চারদিক-বিদায়বেলায়

‘ছোট্টবেলায় রচনায় পড়েছিলাম, সময় আর নদীর স্রোত একই রকম। সময় কখনো কারও জন্য থেমে থাকে না। আর কথাটা যে কতটা খাঁটি, তা আবার মনে হলো ১৭ নভেম্বর যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পর্বের শেষ ক্লাসটা করলাম।’ কথাগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষের সেমিস্টারের প্রথম ব্যাচের শিক্ষা সমাপনী দিনে বলছিলেন এক শিক্ষার্থী।


দেখতে দেখতে সময় ফুরিয়ে আজ একেবারেই শেষ প্রান্তে। সকাল ১০টার মধ্যে সবাই বিভাগ প্রাঙ্গণে হাজির। এক দল ক্লাস করছে, অন্যরা শিক্ষা সমাপনীর শোভাযাত্রার আয়োজন করছে। তবে মূল আয়োজনটা শুরু হয়েছিল আগের দিন রাত থেকেই। সন্ধ্যা হতেই কলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় বিভাগ প্রাঙ্গণের আলো জ্বলজ্বল করতে থাকে। অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে অনেকেই কৌতূহলবশে উঁকি দেয়, কী হচ্ছে এই বিভাগে? সন্ধ্যা নামতেই একই বর্ষের শিক্ষার্থীরা সমবেত হন। প্রত্যেকের কাজও ভাগ করা। কেউ আলপনার কাজ, কেউ অস্থায়ী একটা গেট তৈরির কাজ করছেন। কেউ আবার চারপাশ সাজানোর কাজ নিয়ে ব্যস্ত। এরই মাঝে শিক্ষার্থী ফারহানা আখতারের মাথায় এক বুদ্ধি চেপে বসে। সবার উদ্দেশ্যেই প্রস্তাব, একটা সিনেমা বানালে কেমন হয়? সময় তখন বেশি নেই। যেই ভাবা সেই কাজ। চটজলদি অন্য শিক্ষার্থী সরদার সোহেল রানা লিখে ফেলেন স্বল্পদৈর্ঘ্য একটা সিনেমার চিত্রনাট্য। একে একে মহড়া, আরও কত কি!
সকালে প্রথম দিকের সব আয়োজন শেষে ঘোড়ার গাড়ি এসে হাজির। ঘোড়ার গাড়িগুলো বাহারি ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। বিভাগের বিভিন্ন বর্ষের সব শিক্ষার্থীর দৃষ্টি তখন আয়োজন ঘিরে। হচ্ছেটা কি! একটা ব্যাচের শিক্ষা সমাপনী, তাতেই এত্ত আয়োজন। বুঝতে হবে এই বর্ষের শিক্ষার্থীরা নাছোড়বান্দা।
বাঙালি মেয়েরা শাড়িতে নাকি পূর্ণাঙ্গ নারী হয়ে ওঠেন? তাই আগে থেকে বলা ছিল সবাই পরবেন শাড়ি। ‘যারা হয়তো কখনোই শাড়ি পরে নাই, তারাও এই দিন নারী হয়ে উঠতে বাদ যায় নাই।’ কথাটা বলে হেসেই খুন হচ্ছিলেন বিদায়ী শিক্ষার্থী আহম্মেদ রাসেল। কেউ বেদনার রং নীল, কেউ বা তারুণ্যের রং সবুজকে প্রাধান্য দিয়েই শাড়ি নির্বাচন করেন। আর ছেলেরা গায়ে জড়িয়েছেন টি-শার্ট।
টি-শার্টে লেখা, ‘মনের গহীনে প্রদীপ জ্বেলে, এসো হে বন্ধু জানাই বিদায়’। তবে সব শিক্ষার্থীর একই প্রত্যয়—বিদায় নয়, বরং নেন সারা জীবন একসঙ্গে বন্ধু হয়ে পথ চলার শপথ। শোভাযাত্রা শুরু হওয়ার আগেই ‘চিহ্ন তব রেখে যাই।’ হ্যাঁ, ঠিক তাই। বিভাগের দেয়ালে টাঙানো একটা সাদা বোর্ডে সবার হাতের ছাপ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। রঙে হাত ডুবিয়ে তবেই সাদা বোর্ডে ছাপ দিতে হচ্ছে। আর এই ছাপের পাশেই লিখতে হচ্ছে তার নাম। এটাই যেন বিভাগে স্মারক হয়ে থাকবে।
নির্ধারিত সময়ের কিছু পরেই বিভাগের অধ্যাপক রফিকুল্লা খান ফিতা কেটে শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন। এর পরই ঘোড়ার গাড়ি আর গানের তালে শিক্ষার্থীরা পুরো ক্যাম্পাস শোভাযাত্রা করেন। টিএসসি, রাজুস্মৃতি ভাস্কর্য, শামসুন নাহার হলের সামনে থেমে থেমে আনন্দ প্রকাশ করেন। পথচারীরা অনেকেই থমকে দাঁড়ায়। মুগ্ধ হয়ে দেখে এই বিদায়ের বেলায় আনন্দ প্রকাশের ধরন। সমাপনী ব্যাচের শিক্ষার্থী শর্মিষ্ঠা পণ্ডিত বলেন, ‘খুব, খুব, খুব ভালো লাগছে। আর কিছু বলতে পারব না।’ তবে শর্মিষ্ঠার উচ্ছ্বাস আর অল্প কথার উত্তর বুঝিয়ে দেয় দিনটা আসলেই আলাদা।
ডাকসু ক্যাফেটারিয়া সেদিন সমাপনী ব্যাচের শিক্ষার্থীদের দখলে। মধ্যাহ্নভোজের পরই আবার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এবারের আয়োজন আর সি মজুমদার অডিটরিয়ামে। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক শিক্ষার্থী সরদার সোহেল রানা গত চার বছরের হাসি-আনন্দের স্মৃতিবহুল কথা দিয়েই অনুষ্ঠান শুরু করেন।
এরপর শর্মিষ্ঠা পণ্ডিতের নাচ। একে একে জেবুন্নেসার গান, হাস্যরসে ভরা স্বল্পদৈর্ঘ্য বাংলা সিনেমা, বালিশ খেলা আর সহপাঠীদের মূল্যায়নসহ নানা পর্ব।
শিক্ষার্থী ফারহানা আখতার বলেন, ‘একদিকে দারুণ ভালো লাগা আর এর মাঝেই আছে একচিলতে বেদনা। আর এই বেদনা স্নাতক শেষ হয়ে যাওয়ার বেদনা।’
ঘড়ির কাঁটা তখন দ্রুতগতিতে সাতের ঘর পেরিয়ে যাচ্ছে। সব আয়োজন শেষ, এবার ফেরার পালা। মনের ভেতরে যেন কিসের হাহাকার। আবেগঘন এক আবহ তৈরি হয়েছে। মন খারাপ হয় আমাদের। রবীন্দ্রনাথের বলাকা কাব্যের ‘তাজমহল’ কবিতার কয়েকটি পঙিক্ততেই সান্ত্বনা খুঁজি—
‘অবসন্ন বসন্তের বিদায়ের বিষণ্ন নিশ্বাস;
মিলনরজনী প্রান্তে ক্লান্ত চোখে
ম্লান দীপালোকে
ফুরায়ে গিয়াছে যত অশ্রুগলা গান’
শারমিন নাহার

No comments

Powered by Blogger.