একটি প্রশ্নের অবতারণা by মোহীত উল আলম

প্রাতঃস্মরণীয় গায়িকা ফিরোজা বেগমের একটি আক্ষেপজনক উক্তি (কালের কণ্ঠ, ২০ মে ২০১০) আমাকে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অবস্থান নিয়ে খুব ভাবাল। তিনি বলেছেন, নজরুলকে জাতীয় কবি করা হলে জাতীয় কবির মর্যাদায় তাঁকে রাখা উচিত। গত বছর দুটো জন্মজয়ন্তী অনুষ্ঠানে গিয়ে আমার একটা কী রকম যেন অনুভূতি হয়েছিল, যার সঙ্গে এখন দেখছি ফিরোজা বেগমের মন্তব্য মিলে যাচ্ছে। প্রথমটি ছিল রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী।


দেখলাম ঢাকার সাংস্কৃতিক, রাজনীতিক ও ব্যবসায়িক এলিট এমন কেউ নেই, যিনি ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না। এর কিছুদিন পর হলো নজরুল জন্মজয়ন্তী, হলের মধ্যে দেখলাম জীর্ণ-শীর্ণ পরিবেশ, হাতে গোনা কয়েকজন নজরুলশিল্পী ছাড়া আর চিনতে পারি এমন কোনো জাতীয়ভাবে পরিচিত তারকা দেখলাম না। কিন্তু দেখলাম হল ভর্তি দর্শকদের বেশির ভাগই সাধারণ গোছের মানুষ। দুটোই ছিল জাতীয় অনুষ্ঠান, কিন্তু দর্শক সমাগমের এই হেরফের অবস্থা দেখে আমার তখন বাসায় আসতে আসতে শ্রেণীচিন্তাটা আবার নতুন করে মাথায় ঢুকল। আর কালকে ফিরোজা বেগমের মন্তব্যটি পড়ে ঘুমিয়ে পড়া চিন্তাটা আবার চাঙ্গা হয়ে উঠল।
ফিরোজা বেগমের মতো আমিও মনে করি রবীন্দ্র-নজরুল তুলনা অমার্জনীয় অবিবেচনাপ্রসূত একটি অভিব্যক্তি। এ লেখায়ও আমি তা করতে যাচ্ছি না, কিন্তু আমি যেটা বলতে চাইছি, সেটা হচ্ছে যদিও নজরুলকে আমরা জাতীয় কবি বানিয়েছি, কিন্তু যারা সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণ করছে বাংলাদেশে_ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামের এলিট মহল বা অন্যান্য এলাকায়ও_তাদের এবং নজরুলের সাহিত্যের মূল চরিত্রের মধ্যে বিরাট একটা চিড় আছে, যা অমোচনীয়, যা মিলে যাওয়ার মতো নয়, কিন্তু যা আমরা একটা রাজনৈতিক-সাম্প্রদায়িক চিন্তা থেকে দেখেও না দেখার ভান করি, চিনতে পেরেও চিনি না এমন ভাব করি এবং এ শঠতামূলক অভিব্যক্তিরই সমালোচনা আসলে করলেন ফিরোজা বেগম। নজরুল সাহিত্যের মূল চারিত্র্য হচ্ছে বিদ্রোহ, আর আমাদের সাংস্কৃতিক-রাজনীতিক অভিভাবক মহলের মূল চারিত্র্য হচ্ছে আপসকামিতা ও উঞ্ছবৃত্তি। নজরুল কুসংস্কারকে আঘাত করেছেন বারবার, আর আমরা কুসংস্কারকে সযতনে লালন করি।
যেমন_যে বিখ্যাত চিঠিতে (জুন ৩, ১৯১৯) রবীন্দ্রনাথ ইংরেজ ভাইসরয় লর্ড চেমসফোর্ডকে তাঁর নাইটহুড বা স্যার উপাধি বর্জনের সিদ্ধান্ত জানালেন, সেখানেও জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড নিয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রতিক্রিয়া তীব্র হলেও অত্যন্ত মার্জিত ভাষায় তিনি এটাই বলতে চেয়েছেন যে ইংরেজরা যে নিয়মে ভারত শাসন করছে, তা মনুষ্যত্বের অবমাননা বৈ কিছুই নয়। প্রত্যাঘাত বলতে যেটা বোঝায়, সেটা রবীন্দ্রনাথের বিদ্রোহী চেতনায় ছিল না এবং এ প্রত্যাঘাতমূলক অভিযানে অংশ নিতে স্বয়ং গান্ধীও রবীন্দ্রনাথকে প্ররোচিত করতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথ কাঠামোগত পরিবর্তনের বদলে প্রাধান্য দিতেন অন্তর্গত পরিবর্তনকে। সে জন্য রাজনৈতিক পরিবর্তনের চেয়েও তাঁর কাছে জরুরি ছিল অর্থনৈতিক পরিবর্তন। তাঁর বোলপুর ও পতিসরের কৃষিখামার প্রকল্পগুলো এ অন্তর্গত পরিবর্তনের পরিচায়ক।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এই অন্তর্গত পরিবর্তনের দর্শনকে বাঙালি শিক্ষিত সমাজ গ্রহণ করেছে ভাবলে ভুল হবে। বস্তুত যে উদ্বেগ থেকে গান্ধী রবীন্দ্রনাথকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ পাসওয়ালা ছেলেদের হাতে চড়কা ধরিয়ে দিতে অনুরোধ করেছিলেন, সে একই উদ্বেগ থেকে লক্ষ করা যায় যে আমরা রবীন্দ্রনাথের খ্যাতি, তাঁর আন্তর্জাতিক যোগাযোগ, তাঁর শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা, কিংবা ঠাকুরবাড়ির মহিলাদের পর্যন্ত ইংরেজিতে সড়গড় হওয়া, কিংবা তাদের শাড়ির তলায় ব্লাউজ পরার রীতির উদ্বোধন করা, কিংবা জমিদারি নিয়ন্ত্রণে তাঁর পদ্মাবোটে বিহার, কিংবা শিলাইদহ বা শাহজাদপুরের কুঠিবাড়ির জমিদারিত্ব প্রভৃতি বাহ্যিক কাঠামোগত প্রকাশ দেখে দারুণভাবে অভিভূত হয়েছি, কিন্তু তাঁর রচনার গভীর মর্মদেশে আমরা কখনো পেঁৗছাতে পারি না। তাঁর 'এসব স্নান মূঢ় মূক মুখে দিতে হবে ভাষা'র সামাজিক প্রেক্ষাপট নিয়ে যেমন আমরা বিচলিত হইনি, ঠিক তেমনি তিনি কেন তাঁর পুত্র ও জামাতাকে কৃষিকাজে আধুনিকায়নের ওপর লেখাপড়া করতে আমেরিকা পাঠিয়েছিলেন, কিংবা কেন তিনি ভারতবর্ষে প্রথম (?) বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে প্রবৃত্ত হলেন, সেসব পরিপ্রেক্ষিতে আমরা তাঁকে কখনো বিবেচনা করি না। এক অর্থে ভারতীয় শিক্ষিত সমাজ (বিশেষত বাঙালি শিক্ষিত সমাজ) যে অর্থে ইংরেজি সাহিত্য ও দর্শনের পরমাত্মাটা গ্রহণ না করে তাদের সাহেবিয়ানাকে গ্রহণ করতে ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল, ঠিক সে অর্থে রবীন্দ্র সাহিত্যের অন্তর্গত বৈশিষ্ট্য মানবতা ও মৌলিক চিন্তার চর্চাকে গ্রহণ না করে রবীন্দ্রনাথকে 'আইকন' বানিয়ে একটি স্বতন্ত্র জনসংস্কৃতি ও গণমুখিনতা বিচ্ছিন্ন অভিজাত মহল তৈরিতে ব্যাপৃত থেকেছে। এ কথা পশ্চিমবঙ্গেও সত্য, সত্য বাংলাদেশেও। এ দেশের শিক্ষিতজন ইংরেজদের বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য অনুকরণে যেমন একটি সাহেবি গোষ্ঠী তৈরিতে এখনো ব্যস্ত, তেমনি রবীন্দ্রনাথের বাহ্যিক দিকটি অনুসরণ করে একটি শুচিবাইগ্রস্ত অভিজাত রবীন্দ্রগোষ্ঠী তৈরিতে ব্যস্ত।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এমন যখন অবস্থা, তখন নজরুল আরো একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিল। নজরুলের সাহিত্যের তুলনায় রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য অপেক্ষাকৃত মৃদুভাষী, যদিও গভীরতর ও সর্বগ্রাসী। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ প্রত্যাঘাতে বিমুখ ছিলেন, আর নজরুল ছিলেন প্রত্যাঘাতে আগ্রাসী। একটি মেকি নতজানু শিক্ষিত সমাজ নজরুলের মতো বিদ্রোহী সত্তাকে ধারণ করবে তার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। সে বুদ্ধিবৃত্তিক কাঠামো কখনো তৈরি হয়নি।
এখানে একটা ঘটনার উল্লেখ করলে নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের প্রমাণ পাওয়া যাবে। ১৯৩৩ সালে রাউজানে এক সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। নজরুল আসেন, আরো ছিলেন কবি আবদুল কাদির, মাহবুব-উল আলম, আবুল ফজল, কামালুদ্দীন আহমদ খান (বেগম সুফিয়া কামালের স্বামী) এবং কবি ওহীদুল আলম। সেখানে 'সাপ্তাহিক মোহাম্মদী' পত্রিকার সম্পাদক নজির আহমদ চৌধুরী তাঁর বক্তৃতায় কবি নজরুল ইসলাম ও সাহিত্যিক মাহবুব-উল আলমের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলেন যে ব্রিটিশকে মুসলমানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাহায্য করার জন্য এ দুই সাহিত্যিক ৪৯ সংখ্যক বাঙালি রেজিমেন্টে যোগ দিয়ে মহাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। প্রত্যুত্তরে নজরুল বললেন, 'আপনারা শুনেছেন, আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, আমরা নাকি ব্রিটিশকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাহায্য করতে যুদ্ধে গিয়েছিলাম। আমি বলতে চাই, আমরা যখন যুদ্ধে যাই, আমাদের মধ্যে ছিল দারুণ তারুণ্য। তারুণ্যের তাগিদ সহ্য করতে না পেরে আমরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ হচ্ছে, কে জিতবে, কে হারবে, এসব তলিয়ে দেখার মন ও মেজাজ আমাদের ছিল না।' (ওহীদুল আলম, 'পৃথিবীর পথিক')
নজরুলের সাহিত্যের আর সব কিছু বাদ দিই, শুধু কবিতাগুলোর কথা ধরি : সেখানে যে সক্রিয় বিদ্রোহ সব কিছুর বিরুদ্ধে, তাকে ধারণ করবে সে রকম শিক্ষিত সংস্কৃতিমান মহল তো এখনকার এলিট গোষ্ঠী নয়। নজরুলের কবিতা থেকে বিভিন্ন বিষয়ে নজরুলের বিরোধিতার সামান্য উদাহরণ দেওয়া যাক। যেমন_পর-শাসন ("কারারঐ লোহকবাট/ভেঙে ফেল, কর রে লোপাট/রক্ত-জমাট/শিকল-পুজোর পাষাণ-বেদি!' [ভাঙার গান], অর্থনৈতিক শোষণ ("দেখিনু সেদিন রেলে,/কুলি ব'লে এক বাবু সা'ব তারে ঠেলে দিল নিচে ফেলে!/চোখ ফেটে এল জল,/এমনি ক'রে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?" [কুলি-মজুর], ধর্মীয় ভণ্ডামি ("হায় রে ভজনালয়,/তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়!/মানুষেরে ঘৃণা করি'/ও কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি/...পূজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল!_মূর্খরা সব শোনো,/মানুষ এনেছে গ্রন্থ;_গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো" [মানুষ], নারীর সমানাধিকার ("সাম্যের গান গাই_/আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোন ভেদাভেদ নাই।" [নারী]।
লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি ও মানববিদ্যা বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ, ঢাকা

No comments

Powered by Blogger.