রস+আলোর স্টল আর মানুষের ঢল by আদনান মুকিত

গত বছরের মতো এবারও প্রথম আলোর বর্ষপূতি উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজন করা হয় এক বিরাট অনুষ্ঠানের। ওই অনুষ্ঠানে প্রথম আলোর প্রায় প্রতিটি ফাও পাতার স্টল ছিল। পৃথিবী যে ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে, তার আরও একটি নমুনা দেখা গেল এই স্টলগুলোতে। গতবার প্রতিটি ফাও পাতার জন্য ছিল একক স্টল।


এবার স্টল ছিল জোড়ায় জোড়ায়। যাকে বলে একতাই বল! রস+আলোর জুটি হিসেবে ছিল ছুটির দিনে। ছুটির দিনের একটি আইটেম ছিল ভাগ্য গণনা। প্রখ্যাত জ্যোতিষী কাওসার আহমেদ চৌধুরী চেহারা দেখেই ভবিষ্যৎ বলে দেবেন। কিন্তু মানুষ চলে আসছিল রস+আলোর স্টলে। এক ভদ্রলোক নিজের হাত বাড়িয়ে বললেন, ভাই, আমার হাতটা দেখবেন? আমি বেশ গম্ভীর ভঙ্গিতে হাতটা দেখে বললাম,
হুম, দেখলাম।
কী দেখলেন?
হাত দেখলাম।
মানে কী? হাত দেখেছেন, ভবিষ্যৎ বলবেন না?
আমরা তো ভবিষ্যৎ বলতে পারি না। ভবিষ্যৎ বলার ব্যাপারটি পাশের স্টলে। ভদ্রলোক বাড়ানো হাতটি ঝট করে সরিয়ে পাশের স্টলে চলে গেলেন। একটু পর আরেকজন এসে বললেন, হাত দেখাব। কাওসার ভাই কোথায়? আমি আমাদের কার্টুনিস্ট কাউসার ভাইকে দেখিয়ে দিলাম। কাউসার ভাইয়ের চেহারায় জ্যোতিষী ভাব না থাকায় ভদ্রলোক নিজ দায়িত্বে পাশের স্টলে চলে গেলেন। একবার মনে হলো যাই, চেহারা দেখিয়ে ভবিষ্যৎ জেনে আসি। পরে মনে হলো, থাক, কী দরকার। আমার যে চেহারা, ভবিষ্যৎ ভালো হওয়ার কোনো কারণ নেই। মানুষের তুমুল আগ্রহ দেখে রস+আলোর তিন দুর্ধর্ষ কার্টুনিস্ট জুনায়েদ আজীম, মহিউদ্দিন কাউসার ও শিখা স্টলের ভেতর নিজেদের পজিশন নিয়ে নিলেন। ‘আঁকিয়ে নিন নিজের ভবিষ্যৎ’ শিরোনাম দিয়ে শুরু হলো ক্যারিকেচার আঁকা। দেখা গেল, ভবিষ্যৎ জানার চেয়ে ভবিষ্যৎ দেখার প্রতি মানুষের আগ্রহ বেশি। নিজের বিকৃত ছবি দেখার জন্য মানুষের সে কী আগ্রহ! পাশেই নকশা আর আনন্দর স্টলে তারকারা বসা, স্টেজে বিশিষ্ট শিল্পীরা গান গাইছেন। কিন্তু সেদিকে তাঁদের খেয়ালই নেই। তাঁদের মনোভাব অনেকটা আজ পাশা খেলব রে শ্যাম টাইপ। আজ ছবি আঁকাব রে শ্যাম! স্টলের সামনে মানুষের ভিড় দেখে মনে হলো এখানে ন্যায্য মূল্যে চাল বিক্রি হচ্ছে। কার্টুনিস্টরা কার্টুন আঁকছেন, আমি তো আর বসে থাকতে পারি না। তাই অত্যন্ত ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে ক্যারিকেচার করাতে আগ্রহীদের সিরিয়াল লেখা শুরু করলাম। প্রথমে ভালোই লাগছিল। কিন্তু মানুষের ঢল বাড়ার পর থেকে বুঝতে পারলাম, ক্যারিকেচারের সিরিয়াল লেখার চেয়ে টিভির মেগা সিরিয়াল লেখা অনেক সহজ।
কার্টুনিস্টদের আঁকা ছবি জাতীয় পরিচয়পত্রের ছবির চেয়ে খারাপ হলে কর্তপক্ষ দায়ী নয়—এই পোস্টার দেখেও মানুষকে ক্যারিকেচার করানো থেকে বিরত রাখা যাচ্ছিল না। নিজেদের ছবি দেখে খুশি হওয়ায় আমার মনে হলো, এত এত টাকা খরচ করে জাতীয় পরিচয়পত্রে যে ছবি আসে তা চেনাই যায় না। তারচেয়ে কার্টুনিস্টদের দায়িত্ব দিলেই হয়। তাঁরা ক্যারিকেচার আঁকলেও বেশ ভালোই চেনা যাবে।
ক্যারিকেচার ছাড়াও স্টলে ছিল বিনা মূল্যে রাজাকার নিধন প্রকল্প। বন্দুক দিয়ে ডার্ট ছুড়ে রাজাকার মারতে হবে। মানুষ মহা উৎসাহে রাজাকার মারছিল। কিন্তু হঠাৎ কীভাবে যেন বন্দুকটা নষ্ট হয়ে গেল। বর্তমানে রাজাকারদের বিচারকার্যটা যেমন ঝুলে আছে, বন্দুক না থাকায় আমাদের রাজাকার নিধন প্রকল্পটাও সে রকম ঝুলে রইল। আরও ছিল বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী দেখার বিশেষ ব্যবস্থা। বায়োস্কোপের মতো বাক্সের ফুটো দিয়ে তাকালেই প্রাণী দেখা যাবে ভেবে সবাই তাকায়। আমরা জিজ্ঞেস করি, ভাই, প্রাণী দেখেছেন? উত্তর আসে, এ তো আমি! আমরা বলি অভিনন্দন! আপনিই সেই বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী। কেউ কেউ দেখেই সঙ্গে সঙ্গে মাথা সরিয়ে হাসিমুখে বলে, কিছু দেখি নাই।
এ ছাড়া ছিল কথা বলা টিয়াপাখি। ছিল গর্তে বল ফেলার প্রতিযোগিতা। গর্তে বল ফেলতে পারলেই পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয়েছে রস+আলোর সার্টিফিকেট আর বাঁশ। বাঁশ পেয়ে কেউ যে এত খুশি হতে পারে তা না দেখলে বোঝা কঠিন। সাধারণ মানুষ, আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে যাঁরা খেলায় অংশ নিয়েছেন, সবাইকে পাইকারি হারে বাঁশ দেওয়া হয়েছে। মানুষ বাঁশ পেয়ে খুশি, আর আমরা মানুষকে বাঁশ দিয়ে খুশি। তবে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন খেলায় অংশ না নেওয়ায় তাঁকে বাঁশ দেওয়া সম্ভব হয়নি। সবাইকে বাঁশ দিতে দিতে একপর্যায়ে বাঁশ, সার্টিফিকেট দুটোই শেষ হওয়ায় আবারও প্রমাণিত হলো—অভাব অসীম, কিন্তু সম্পদ (বাঁশ) সীমিত! নাহ, অর্থনীতিবিদেরা দেশের অর্থনীতি ঠিক করতে না পারুক, তত্ত্ব ভালোই দিতে পারেন।
অনুষ্ঠান শেষ। রস+আলোর বিশাল ব্যানারের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার পর্বও শেষ। তখনই আমাদের মনে হলো, স্মৃতি হিসেবে শিশির ভট্টাচার্যের কার্টুন আর রস+আলোর লোগো সংবলিত ব্যানারটা সংরক্ষণ করা উচিত। যেই ভাবা সেই কাজ। আমরা মহা-উৎসাহে কাঠের ফ্রেম থেকে ব্যানারটা খুলতে লাগলাম। কাঠ, পেরেকের খোঁচাও আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারল না। ব্যানারটা খুলে ভাঁজ করা হলো। ব্যানারটাকে নিজের ঘরের দেয়ালে লাগিয়ে রাখার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিলেন সিমু ভাই। উনি সম্পাদক মানুষ। ওনার কথা, ব্যানার কোনোটাই ফেলে দেওয়া যায় না। তাই ওটা নিয়ে আমরা সবাই সম্মেলন কেন্দ্রের বাইরে এলাম। ব্যানারটাকে একপাশে রেখে সারা দিন কে কত কষ্ট করল, ক্যালকুলেটর ছাড়াই তার হিসাব করছিলাম আমরা। হঠাৎ খেয়াল হলো, অনেক রাত হয়ে গেছে। বাসায় যাওয়া দরকার। ঘুরে তাকিয়ে দেখি ব্যানার নেই! হিসাব-নিকাশে এতই মশগুল ছিলাম যে কে বা কারা ব্যানারটা নিয়ে গেল তা টেরই পাইনি। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করেও ব্যানার পাওয়া গেল না। আমাদের সব পরিশ্রম মাঠে নয়, একেবারে সম্মেলন কেন্দ্রের বাইরের রাস্তায় মারা গেল। মনের দুঃখে আমরা যে যার বাড়ি ফিরে গেলাম। ফুটপাতের কোনো চায়ের দোকানের ছাদ হিসেবে ব্যানারটিকে দেখলে আমরা মোটেই অবাক হব না।

No comments

Powered by Blogger.