাকা।

No comments

Powered by Blogger.