বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার একটি অন্যতম কারণ ঝুঁকি উপলব্ধি করার অক্ষমতা by কানন পুরকায়স্থ

বাংলাদেশের পত্রিকায় প্রায় প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনার খবর পড়ছি। অতিসম্প্রতি কালের কণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ, শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর ছেলে মিশুক মুনীরসহ আরো অনেকে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন।
পত্রিকান্তরে আরো লক্ষ করেছি যে প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁর এই 'কঠোর ব্যবস্থা' কী, তা অবশ্য জানতে পারিনি। এর আগেও এ রকম কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু বাস খাদে পড়ছে, মাইক্রোবাস ওভারটেক করছে, চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অন্য যানবাহনের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে অথবা পিচ্ছিল পথে ব্রেক কষে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। এ বিষয়গুলোর সঙ্গে চালকের মনোভাব, দক্ষতা এবং ড্রাইভিংয়ের জ্ঞান অবশ্যই সংশ্লিষ্ট।
সম্প্রতি ঢাকা এবং সিলেট ভ্রমণকালে যা প্রত্যক্ষ বা উপলব্ধি করেছি, তা হলো : ১. ট্রাফিক সিগন্যালবিহীন চৌরাস্তা অথবা সিগন্যাল থাকলেও কাজ করছে না। ২. যানবাহনের প্রবাহের (ঃৎধভভরপ ভষড়)ি তুলনায় রাস্তা ছোট। ৩. কোনো বাস লেন নেই অথবা অতি সীমিত আকারে কোথাও আছে। ৪. চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। ৫. চালকের গাড়ি চালানোর ধরন দেখে মনে হয়, ড্রাইভিং পরীক্ষা ছাড়াই ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়েছেন। ৬. চালকের বয়স, গাড়ির বয়স এবং গাড়ির ধরন অনুযায়ী ইনস্যুরেন্স প্রদান করেন কি না জানতে পারিনি। ৭. চালক অন্যের ড্রাইভিং লাইসেন্স ব্যবহার করেন। ৮. গাড়ির বেগের ওপর চালকের আবেগের প্রভাব এবং তা থেকে স্বল্প সময়ে গন্তব্যে পেঁৗছে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষণীয়। ৯. যাত্রী নিয়ে প্রতিযোগিতামূলক ড্রাইভিং। অর্থাৎ একটি রিকশা দ্রুতগামী বাসের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে।
উলি্লখিত নিরীক্ষণ থেকে এটি অনুমেয় যে সড়ক দুর্ঘটনার সমস্যাটি বহুমাত্রিক। এ সমস্যা নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে বিভিন্ন সংস্থাকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। এই সংস্থাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিবহন বিভাগ, সড়ক ও যোগাযোগ বিভাগ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ইনস্যুরেন্স কম্পানি এবং সর্বোপরি ড্রাইভিং স্ট্যান্ডার্ড এজেন্সি। এই শেষোক্ত সংস্থা বাংলাদেশে নেই, যার পরিবর্তে রয়েছে লাইসেন্সি অথোরিটি। তবে এ সব কিছুর মধ্যমণি হচ্ছেন চালক। আমি ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের প্রশস্ত রাস্তায় চালককে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশের খাদে পড়ে যেতে দেখেছি। অনেক সময় গরুর ওপর দোষ চাপিয়ে চালক পালিয়ে যান। তবে চালককে মনে রাখতে হবে যে যেকোনো পরিস্থিতিতে গাড়ি নিয়ন্ত্রণে রাখার দায়িত্ব চালকের, গরুর নয়।
চালকের দক্ষতার বিষয়টি যাচাই করার জন্য আমি ঢাকায় রিকশা, বেবিট্যাঙ্,ি মাইক্রোবাস এবং বড় কোচে ভ্রমণ করেছি। আমি অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করেছি যে গাড়ির বেগ এবং চালকের আবেগের মধ্যে কোথায় যেন সংমিশ্রণ ঘটছে। এই বেগ-আবেগের দ্বন্দ্ব থেকে সংঘটিত হচ্ছে দুর্ঘটনা। তা ছাড়া বড় গাড়ি এবং ছোট গাড়ি বা রিকশার মধ্যে একধরনের প্রতিযোগিতার মনোভাব কাজ করতে দেখেছি। যেমন-আমার রিকশাচালক মানুষের এবং গাড়ির ভিড়ের মধ্য দিয়ে অতি দ্রুতবেগে রিকশা চালিয়ে যাওয়ার যে দক্ষতা ও মানসিকতা প্রদর্শন করেছে, তা অতুলনীয়। এর পাশাপাশি দ্রুতবেগে মাইক্রোবাস চালিয়ে ঢাকা শহরের রাস্তায় যাত্রীসহ রিকশা পিষ্ট করে ফেলার দক্ষতা ও মানসিকতাও প্রত্যক্ষ করেছি। যানবাহন এভাবে বেপরোয়া চালানোর প্রতিযোগিতার মনস্তাত্তি্বক বিশ্লেষণ প্রয়োজন। আপাতদৃষ্টে এও মনে হবে যে সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হওয়ার জন্য রিকশাচালক যেন বাসচালককে সহায়তা করছে। যেমন-ঢাকার শেরেবাংলা নগরে দেখেছি, একটি রিকশার চালক পিষ্ট হবে জেনেও একটি বাসের সামনে পড়েছে।
এই বেগ এবং আবেগের দ্বন্দ্ব থেকে উত্তরণের উপায় হচ্ছে-চালককে নানাবিধ ঝুঁকি উপলব্ধি করার বিষয়ে সক্ষম করে তোলা। ইউরোপের দেশগুলোতে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা আইনে এবং হাইওয়ে কোডে 'ঐধুধৎফ' এবং 'জরংশ'-এ দুটি বিষয় রয়েছে। 'ঐধুধৎফ'-কে বাংলায় 'ঝুঁকি' বলা যেতে পারে, যা থেকে মানুষ বা পরিবেশের ক্ষতি হতে পারে। 'জরংশ' হচ্ছে এ ধরনের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্ক। তাই 'জরংশ' হচ্ছে সম্ভাব্য বিপদ বা সম্ভাব্য ঝুঁকি। এ বিষয়গুলো গভীরভাবে অনুধাবন করার জন্য যুক্তরাজ্যে প্রতিটি চালককে 'হেজার্ড পারসেপশন টেস্ট' (ঐধুধৎফ চবৎপবঢ়ঃরড়হ ঞবংঃ) বা এইচপিটি পরীক্ষা দিতে হয়। থিওরি টেস্টে এবং এইচপিটিতে উত্তীর্ণ হলে তবেই ব্যবহারিক টেস্ট দেওয়া যাবে। পাসের হারের হিসাবে এই পরীক্ষাগুলো জিসিএসটি বা 'এ' লেভেলের পরীক্ষার চেয়ে কঠিন। 'এ' লেভেলে পাসের হার ৯০ শতাংশ, কিন্তু ড্রাইভিং টেস্টে পাসের হার ৩০-৪০ শতাংশ। ব্যক্তিগত গাড়িচালকদের এইচপিটিতে ৭৫ নম্বরে পেতে হয় কমপক্ষে ৪৪। যাঁরা লরি বা বাস চালাবেন, তাঁদের ৭৫ নম্বরে পেতে হয় কমপক্ষে ৫০। থিওরি টেস্টে সবাইকে পেতে হবে কমপক্ষে ৮৬ শতাংশ নম্বর। ব্যবহারিক পরীক্ষায় একটি ভুল করলেই ফেল। দুই বছরের মধ্যে ব্যবহারিক পরীক্ষায় পাস করতে না পারলে থিওরি এবং এইচপিটি আবার নতুন করে দিতে হয়। সম্প্রতি সরকার চিন্তাভাবনা করছে যে ষাটোর্ধ্ব যেসব চালক রয়েছেন, তাঁদের আবার এইচপিটির মাধ্যমে ঝুঁকি উপলব্ধির ক্ষমতা পরীক্ষা করা হবে। উপরিউক্ত পদ্ধতিগুলো সম্পন্ন করে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে কয়েক হাজার পাউন্ড খরচ হয়। ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার ব্যাপারে নিয়মাবলি অত্যন্ত কঠিন। যে চালকের বয়স কম, ড্রাইভিং পরীক্ষায় ভালোভাবে উত্তীর্ণ হলেও তাঁর ইনস্যুরেন্সের পরিমাণ বেশি।
ইউরোপের অনেক দেশেই রাস্তায় ডিভাইডার নেই, কিন্তু লেন রয়েছে এবং প্রত্যেককে নিজেদের লেনে গাড়ি চালাতে হবে। ওভারটেক করার জন্য আলাদা লেনে যেতে হয়। হাইওয়েতে দ্রুতবেগে গাড়ি চালানোর সময় পেছনের গাড়ি এবং সামনের গাড়ির মধ্যে দূরত্ব থাকবে কমপক্ষে দুই মিটার। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে চালকের দক্ষতার একটি উদাহরণ দিই। ৬০ মাইল বেগে গাড়ি চালাচ্ছি। হঠাৎ করে হাইওয়েতে উঠে এল একটি মেষশাবক। এ পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রণ না হারিয়ে গাড়ি দুই সেকেন্ডের মধ্যে থামাতে হবে এবং এ অবস্থায় গাড়ি প্রতি সেকেন্ডে ৫৮ ফুট বেগে চলে থেমে যাবে। ড্রাইভিংয়ের ভাষায় এ বিষয়টিকে চালকের 'রিয়েকশন টাইম' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ ধরনের দক্ষতা অর্জন না হওয়া পর্যন্ত ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া যায় না।
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার একটি অন্যতম কারণ চালকের ঝুঁকি উপলব্ধি করার অক্ষমতা। দক্ষ চালক যে নেই তা নয়, তবে রাস্তায় সব চালককেই সমানভাবে দক্ষ হতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন একটি শক্তিশালী ড্রাইভিং স্ট্যান্ডার্ড এজেন্সি, যেখানে পরীক্ষক নিয়োগ হবেন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে। তাঁরা ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার জন্য চালকের তাত্তি্বক জ্ঞান, ঝুঁকি উপলব্ধি করার ক্ষমতা এবং ব্যবহারিক দক্ষতা পরীক্ষা করবেন। প্রতিটি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হবে এবং ডেটাবেইস তৈরি করা হবে। নতুন চালকের পাশাপাশি পুরনো চালককেও এইচপিটির জন্য ড্রাইভিং সেন্টারে যেতে হবে। এর জন্য যানবাহন আইনের সংশোধন প্রয়োজন। এই টেস্ট এবং সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা সরকার এখনই চালু করতে পারে। এ পদ্ধতি চালুর পাশাপাশি রয়েছে অবকাঠামোগত সমস্যার সমাধান, যার আওতায় রয়েছে যানবাহন পরীক্ষা-নিরীক্ষা, পৃথক লেন সৃষ্টি, ট্রাফিক সিগন্যাল-ব্যবস্থার উন্নয়ন, যেখানে-সেখানে ওভারটেক না করার জন্য ভ্রাম্যমাণ পুলিশ ফোর্স গঠন, ডিভাইডার নির্মাণ ইত্যাদি। তবে মনে রাখতে হবে, শুধু ডিভাইডার নির্মাণ করে এ সমস্যার সমাধান হবে না। ঝুঁকি উপলব্ধি করার ক্ষমতা না থাকলে ডিভাইডার ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। তাই সরকার ও জনগণের সমন্বিত প্রচেষ্টায় ঝুঁকি উপলব্ধির ক্ষমতা বাড়ানোর কর্মসূচি গ্রহণ এখনই প্রয়োজন।

লেখক : গ্রন্থকার ও বিজ্ঞানী

No comments

Powered by Blogger.