নবী (সা.)-এর পারিবারিক জীবন by অধ্যাপিকা হাফিজা ইসলাম

পূর্ব নাম 'বাক্কা', পরবর্তী সময়ে মক্কা নগরী, পবিত্র কোরআনে যাকে আখ্যায়িত করা হয়েছে 'ক্ষেতহীন' উপত্যকা হিসেবে। এই শুষ্ক, রুক্ষ, মরু অঞ্চলেই নবী করিম (সা.)-এর জন্ম। জন্মেই তিনি এতিম। মাতৃগর্ভে থাকাকালেই বাবাকে হারান আর শৈশবেই হারান মাকে। দাদা আবদুল মোতালিব তাঁর লালন-পালনের ভার নেন। বেড়ে ওঠেন দুধমাতা হালিমার পরিবারে। শৈশব অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই স্নেহময় দাদাকে হারিয়ে ঠাঁই হয় চাচা আবু তালেবের ঘরে।


সুষ্ঠু, সুন্দর পারিবারিক পরিমণ্ডল নির্মাণে যে গুণাবলি নিয়ামক হিসেবে কাজ করে তা প্রধানত ছোটবেলার পারিবারিক আবহ এবং অনুকূল পারিপাশ্বর্িক পরিবেশ থেকেই অর্জিত হয়। কিন্তু রাসুল (সা.) যে পরিবেশে বেড়ে ওঠেন, তা ছিল যথেষ্ট ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ। তথাপি ব্যক্তিজীবনে তিনি যে শান্তি ও সম্প্রীতিময় অনাবিল পারিবারিক আবহ সৃষ্টি করেছিলেন, তা ইতিহাসের এক বিরল ঘটনা। তাঁর মতো মহামানবের পক্ষেই কেবল তা সম্ভব। নবী করিম (সা.)-এর প্রথম স্ত্রী বিবি খাদিজা (রা.) তাঁর চেয়ে ১৫ বছরের বড় ছিলেন। এমন অসম বয়সের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক যে এত মধুর হতে পারে, তা কল্পনাতীত। সব ব্যাপারেই স্ত্রীর পরামর্শ রাসুল (সা.) অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করতেন। নবীজি (সা.)-এর ওপর বিবি খাদিজা (রা.)-এর ছিল এক বিনম্র ও স্নেহময় প্রভাব। স্ত্রীর ওপর তাঁর ছিল সশ্রদ্ধ ভালোবাসা। বিবি খাদিজা (রা.)-এর জীবিতাবস্থায় তিনি দ্বিতীয় স্ত্রী ঘরে আনেননি।
অন্যদিকে তাঁর সর্বকনিষ্ঠা স্ত্রী হজরত আবু বকর (রা.)-এর তনয়া বিবি আয়েশা (রা.) ছিলেন প্রায় ৪০ বছরের ছোট, তথাপি তাঁদের ভালোবাসা ছিল প্রগাঢ়। একজন আরেকজনের প্রতি ছিলেন গভীরভাবে অনুরক্ত। বিবি আয়েশা (রা.) যে কেবল স্বামীকে ঘরেই সঙ্গ দিতেন তা নয়, বরং সমরাঙ্গনে ও সফরেও সার্বক্ষণিক সাহচর্য দিতেন। রাসুল (সা.)-এর বিবি খাদিজা (রা.)-এর ওপর ছিল বিনম্র ও স্নেহময় প্রভাব, অন্যদিকে বিবি আয়েশা (রা.)-এর ছিল সদম্ভ প্রভাব। তাঁর কোলে মাথা রেখেই নবীজি (সা.) শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এবং তাঁর ঘরেই নবীজি (সা.)-কে দাফন করা হয়। কনিষ্ঠা স্ত্রীর প্রতি গভীর অনুরাগ থাকা সত্ত্বেও নবী করিম (সা.) বিবি খাদিজা (রা.)-কে একটি দিনের জন্যও ভোলেননি। তিনি মৃত স্ত্রীর কথা এত অধিক স্মরণ করতেন, বিবি আয়েশা (রা.) বলেন, 'নবীজি (সা.)-এর জীবিত স্ত্রীদের আমি যতটা না ঈর্ষা করি, তার চেয়ে ঈর্ষা করি মৃত স্ত্রী বিবি খাদিজা (রা.)-কে।
তিনি ছিলেন একাধারে নবীকুল শিরোমণি, রাষ্ট্রনায়ক, ধর্মপ্রচারক, সুষ্ঠু সামাজিক রীতিনীতির প্রবর্তক, অনন্যসাধারণ প্রতিভাধর মানুষ। তা সত্ত্বেও পারিবারিক জীবনে ছিলেন সহজ-সরল, কৌতুকপ্রিয়, উদার এবং প্রচণ্ড ধৈর্যশীল। স্ত্রীরা তাঁর কাছে নির্দ্বিধায় দাবিদাওয়া করতেন, তর্ক করতেন, অভিমান করতেন, কৌতুক ও হাসিঠাট্টা করতেন। এমন ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত রয়েছে। যেমন_ছোট বিবি আয়েশা (রা.) বহির্বাটিতে অনুষ্ঠিত লাঠিখেলা বা কুস্তি দেখার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করলে তিনি কাঁধ নিচু করে সেখানে ভর দিয়ে তাঁকে খেলা দেখার সুযোগ দেন।
একবার নবী করিম (সা.) উপঢৌকন হিসেবে একটি দামি পাথরের কণ্ঠহার পেলেন। তা নিয়ে স্ত্রীদের বললেন, 'আমি যাকে বেশি ভালোবাসি তাকেই এটি দেব।' স্ত্রীরা নিশ্চিত ছিলেন এটি অবশ্যই বিবি আয়েশা (রা.) পাবেন। রাসুল (সা.) রহস্যাবৃত রেখে কণ্ঠহারটি দৌহিত্রী উমামাহর কণ্ঠে পরিয়ে দিলেন। বিবি আয়েশা (রা.) মাত্র সাত বছর বয়সে নবী করিম (সা.)-এর স্ত্রী হয়ে আসেন। সঙ্গীদের নিয়ে পুতুল খেলতেন। বাবা হজরত আবু বকর (রা.) ভয় পেলেও নবীজি (সা.) তাতে নারাজ হতেন না। একদিন বিবি আয়েশা (রা.) প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে বললেন, 'আমি মরে যাচ্ছি।' রাসুল (সা.) বললেন, 'আমার আগে মরে কি সওয়াব পেতে চাও না?' বিবিও কৌতুকভরে জবাব দিলেন, 'হ্যাঁ, আমি আগে মরি আর আপনি একটি বিবি এনে আমার ঘরে তোলেন।'
নবীজি (সা.) শ্রুতিমধুর নির্মল সংগীত, নিষ্কলুষ কবিতার অনুরাগী ছিলেন। হজরত আয়েশা (রা.)-এর ঘরে দফ বাজিয়ে সংগীতানুষ্ঠান হতো। এতে একদিন হজরত আবু বকর (রা.) রাগান্বিত হয়ে মেয়ের ঘরে এসে দেখেন নবী (সা.) আয়েশার সঙ্গে বসে তা উপভোগ করছেন।
রাসুল (সা.) ছিলেন প্রেমময় স্বামী, স্নেহময় পিতা, ধৈর্যশীল নানা। বিবি খাদিজার প্রতি ছিল শ্রদ্ধাবোধ এবং অন্য স্ত্রীদের প্রতি সৌজন্যবোধ। কন্যা ফাতেমা (রা.) ছিলেন তাঁর নয়নের মণি, হাসান-হোসাইনের জন্য ছিল আদরমাখা ভালোবাসা। তিনি নামাজে সিজদায় গেলে দৌহিত্রদ্বয় তাঁর পিঠে উঠে যেত। তিনি তাদের আলগোছে নামিয়ে দিতেন, বিরক্ত হতেন না। কেবল পরিবারভুক্ত শিশু নয়, সব শিশুর জন্যই ছিল তাঁর অগাধ ভালোবাসা।
নবী করিম (সা.) বলেন, 'যে স্বামী স্ত্রীর কাছে প্রিয়, তিনি সব মানুষের কাছেই প্রিয়।' এ উক্তি যে কত বেশি গুরুত্বপূর্ণ, ওই বক্তব্যই তার উজ্জ্বল প্রমাণ।

No comments

Powered by Blogger.