বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শিফট চালুর এটাই সময় by ড. সৌমিত্র শেখর

চারদিকে উৎসবের আমেজ। ঈদুল ফিতর, দুর্গাপূজা এবং এর কিছুদিন পর ঈদুল আজহা_ধর্মীয় এই অনুষ্ঠানগুলো এবার খুবই কাছাকাছি সময়ে প্রায় হাত ধরাধরি করে বাঙালির সামাজিক জীবনকে আনন্দময় করে তুলেছে। এ আনন্দের সাগরে সাঁতার কাটবে নিশ্চয়ই আমাদের সেই সোনার মুখগুলো, যারা এবার উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পাস করেছে।


তারা কিন্তু এই কিছুদিন আগেই আরেকটি উৎসবে মেতে উঠেছিল। সে দিনটা ছিল ২৭ জুলাই ২০১১। এদিন প্রকাশিত হয় উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট ও সমমানের পরীক্ষার ফল। এবার ১০টি শিক্ষা বোর্ডে পাসের গড় হার ৭৫.০৮ শতাংশ, যা গতবারের চেয়ে ০.৮ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে মাদ্রাসা বোর্ডে পাসের হার সবার ওপরে_৮৯.৫৭ শতাংশ। পাসের গড় হার বাড়ার পাশাপাশি জিপিএ ৫ পাওয়া সফল পরীক্ষার্থীর সংখ্যাও এবার বেড়েছে। গতবার জিপিএ ৫ পেয়েছিল ২৮ হাজার ৬৭১ জন পরীক্ষার্থী, এবার গতবারের চেয়ে বেশি জিপিএ ৫ পেয়েছে ১০ হাজার ৭৬৫ জন। জিপিএ ৫ প্রাপ্তির বিপরীতে কেউ পাস করেনি এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও কমেছে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এবার মফস্বল থেকে পরীক্ষায় ভালো ফল করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। তাই গত ২৭ জুলাইয়ের উৎসবে মেতেছিল গ্রাম ও শহরের উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ কৃতী পরীক্ষার্থীরা। ভালো ফল শুধু শহরের কলেজ-মাদ্রাসাগুলোতেই হয়_এ কথা ভুল প্রমাণিত হতে চলেছে। সৃজনশীল প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা গ্রহণের কারণে গ্রামের পরীক্ষার্থীরা তাদের মেধার প্রমাণ রাখার সুযোগ পেয়েছে বলে আমার মনে হয়। এই পদ্ধতি ঠিকমতো চালাতে পারলে ভালো ফল শুধুই শহরকেন্দ্রিক_এই মিথ মিথ্যা প্রমাণিত হবে অল্প সময়ের মধ্যেই।
উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় এবার যারা জিপিএ ৫ পেয়েছে, তাদের সবারই কি উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত? ফল প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই অনেকে মন্তব্য করেছেন সফল শিক্ষার্থীদের পড়ার মান নিয়ে। অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, এরা কোথায় ভর্তি হবে? আমি এই প্রথম প্রশ্ন নিয়ে মোটেই ভাবিত নই। পড়ার মান কমে যাচ্ছে_এটা আমি বহুকাল ধরে শুনে আসছি। এ কথা বোধ করি থামানোর নয়। কিন্তু এটাও সত্য, ২০ বছর আগে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার যতটুকু ব্যাপ্তি ছিল, এখন সে তুলনায় ব্যাপ্তি বেড়েছে অনেক। গভীরতা কতটুকু বেড়েছে, সেটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে বটে; কিন্তু সে আলোচনার সুযোগ এখানে নেই, থাকলে তা করা যেত। আমি আজ বলতে চাই, এবার উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় যারা ভালোভাবে পাস করেছে, সত্যি তাদের স্থান সংকুলান করা কঠিন। সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত মেডিক্যাল কলেজ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাইরে উচ্চশিক্ষার জন্য এখনো আমাদের পরিবারগুলো ও সফল ছাত্রছাত্রীরা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে পছন্দের শীর্ষে ভাবতে চায় না। তার কারণ অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে হয় অতি অর্থ খরচ করতে হবে, না হয় সেখানে লেখাপড়াই হবে না। এটা তাদের বিশ্বাস। শুধু বিশ্বাস নয়, আসলেও তা-ই। সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বাইরে আছে বেসরকারি মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজ এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে উচ্চহারে বেতন-ভাতাদি পরিশোধ করতে হয়, এ কথা সর্বমহলে প্রচারিত। আর থাকল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত অসংখ্য কলেজ, যেখানে ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন বিষয়ে অনার্স পড়তে পারে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে অধ্যাপকের স্বল্পতা, অবকাঠামোগত অপ্রতুলতা, বিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণাগারের সীমাবদ্ধতা, পরীক্ষা ব্যবস্থাপনায় জটিলতার জন্য লেখাপড়া ও প্রার্থিত সাফল্য ঠিকভাবে আসে না বলে সবার ধারণা। বেসরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত কলেজগুলো সম্পর্কে মানুষের গড়ে ওঠা এই বিশ্বাস ও ধারণার ভিত্তি আছে নিশ্চয়ই। তাই মেধাবী ও গরিব ছাত্রছাত্রীরা ছোটে সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত সেই মেডিক্যাল কলেজ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে। এক বছর না হলে দ্বিতীয়বারও চেষ্টা করে। কিন্তু সংগত কারণেই সবার আসন হয় না এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমার সুনির্দিষ্ট একটি প্রস্তাব আছে।
সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা এখন বেশ বেড়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শিফট খোলার ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। বিষয়টি ছেড়ে দিতে হবে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের ওপর। এ ব্যাপারে তাদের মুক্ত মতামত নেওয়া প্রয়োজন। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগ হয়তো দ্বিতীয় শিফট খোলার ব্যাপারে আগ্রহী হবে না; কিন্তু আমার বিশ্বাস, অনেক বিভাগ আগ্রহ দেখাবে। বিশেষ করে কলা ও বাণিজ্য অনুষদের বিভাগগুলো দ্বিতীয় শিফটের ব্যাপারে আগ্রহ দেখাতে পারে। ধরা যাক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। এখানে কলা অনুষদের ভবনে বিকেলে দ্বিতীয় শিফট চালু হলে তা বর্তমানে যতসংখ্যক ছাত্রছাত্রীকে ভর্তি করা হচ্ছে, তার দ্বিগুণ ছাত্রছাত্রী ভর্তি করা যেতে পারে। স্বাধীনতা দিতে হবে, যেসব বিভাগ দ্বিতীয় শিফট চালু করতে না চায়, তারা আপাতত চালু করবে না। ধরা যাক রাজশাহী বা জাতীয় কবি কাজী নজরুল বা বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। দেশে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিকেলের পর ভবন অব্যবহৃতই থাকে। সেখানে যদি বাণিজ্য, কলা এবং সম্ভব হলে বিজ্ঞান অনুষদের দ্বিতীয় শিফট খোলার ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে ছাত্রছাত্রীদের বিশেষ উপকার হয় এবং শিক্ষাসম্পদের সঠিক ব্যবহারও হয়। এ ক্ষেত্রে সরকারকে বলতে হবে, দ্বিতীয় শিফট খোলা ও পাঠদানসংশ্লিষ্ট সবার বেতন-ভাতা দেড় গুণ হবে। ছাত্রছাত্রীরা অন্যদের মতোই বেতনাদি দেবে। তবে তাদের আবাসিক ও যানবাহনের কোনো ব্যবস্থা আপাতত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পক্ষে নেওয়া সম্ভব হবে না। যদি এ বিষয়গুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয় আরো ভেবে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মাধ্যমে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মতামত আহ্বান করে, তাহলে আমার মনে হয়, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু বিভাগই প্রাথমিক সম্মতি জানাবে। আর শুরু হয়ে গেলেই দু-এক বছরের মধ্যে প্রায় সব বিভাগই এর আওতায় আসতে চাইবে। এতে লাভ হবে, নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ব্যাপারে সরকারের রাতারাতি ভাবতে হবে না; এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের মেধাসম্পদ পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানো যাবে, তাঁরা আলস্যে সময় কাটানো থেকে মুক্তি পাবেন, কোটি কোটি টাকা ব্যয়ের স্থাপনাগুলোর সঠিক ব্যবহার হবে, শিক্ষার্থীরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ পাবে, মনে থাকবে আনন্দ। এর প্রভাব পড়বে ক্যাম্পাসে, ক্যাম্পাসসংলগ্ন এলাকায়, সর্বোপরি দেশের মানবসম্পদ উন্নয়নে। এই প্রস্তাবের বিপক্ষে দাঁড়াতে পারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমর্থক কিছু ব্যক্তি। কারণ এতে প্রাথমিকভাবে প্রত্যক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তাঁরা। তাঁদের ছাত্ররাই মূলত ভর্তি হবে এই দ্বিতীয় শিফটে। বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলো এই প্রস্তাবকে সমর্থন করবে বলেই আমার বিশ্বাস। কারণ এখানে কোনো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য নেই, আছে সর্বস্তরে শিক্ষা পেঁৗছে দেওয়ার চেষ্টা। অনেক ছাত্রসংগঠন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দ্বিতীয় শিফট চালু করার দাবি বেশ আগেই উত্থাপন করেছিল বলে আমার মনে পড়ে। তখন এর বিশেষ প্রয়োজন ছিল না। এখন এর প্রয়োজন। পাস করা ব্যাপকসংখ্যক ছাত্রছাত্রীর কথা বিবেচনা করে যখন সে দাবি আবার সামনে আনা সত্যিই প্রয়োজন, তখন তাদের এ ব্যাপারে নীরবতা প্রশ্নের জন্ম দেয়। আমাদের প্রস্তাব, দ্বিতীয় শিফটের ছাত্রছাত্রীরা অন্যদের মতো একই বেতনাদি দেবে। এই শিফটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-কর্মকর্তারা যেহেতু দ্বিগুণ পরিশ্রম করবেন, সেহেতু তাঁদের বেতন-ভাতাদি অন্তত দেড় গুণ হলে ভালো। মনে রাখা প্রয়োজন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তো বটেই; অন্য কিছু উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরও কোনো কোনো বিভাগে নাইট শিফট নামে চাকরিজীবীদের শিক্ষা ও সার্টিফিকেট দেওয়ার উছিলায় প্রচুর টাকা অর্জনের কিছু কোর্স চালু আছে। এই দ্বিতীয় শিফট চালু হলে সেই বাণিজ্যিক কোর্স বা ডিগ্রি দেওয়ার ব্যাপারটি বন্ধ করা সম্ভব হবে। এবার থেকেই যদি সেটা করা যায়, তাহলে উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় এবার যারা পাস করেছে, তাদের ভর্তির ক্ষেত্র প্রসারিত হবে। অনেকেই এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শিফটে ভর্তি হয়ে আনন্দে করবে অবগাহন। সত্যি, উৎসবের আমেজ এবার তারা পাবে বছরের বাকিটা সময়জুড়েই।

লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
scpcdu@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.