বৃত্তের ভেতর বৃত্ত-একটি সেতু এবং একজন মহাক্ষমতাধরের কান্ড by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু

গত সপ্তাহে এই কলামে 'পঞ্চাশ এমপির আমলনামা, উত্তপ্ত জাতীয় সংসদ এবং অর্জনের বিসর্জন' শিরোনামে লেখাটি প্রকাশের পর অনেকের টেলিফোন এবং ই-মেইল পেয়েছি। সেই লেখার সূত্র ধরে আজ আবারও বলি, ক্ষমতাবানদের ক্ষমতা দীর্ঘমেয়াদি না হলেও কোনো কোনো সময় খুবই দৃষ্টিকটু ও উদ্বেগের বিষয় হয়ে ওঠে।


২৫ আগস্ট কালের কণ্ঠে 'জেলা পরিষদের সেতু বিক্রি করল ছাত্রলীগ' শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি পড়ার পর মনে হলো, বড় বিচিত্র এই দেশ এবং এর চেয়েও বিচিত্র এবং বিস্ময়কর এ দেশের কোনো কোনো রাজনীতিকের কর্মকাণ্ড। প্রতিবেদনটি পড়ে জানা গেল, জনসাধারণের ব্যবহৃত লোহার একটি সেতু (সেতুটির কর্তৃপক্ষ জেলা পরিষদ নাকি এলজিইডি, এর চেয়েও বড় কথা হলো সেতুটি জনসম্পত্তি) এক ছাত্রলীগ নেতা বিক্রি করে দিয়েছেন! এই সব সম্ভবের দেশে এমন একটি খবর তেমনভাবে সংগত কারণেই সাধারণ মানুষকে যদি স্পর্শ না করে থাকে, তাতে দোষ দেওয়া যাবে না। কারণ অনেক কিছুই তো গা-সওয়া হয়ে গেছে।
বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার উদয়কাঠি ইউনিয়নের লবণসাড়া গ্রামের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা একটি খালের ওপর ওই সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছিল স্বাধীনতা-পূর্বকালে। চলাচলের উপযোগী বিক্রি করা সেতুটি খরিদ্দার খুলে নেওয়ার সময় স্থানীয় লোকজন প্রতিরোধের ব্যর্থ চেষ্টা করে। সেতু বিক্রেতা ছাত্রলীগের ওই নেতা জেলা পরিষদের ভুয়া কাগজপত্র (কার্যাদেশ) দেখিয়ে সেতুটি শেষ পর্যন্ত খুলে নিতে সহযোগিতা করেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। পরে র‌্যাব খরিদ্দারের আস্তানা থেকে সেতুর মালামাল উদ্ধার করেছে বটে, কিন্তু সেতু বিক্রেতা মহাক্ষমতাধর ছাত্রলীগ নেতার সন্ধান মেলেনি। লবণসাড়া গ্রামে এই সেতুটির কাছেই ২০০০ সালের দিকে একটি নতুন সেতু তৈরি করা হয়। ফলে লোহার সেতুটির ব্যবহার কমে গেলেও মানুষ যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে বিশেষ করে, একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা তা ব্যবহার করত। কথা সেখানে নয়, কথা হলো_স্বেচ্ছাচারিতা, ক্ষমতাবানদের ক্ষমতা আর ব্যক্তি বা মহলবিশেষের লাগামহীন উন্মত্ততা কিংবা চরম দৃষ্টিকটু কর্মকাণ্ড নিয়ে। গত সপ্তাহে এই কলামের শুরুতেই লিখেছিলাম, ক্ষমতা ও ক্ষমতার শত্রু-মিত্র দুই-ই হতে পারে। বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার উদয়কাঠি ইউনিয়নের লবণসাড়া গ্রামে যে ঘটনাটি ঘটল, ক্ষমতা-সংশ্লিষ্টদের কাছে বিষয়টি তুচ্ছ মনে হলেও আমরা মনে করি, ক্ষমতার চেয়ারে এভাবেই একটি একটি করে সর্বনাশের পেরেক ঠুকে দিচ্ছে স্বেচ্ছাচারীরা।
বরিশালের বানারীপাড়ার ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এর আগে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণের মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। বিষয়টি দূর অতীতের নয়। তিনি ছাত্রলীগের বিপথগামী নেতা-কর্মীদের টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসসহ নানাবিধ দুষ্কর্মের কারণে এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটালেও স্বেচ্ছাচারীরা যে পূর্ববৎই রয়ে গেছে, বানারীপাড়ার ঘটনাটি এরই আরো একটি দৃষ্টান্ত। শুধু ছাত্রলীগ কেন_যুবলীগ, শ্রমিক লীগ, এমনকি আওয়ামী লীগের মধ্যেও এমন দুষ্ককর্মকারীর সংখ্যা কম নয় এবং তাঁরা বরাবরই ধরাকে সরা জ্ঞান করে চলেছেন। এর মধ্যে দুঃখজনকভাবে জাতীয় সংসদের কোনো কোনো সদস্যের (আওয়ামী লীগের টিকিটে যাঁরা নির্বাচিত হয়েছেন এবং যাঁদের সিংহভাগই নবাগত) নামও উঠে আসছে। তাঁদের সাধারণ মানুষ, যাঁরা শুধু ভোটার কিংবা প্রাণী মাত্র নন, তাঁরা নীরবে পরিত্যাগ করতে শুরু করেছেন এবং এর প্রমাণও মিলছে। কিন্তু তার পরও তাঁদের বোধোদয় ঘটছে না, দলের শীর্ষ পর্যায়ে এসব বিষয় যেমনভাবে নজরে আসা এবং প্রতিকার হওয়া উচিত, তা হচ্ছে না। উদ্বেগটা সেখানেই। এসব নেতা-কর্মী দলের বোঝাসম ও অবহনযোগ্য এবং একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের কাছে বিষফোঁড়াসম। তাঁরা যুগে যুগে থাকেন। এমন দৃশ্য বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে যেমন, তেমনি প্রায় সব কয়টি রাজনৈতিক সরকারের আমলেই দেখা গেছে। অতীতের মতো বর্তমানেও ক্ষমতাসীন মহলের কোনো কোনো সংসদ সদস্য এতটাই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন যে তাঁদের সঙ্গে নাকি এখন দলের ত্যাগী নেতা-কর্মী নয়, তাঁরা জেলা-উপজেলা পর্যায়ের অসাধু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্বেচ্ছাচারী কিছু নেতা-কর্মী ও পুলিশ সদস্য পরিবেষ্টিত থাকেন। এ আলামত নিশ্চয়ই কোনো শুভ লক্ষণ নয়। একজন সংসদ সদস্য দলের ত্যাগী নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষের সংস্পর্শ থেকে যখন বিচ্যুত হন, তখন বুঝতে হবে ক্ষমতার চেয়ারে বড় শক্ত পেরেকই ঢুকেছে। ২৪ আগস্ট জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রধানমন্ত্রী দল ও জোটের যেসব সংসদ সদস্য সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রীর কঠোর সমালোচনা করছেন, তাঁদের উদ্দেশে বলেছেন, 'শত্রুর হাতে অস্ত্র তুলে দেবেন না'। প্রধানমন্ত্রীর ওই মন্তব্য রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করলে বলতে হবে, ঠিক আছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের মনোভাব বিচার-বিশ্লেষণ করলে বলতে হয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ব্যর্থ মন্ত্রী, স্বেচ্ছাচারী, ক্ষমতাবান সংসদ সদস্য ও দলের নেতা-কর্মীদের বিষয়ে একটু ভাবুন। অপ্রিয় হলেও সত্য, দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হলেও সাধারণ মানুষের কাছে তাঁরা বড় বেশি অবহনযোগ্য হয়ে পড়েছেন। আর বিপত্তিটা দেখা দিয়েছে সেখানেই। ২৫ আগস্ট, ২০১১ একটি দৈনিকে সচিত্র প্রতিবেদনের শিরোনাম, 'মন্ত্রী-সন্ত্রাসী এক মঞ্চে'। চট্টগ্রামের ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের অনুষ্ঠানে র‌্যাবের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী ও যুবলীগ ক্যাডার দিদারুল আলমকে করমর্দনের দৃশ্যের সাক্ষ্য বহন করছে ওই সচিত্র প্রতিবেদন।
ফিরে আসি মূল প্রসঙ্গে। ছাত্ররাজনীতির নামে যা পরিলক্ষিত হচ্ছে, এর অবসান জরুরি। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের তরফেও এ দাবির পক্ষে উচ্চকণ্ঠ পরিলক্ষিত হয়েছে বটে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা থেকে গেছে উচ্চারণসর্বস্বই। 'আওয়ামী লীগের হাত ধরেই এ দেশের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন হবে'_দ্বিতীয়বারের মতো দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মাজারে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে এই মন্তব্য করেছিলেন। আমাদের স্মরণে আছে, নবম জাতীয় সংসদ গঠিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পর পরই প্রথম সংবাদ সম্মেলনেও একই মন্তব্য করেছিলেন তিনি। খুব কাছাকাছি সময়ে প্রধানমন্ত্রীর এমন উচ্চারণ দুবার উচ্চারিত হওয়ার পর সরকার যে প্রকৃত পরিবর্তন আনতে বদ্ধপরিকর, তা জনমনে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, ব্যাপক আশারও সঞ্চার ঘটিয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নতুন নতুন প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। কোনো নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে ছাত্র নামধারী দখলদার কিংবা উন্মত্ততা সৃষ্টিকারীদের অবস্থান সুসংহত হতে পারে না। বিশেষ করে বিগত জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট যে গণরায় অর্জন করেছে, তাদের কাছে তা আরো অর্থবহ। তাদের তো পেশিশক্তির দরকার নেই। তাদের রয়েছে বিপুল জনসমর্থন। মানুষ সন্ত্রাসসহ যাবতীয় দুষ্কর্মের বিরুদ্ধে রায় দেওয়ার পর এমন পরিস্থিতিতে আহত হতেই পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজনীতিতে যে গুণগত পরিবর্তনের কথা বলেছেন, নিশ্চয়ই রাজনীতি এর বাইরে নয়। সার্বিকভাবে যদি রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন ঘটাতেই হয়, তবে ছাত্র ও শ্রমিক রাজনীতি এর বাইরে রেখে সুফল প্রত্যাশা করা দুরাশারই নামান্তর। কখনো কখনো যুক্তি দেওয়া হয়েছে, যত না ঘটছে, তার চেয়ে বেশি প্রচার করা হচ্ছে। এমন মন্তব্য না করে বরং 'ঘরের শত্রু বিভীষণ'দের সামলানোই জরুরি।
ইতিহাস পাঠে বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির যে গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য আমরা পাই, তা আজকের ছাত্রনেতাদের আমলে নেই। কেন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পরও পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে না_এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার দায় সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের। যারা দলের সম্পদ নয়, রীতিমতো বোঝা, তাদের ক্ষেত্রে প্রতিকারহীন ভূমিকা পালন করলে ফল কখনোই শুভ হবে না, হতে পারে না। সুনির্দিষ্টভাবে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে কিংবা উঠছে, তারা যেহেতু অচিহ্নিত নয়, সেহেতু প্রতিকার করাও দুরূহ কিছু নয়। দলীয় নেতৃত্ব ও সরকারকে এ ব্যাপারে দ্রুত কঠোর কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। ব্যবস্থা দৃষ্টান্তযোগ্য হলে অবস্থা এমনিতেই ভালো হতে বাধ্য। অতীতে দেখা গেছে, জাতীয় পর্যায়ের ক্ষমতালগ্ন রাজনীতির সঙ্গে কাঠামোগত লেজুড়বৃত্তি ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক সংঘাত-সংঘর্ষের রাজনীতির অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি প্রতিফলনের কারণেই শিক্ষার পরিবেশ বিপন্ন হয়েছে। একই কারণে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে আন্তসম্পর্কেরও অবনতি ঘটে। এখন অবশ্যই ছাত্ররাজনীতির ইতিবাচক ভবিষ্যৎ নির্মাণে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া দায় হয়ে পড়েছে। আমরা অবশ্য এ-ও চাইব, শিক্ষাঙ্গনের সব আন্দোলন-কর্মসূচি সর্বাগ্রে শিক্ষাভিত্তিক হোক। সহনশীলতা, সৃজনশীলতা, মননশীলতা বিকাশের পথ হোক প্রশস্ত। যদি এমনটি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়, তাহলে দুর্বৃত্ত নয়, ছাত্ররাজনীতির অঙ্গন থেকে প্রকৃতই দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধাররা বেরিয়ে আসবেন। আজকে যাঁরা জাতীয় রাজনীতির শীর্ষস্থানে আছেন, তাঁদের সিংহভাগই তো সে অঙ্গন থেকে আসা। এমনটি নিশ্চিত করা সম্ভব হলে ছাত্র নামধারী অছাত্রদের রাজনীতির দোহাই দিয়ে দাপট দেখানোর পথও রুদ্ধ হয়ে পড়বে। টেন্ডারবাজ, চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, সেতু বিক্রয়কারীদের স্থান তো ছাত্রলীগের পতাকাতলে হতে পারে না।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.