চরাচর-পরিবেশজাত উদ্বাস্তু সমস্যা by আফতাব চৌধুরী

রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে বিভিন্ন দেশে উদ্বাস্তু সমস্যার সৃষ্টি হয়। কিন্তু ইদানীং পরিবেশগত কারণে বিপুলসংখ্যক লোককে উদ্বাস্তু হতে দেখা যায়। অনেকের হয়তো মনে আছে ১৯৩০ সালের অভিজ্ঞতার কথা, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩০ লক্ষাধিক ওকিস দক্ষিণের বিশাল প্রান্তর ছেড়ে জমিজমা-বসতবাড়ি পরিত্যাগ করে পাড়ি জমিয়েছিল অন্য রাজ্যের উদ্দেশে, যাদের বৃহদংশ ঠাঁই নিয়েছিল ক্যালিফোর্নিয়ায়।


কারণ বিধ্বংসী ধূলিঝড়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ধূলিঝড়জনিত উদ্বাস্তুর সংখ্যা হয়তো কমে যাবে একবিংশ শতাব্দীতে, যদি আমরা বর্তমান জীবাশ্ম জ্বালানি অর্থনীতিতে একইভাবে চলি। নতুন উদ্বাস্তুরা হবে কোথাও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রায় নিঃশেষিত হওয়ার কারণে বা ক্রমবর্ধমান মরুভূমির জন্য অথবা সমুদ্রতলের জন্য কিংবা সমুদ্রতলের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে, যাতে ইন্ধন দেবে বাজার অর্থনীতি। শুরু হয়েছে গ্রাম দিয়ে, কালক্রমে শহরগুলো আক্রান্ত হবে; যেমন_ইয়েমেন রাষ্ট্রের রাজধানী সানা অথবা পাকিস্তান রাষ্ট্রের বেলুচিস্তানের রাজধানী কোয়েটা। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, সানায় ভূগর্ভের পানির স্তর নামছে ছয় মিটার করে। এমন অবস্থায় ২০১৫ সালে পানি নিঃশেষ হয়ে বহু দূর থেকে পানি আনতে হবে অথবা শহর পরিত্যাগ করতে হবে। কোয়েটার জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ লাখে, শহরটি নির্মিত হয়েছিল ৫০ হাজারের মতো মানুষের জন্য। তারা সবাই নির্ভর করে মাত্র দুই হাজার গভীর নলকূপের ওপর। খানেও ভূগর্ভস্থ পানি নিঃশেষিত হয়ে যাবে ১০ বছরের মধ্যে। ২০০৩ সালের অক্টোবরের মাঝামাঝি ইতালির শাসনকর্তারা আবিষ্কার করলেন ভূমধ্যসাগরে একটি জাহাজ। আফ্রিকা মহাদেশ থেকে আগত ইতালিগামী এই জাহাজ সমুদ্রে দিগ্ভ্রষ্ট হয়ে দুই সপ্তাহের বেশি ঘুরে বেড়িয়েছে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর উদ্বাস্তুদের নিয়ে, যাদের অনেকেই প্রাণ দিয়েছ পানি, খাদ্য ও গরম রাখার জন্য জ্বালানির অভাবে। যারা আগে মরেছে, তাদের সমুদ্রে ফেলে দিয়েছে সাথিরা। পরে সেই শক্তিও লোপ পেলে মৃতদেহগুলো সঙ্গী করেই কাটিয়েছে দিনরাত। এ যেন দান্তের নরক। সোমালিয়ার মতো বিপর্যস্ত দেশগুলো তিন ধরনের উদ্বাস্তুরই জন্মদাতা। আমরা জানি যে সোমালিয়া নষ্ট ইকোলজির এক জ্বলন্ত উদাহরণ। সেখানে জনসংখ্যার আধিক্য, প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত পশুচারণভূমি ও প্রসারিত মরুভূমি গ্রাম্য অর্থনীতি ধ্বংস করেছে। এখনো প্রতিদিন আফ্রিকা থেকে মৃতদেহ ভেসে আসছে ইতালি, ফ্রান্স ও স্পেনের উপকূলে। হাজারো মেঙ্েিকাবাসী জীবন বিপন্ন করে চলেছে শহরের দিকে, নয়তো ঢুকতে চাইছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, বেআইনিভাবে সীমানা অতিক্রম করে।
চীনে, যেখানে গোবি মরুভূমি বছরে চার হাজার বর্গকিলোমিটার করে বাড়ছে, উদ্বাস্তুর সংখ্যা সেখানে প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বিশেষত তিনটি রাজ্য_মধ্য মঙ্গোলিয়া, নিংসিয়া ও গানসু ব্যাপকভাবে আক্রান্ত। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করেছে গানসু প্রদেশে চার হাজার গ্রামকে, যেগুলো অদূর-ভবিষ্যতে জনমানবহীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের ইরানে ক্রমপ্রসারিত মরুভূমি এবং পানির অভাব হাজারের বেশি গ্রামকে আজ জনশূন্য করেছে। পূর্ব দিকের বেলুচিস্তান প্রদেশে ১২৪টি গ্রাম এরই মধ্যে বালুতে আবৃত। তেহরান থেকে মাত্র এক ঘণ্টার রাস্তা দময়ন্দ শহরের কাছে ৮৮টি গ্রাম পরিত্যক্ত হয়েছে। আফ্রিকা মহাদেশের নাইজেরিয়া রাষ্ট্রে মরুভূমিতে রূপান্তরিত হচ্ছে প্রতিবছরে সাড়ে তিন হাজার বর্গকিলোমিটার জমি। বর্তমানে পরিবেশ বিষয়ে এটাই এই রাষ্ট্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা। যতই মরুভূমি গ্রাস করছে, ততই চাষ ও বাসের স্থান সংকুচিত হচ্ছে, ফলে ক্রমেই গ্রামবাসী গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। আগামী দিনে এক নতুন পরিবশেজাত উদ্বাস্তু সমস্যা বিশ্বকে বিব্রত করবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের মাত্র এক মিটার বৃদ্ধি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অর্ধেক ধানি জমিকে সমুদ্রগর্ভে নিয়ে যাবে; ফলে চার কোটি মানুষের পুনর্বাসন নিতে হবে। বর্তমানে ১৫ কোটি মানুষের বাস বাংলাদেশে। পরিবেশজাত এই উদ্বাস্তু সমস্যা, তা সে ক্রমপ্রসারিত মরুভূমির জন্যই হোক আর সামুদ্রিক পানির উচ্চতা বৃদ্ধির জন্যই হোক, একটি নতুন সমস্যা, যা সবে শুরু হয়েছে। সমস্যার গভীরতা ভবিষ্যতের গর্ভে নিহিত। এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হলে প্রাথমিকভাবে তিনটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া দরকার_জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি সংরক্ষণ ও তার সঠিক ব্যবহার এবং একটি সুস্থ শক্তিনীতি, যা বিশ্বে কার্বন ডাই-অঙ্াইড নিঃসরণ কমাবে।
আফতাব চৌধুরী

No comments

Powered by Blogger.