দূরের দূরবীনে-শুধু অশ্রু আর ফুল নয়, প্রতিরোধ ও পরিবর্তন প্রয়োজন by অজয় দাশগুপ্ত

আমাদের দেশের মতো জবাবদিহিবিহীন, অস্বচ্ছ, আবছা চরিত্রের কর্তৃপক্ষ পৃথিবীতে বিরল। সব দেশে ও সব জাতিতে এক ধরনের স্বচ্ছতা আছে, ভাঙাচোরা কিছু দেশ, যুদ্ধবিধ্বস্ত সমাজ বা উত্তেজনাপ্রবণ রাষ্ট্রগুলো বাদ দিলে সবাই নিয়ম মেনে চলেন। ঘটনা-দুর্ঘটনায় জবাবদিহি করতে বাধ্য সরকার ও প্রশাসন সে দেশগুলোয়, তাঁরাই জনগণের ভরসা।


এখন প্রশ্ন করতে হবে, আমরা কোন দলে? আমরা যদি নিজেদের আফগানিস্তান, পাকিস্তান, সিয়েরা লিওন, জিম্বাবুয়ে বা কসোভো মনে করি, তাহলে বিষয় আলাদা, আর যদি বলি আমরা উন্নয়নশীল, আধুনিকতার পথে আগ্রহী, গণতান্ত্রিক_তাহলে স্বচ্ছতার বিকল্প নেই। বাংলাদেশের পরিশ্রমী জনগণ 'মেধাবী শ্রমশক্তি' আর দেশপ্রেম যখন সামনে যেতে চাইছে, রাজনীতি তার সমগ্র অর্জন ঢেকে দিচ্ছে অস্বচ্ছতা আর জবাবহীনতার কালো পর্দায়। বহুবার লিখেছি, একটি দেশের মান-সম্মান-ইজ্জত বা উন্নতি রাজনীতির ওপর এককভাবে নির্ভর করে না। আবার অবনতি বা ধ্বংস চাইলে একা রাজনীতিই সে জন্য যথেষ্ট। দুর্ভাগ্য আমাদের, এখন চলছে শেষের প্রক্রিয়া, আশা ও প্রত্যাশায় বাঁধা বুকের পাঁজর ভেঙে শিল্পী বন্ধু ঢালী আল মামুনের মতো দেহের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ছে রাজনীতির বেপরোয়া ট্রাক অথবা অন্য কোনো যান।
আমরা প্রবাসীরা প্রায়ই ভাবি, দেশে ফিরে যাব। এ ভাবনার পেছনে একদিকে যেমন অতীত, স্মৃতিনির্ভরতা, ফেলে আসা দেশ ও মানুষের জন্য মায়া, অন্য প্রান্তে নাড়ির টান, জন্ম, জন্মভূমি, ভাষা, মানুষ নিজে নির্ণয় করতে পারে না। এ হচ্ছে ঈশ্বর অথবা প্রকৃতির দান। ফলে এই তার নিয়তি, বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করে আমরা গর্বিত, ব্যক্তিগতভাবে এ নিয়ে আমার ভালোবাসা বা উচ্ছ্বাসের কমতি নেই। দুই বাংলার তুলনায় আমি এক শ ভাগ সন্তুষ্ট যে আমার ওপর উর্দু যেমন খবরদারি করতে পারেনি, তেমনি নেই হিন্দির আগ্রাসন। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ অবধি এক অনন্ত গৌরব আর উজ্জ্বলতায় বড় হওয়া দেশের মানুষ আমি, আমার রাষ্ট্র জন্ম দিয়েছে শতাব্দীর সেরা রাজনৈতিক কবি বঙ্গবন্ধুর। আজ রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মতো বাঙালি কবির আশ্রয়ও আমার দেশের মাটি।
১৬ ডিসেম্বর ১৬ ডিসেম্বরই। ওই সন্ধ্যায় রেসকোর্স ময়দানের আত্মসমর্পণ ছিল অবধারিত। অর্থাৎ এই হচ্ছে অর্জন। রক্তে ভেজা ইজ্জত আর দেশপ্রেমের বিনিময়ে রাষ্ট্র পাওয়ার অমূল্য আনন্দ-উৎসব। গিফট আর অর্জনের ফারাকেই একদল নিয়মমাফিক স্বাধীনতার পতাকা ওড়ায়, বাজি পোড়ায়, হিন্দি বা উর্দু ছায়াছবির নাচ-গানের ফুর্তি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আমরা কাঁদি, কেঁদে শুদ্ধ হই_এতটাই প্রিয় আমাদের অর্জিত মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশ।
এতটাই গর্ব আমাদের। জীবন-জীবিকা, মেধার ব্যবহার বা অন্য কারণে দেশ ছেড়ে এলেও আমরা স্বপ্নবিলাসী। বেশির ভাগ বাংলাদেশি স্বপ্ন দেখেন, দেশে ফিরে গিয়ে জন্মভূমিতেই শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করবেন। নাড়ির টান যেমন সত্য, আরো একটি বাস্তবতা উপেক্ষার নয়। নিজ দেশ বা জাতির কল্যাণে আসতে হলে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বিকল্প নেই। রবীন্দ্রনাথ, ঋষি অরবিন্দ, বিবেকানন্দ বা হাল আমলের হুমায়ূন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবালের মতো খ্যাতিমান বাঙালিরাই তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। অর্জিত মেধা, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা বা অর্থকড়ি দেশে বিনিয়োগ করে নিজের ঔজ্জ্বল্য ও দেশসেবা_দুটোই সম্ভব।
আমাদের কবি শ্রী মধুসূদনের মতো অনুভূতি কারো বেলায় নেই। খাঁটি ও নির্মম কথাগুলো তিনিই বলে গেছেন। 'পরদেশে ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি'র মতো অমোঘ বাক্যে জানান দিয়ে গেছেন প্রবাসীর জীবন ও পরিণতি। কাল পাল্টেছে। এই দুনিয়া মিডিয়ার দুনিয়া। বিশ্বায়নের খোলা জানালায় পৃথিবী এখন দৃশ্যমান এক গ্রহ। হাতের মুঠোয় তথ্য, আর মন চাইলে প্রযুক্তির ব্যবহার। ফলে চলে যেতেই হবে_এমন বাস্তবতা শতভাগ যৌক্তিক মনে হয় না। তার পরও আমরা চাই, জীবনের শেষ পর্বে বা বাকি জীবনের বেশ কিছু সময় দেশে কাটাব।
প্রশ্ন হচ্ছে, কোন দেশে? যে দেশে ৪০ বছর পরও হাইওয়ে বা মহাসড়কে ভিন্নমুখী ট্রাফিক বা আসা-যাওয়ার দুটো পৃথক লেন নেই? যে দেশে রেমিট্যান্স, অনুদান বা সাহায্যের অর্থ উপচে পড়লেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবস্থা নিতে পারে না? যে রাষ্ট্রে দুর্ঘটনা ও হত্যাকাণ্ড সমার্থক হওয়ার পরও মন্ত্রী তাঁর পদ ও কথায় অটল? মানুষের জীবনের চেয়ে মূল্যবান দ্বিতীয় কিছুটি না থাকার পরও এ নিয়ে না আছে মাথাব্যথা, না কোনো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা।
সাম্প্রতিক দুর্ঘটনায় প্রয়াত তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর উভয়েই ছিলেন প্রবাসী। পৃথিবীর দুটি উন্নত দেশের অভিবাসীর জীবন ছেড়ে, সচ্ছলতা, নিরাপত্তা আর অগ্রগামী ভাবনার রাষ্ট্র ছেড়ে ফিরে গিয়েছিলেন মাতৃক্রোড়ে। হাজারো অসুবিধা, জীবনযন্ত্রণা, নারকীয় সন্ত্রাস, উঁচু বাজারদর, অসহিষ্ণু মৌলবাদ, দলবাজির ভেতর থেকেও নিজেদের কাজ করে যাচ্ছিলেন। সে যাত্রা চিরতরে স্তব্ধ করে দিয়েছে অপব্যবস্থা। এই দুর্ঘটনা যে কাল আবার ঘটবে না, অন্য কেউ প্রাণ হারাবে না_তার কি কোনো গ্যারান্টি আছে? এই যে মিরসরাই ট্র্যাজেডির ঘটনার দেড় মাস হতে চলল, এখনো তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি। সে ঘটনা কি কম মর্মান্তিক? সে দুর্ঘটনায় কি অকালপ্রয়াত সেলিব্রিটি ছিল না?
আমরা খুব ভালো জানি মন্ত্রী-মিনিস্টাররা গাড়ি চালান না। তাঁরা ব্যস্ত, উঁচু পদের মানুষ। ধরুন, যখন দুটি দেশে যুদ্ধ হয়, তখন কি উভয় দেশের প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী লড়াইয়ে নামেন? তাঁরা কি ঢাল-তলোয়ার নিয়ে বা বন্দুক-কামান দাগাতে মাঠে নেমে পড়েন? নামেন না, তার পরও পরাজিত দেশ বা রাষ্ট্রের প্রধান দায়দায়িত্ব মেনে, লজ্জা ঢাকতে পদত্যাগ করেন। এ ত্যাগ তাঁর জন্য যেমন স্বস্তির, তেমনি জাতিরও। একেই বলে জবাবদিহি। এর মধ্র দিয়ে প্রমাণ হয়, আমি নই, মূলত আমার কর্ম, আমার দায়িত্বই মুখ্য। যেহেতু তা পালিত হয়নি, এই আমি সরে দাঁড়ালাম। তখন পরিস্থিতিটাও যায় পাল্টে। সবাই সাবধানী হয়ে ওঠে। উপরমহলের টনক নড়ে। সতর্ক হয় পরিবহনব্যবস্থা।
আমাদের দুর্ভাগ্য, ওই কাজটি করতে প্রস্তুত নয় কেউ। ফলে পরিস্থিতিও বদলায় না। এমনভাবে চলতে থাকলে আমরা কি আর দেশে ফেরার স্বপ্ন দেখতে পারব? যাঁরা দেশে আছেন, তাঁরা কি বেঁচে থাকতে পারবেন? রাজনীতি এর জবাব দেবে না। উত্তর দেবে না দল ও দলবাজি। তবু জীবন চলমান। আর সে জীবনকে চালু রাখতেই শক্ত হয়ে দাঁড়ানো প্রয়োজন। চোখের জল, ফুল, ভালোবাসা, দোয়া-আশীর্বাদই শেষ কথা নয়, শেষ কথা প্রতিরোধ ও পরিবর্তন। সে কাজগুলো যাঁরা করবেন বা করতে ইচ্ছুক, এখন তাঁদের প্রয়োজন সবচেয়ে অধিক। দেশ ও মানুষ বাঁচলেই না ভবিষ্যৎ।
লেখক : সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক
dasgupta ajoy@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.