লিবিয়ার আগুন নিভবে কি সহজে by মোস্তফা হোসেইন

কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফির রাজত্ব শেষ। তাহলে কার রাজত্ব শুরু হলো লিবিয়ায়? আপাতত কোনো সরকার নেই ওখানে। কারণ বিদ্রোহীদের জোড়াতালি দেওয়া মুস্তাফা আবদেল জলিলের নেতৃত্বাধীন গ্রুপকে সরকার বলারও সুযোগ কম। এদিকে গাদ্দাফির প্রাসাদ এখন বিদ্রোহীদের দখলে। গাদ্দাফির ক্যাপ মাথায় দিয়েছে বিদ্রোহী সৈনিকদের একজন। খুব ভালোভাবেই প্রচার হচ্ছে সেই ছবি।

পত্রিকাগুলো কিংবা টেলিভিশন_সর্বত্রই সুন্দর করে প্রচার করেছে সেই চিত্র। কিন্তু গাদ্দাফি পরিবারের কোনো সদস্য কিংবা গাদ্দাফির কোনো খবর কি আছে পশ্চিমা প্রচারমাধ্যম কিংবা বিদ্রোহীদের কাছে? কেউ জবাব দিতে পারছে না স্পষ্ট করে। কিন্তু গাদ্দাফি যে বিদ্রোহীদের আওতায় নেই, তা স্পষ্ট। এমনকি পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে যেমন প্রচার করেছে সাইফ অর্থাৎ গাদ্দাফির দ্বিতীয় ছেলেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেই সংবাদটিও মিথ্যা বলে প্রমাণ হয়ে গেছে। এখন তাই প্রশ্ন আসতেই পারে, গাদ্দাফিকে পরাস্ত করার যে সংবাদ পশ্চিম নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে, প্রকৃত অর্থে কতটা পরাস্ত হয়েছে গাদ্দাফি বাহিনী? কিংবা বিদ্রোহীদের সাফল্যকে যতটা বড় করে দেখানো হয়েছে, সর্বাংশে তা সঠিক কি না। চার দশকেরও বেশি সময় দোর্দণ্ড প্রতাপ আর প্রভাব খাটিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন মুয়াম্মার গাদ্দাফি। সেই রাজত্বকাল এতটাই স্বৈরাচারী কায়দায় চালানো হয়েছে যে তার বর্ণনা করা সত্যিই কঠিন। যে কারণে গাদ্দাফি শুধু স্বৈরাচার হিসেবেই চিহ্নিত নন, একজন একগুঁয়ে শাসক হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। তবে তিনি ছিলেন প্রচণ্ড পশ্চিমবিরোধী মানুষ। পশ্চিমের রক্তচক্ষুর তোয়াক্কা না করে আফ্রিকার যে কয়জন রাষ্ট্রনায়ক রাজত্ব করে গেছেন, নিঃসন্দেহে গাদ্দাফি তাঁদের অন্যতম। তিনি উগান্ডার ইদি আমিনের মতো সাদা চামড়ার জুতা পরেননি সত্য, কিন্তু তাঁর চলনবলন তাঁর চেয়ে কম ছিল না। যে কারণে পশ্চিমের শক্তিধররা তাঁকে কখনোই ভালো চোখে দেখেনি। তিনি নিজে পশ্চিমের রক্তচক্ষুর তোয়াক্কা করেননি নিজের দেশের তেল রক্ষা করার কৌশল হিসেবেও। সুতরাং আজকে লিবিয়ায় গাদ্দাফি শাসনের পতনের পর যাঁরা খুশি হয়েছেন, তাঁদের ভাবতে হবে লিবিয়ার জাতীয় সম্পদ তেলের ভবিষ্যৎ নিয়েও। অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলতে হবে, আজকে লিবিয়ায় যে অভ্যুত্থান হয়েছে, সেই অভ্যুত্থান কি আদৌ সে দেশের সাধারণ মানুষের জন্য শান্তিপূর্ণ একটি আবাসভূমি উপহার দিতে পারবে? ছয় মাস ধরে যে গৃহযুদ্ধ সে দেশে চলেছে, তাতে তো অন্তত ৩০ হাজার মানুষকে বলি হতে হয়েছে। এই ৩০ হাজার মানুষের আপনজনরা কি এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাবে নিকটজনের রক্তের কথা? সে দেশ থেকে অন্তত ১০ লাখ মানুষ শরণার্থী হয়েছে। আর অভ্যন্তরের কথা যদি বলা হয়, তাহলে অন্তত আড়াই লাখ মানুষের বাসস্থান ত্যাগের কথা আমলে আনতে হবে। এই মানুষগুলো তো নিজ নিজ এলাকা ছেড়ে নিরাপত্তার জন্য অন্যত্র গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। এই সুযোগে সেসব সম্পদ দখল করে নিয়েছে লিবিয়ারই কিছু মানুষ। এখন ধরা যাক, লিবিয়া গাদ্দাফিশূন্য একটি দেশ হলো। তাতে কী হবে? একটি বাড়ি ছেড়ে যে মানুষটি অন্যত্র গেছে, সে ফিরে আসার পর এই সম্পদ দখল নিয়ে কী কামড়াকামড়িই না শুরু হবে! এই সংঘাত কি স্বাভাবিকভাবে শেষ হবে?
বিপজ্জনক অবস্থা দেখা দেবে তেলের খনিগুলোতে। তেল উৎপাদনই লিবিয়ার প্রধান অর্থকরী মাধ্যম। সেখানে নির্ঘাত সৃষ্টি হবে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি, যা সামাল দেওয়া নতুন সরকারের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। এই মুহূর্তে দৈনিক পাঁচ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদন হচ্ছে, যা ২০১০ সালে ছিল দৈনিক ১৮ লাখ ব্যারেল। সেই হিসাবে নিকট-ভবিষ্যতে, এমনকি ২০১৩ সালে গিয়েই ১১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার লোকসানের মুখ দেখবে দেশটি।
আজকে যাঁরা ইংরেজি 'ভি' অক্ষর প্রদর্শন করে মজা পাচ্ছেন, তাঁদের ভবিষ্যৎ নিয়েও কিন্তু সন্দেহ বেড়েই যায়। কারণ এই 'ভি'ওয়ালারাই বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু করবেন। আর এই মারামারির সূত্র কিন্তু ধরিয়ে দিয়েছে বাইরে থেকেই। অবাধে অস্ত্র ও অস্ত্র পরিচালনার প্রশিক্ষণ সে দেশটির সাধারণ মানুষকে হিংস্রতায় ডুবিয়ে দিয়েছে। সেই স্বাদ-গন্ধ কি তাদের মুক্তি দেবে? শুধু কি ভবিষ্যৎই সন্দিগ্ধ? সেখানে অদূরভবিষ্যতে কী হতে পারে, তার কিছু লক্ষণও দেখা গেছে ইতিমধ্যে। মাত্র কয়েক দিন আগে, জুলাই মাসে, বিদ্রোহীদের এক কমান্ডার জেনারেল আবদুল ফাতাহ ইউনিস নিহত হন বিদ্রোহীদেরই গুলিতে। লিবিয়ার উপজাতিগুলোকে বিভেদ ভুলে গিয়ে ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন বিদ্রোহীদের নেতা মুস্তাফা আবদেল জলিল। কিন্তু সেখানকার উপজাতিদের মধ্যে প্রতিশোধস্পৃহা এতই প্রকট যে তাঁর এই আহ্বান যে বৃথা যাবে, তা বোঝা যায়। অদূরভবিষ্যতে লিবিয়ার ঐক্য কি প্রত্যাশা করা যায়? পশ্চিমা শক্তি ও লিবিয়ার মানুষ ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিলের নেতৃত্ব আপাত মেনে নিলেও ভবিষ্যতে তাদের মধ্যে বিভাজন নিশ্চিত। আর ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিলের অভ্যন্তরে যে বিভাজন, তাও বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই। এই কাউন্সিলে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে আদর্শ ও অবস্থানগত এতই পার্থক্য যে তাদের ঐক্যসূত্র খুব একটা দৃঢ় হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ এদের মধ্যে রয়েছে উপজাতি, বুদ্ধিজীবী, ইউরোপ ও আমেরিকাপ্রবাসী তরুণদের একটি গ্রুপ, এমনকি সেখানে ইসলামী উগ্রপন্থীদেরও দেখা যায়। এই মিশ্রণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অনৈক্যকে উৎসাহিত করবে। লিবিয়া ১৪২টি উপজাতির দেশ। সেখানে একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন কর্নেল গাদ্দাফি। আর সে কাজে তাঁকে হতে হয়েছে স্বৈরশাসক। প্রশ্ন হচ্ছে, গাদ্দাফিবিহীন লিবিয়ায় সেই শতধাবিভক্ত উপজাতিদের গোত্রীয় স্বার্থ সংরক্ষণ করা আদৌ সম্ভব হবে কি?
শুধু তা-ই নয়, পশ্চিমারা যে আশায় সেখানে গণতন্ত্রের কথা বলে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে, সেই আশাও তাদের পূরণ হয় কি না সন্দেহ। কারণ উপজাতিগুলোর মধ্যে উগ্র মুসলিম গোষ্ঠীও রয়েছে। তারা কি গাদ্দাফির পরিবর্তে পশ্চিমা কোনো তাঁবেদারকে মেনে নেবে? তালেবানি আফগানিস্তান কিংবা সাদ্দাম-পরবর্তী ইরাকের মতোও যদি গাদ্দাফিবিহীন লিবিয়া হতো, তাহলেও হয়তো সান্ত্বনা থাকত। কিন্তু পরিস্থিতি তার চেয়ে ভয়াবহ হবে না কি? অন্তত সেখানকার পরিবেশ-পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে ঘটনা অস্বাভাবিক হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলেই মনে করা হয়। কেউ কেউ যদি বসনিয়া, পূর্ব তিমুরের উদাহরণ আনতে চান, তা পারেন। হয়তো বা বলতে পারেন, দুটি স্থানেই ইরাক কিংবা আফগানিস্তানের চেয়ে কিছুটা ভালো পরিবেশ বিরাজ করছে। কিন্তু এটা ঠিক, লিবিয়া তাদের অনুসারী হবে না। সেখানে জাতিসংঘের শান্তিবাহিনী নেই যে ওখানকার খারাপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য নিয়োজিত থাকবে। আবার যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সেনাবাহিনীও সেখানে সরাসরি তৎপর নয়। এই পরিস্থিতিতে সেখানকার গোলমেলে পরিবেশ সময়ান্তরে বাড়তেই থাকবে, এমন সন্দেহ করা অস্বাভাবিক নয়। এই নিবন্ধ লেখার সময়ও ত্রিপোলির বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে গাদ্দাফি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগীদের লড়াই হচ্ছে। গাদ্দাফির নিজ শহর তিরতে প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখে পড়েছে বিদ্রোহী বাহিনী। সব মিলে ধারণা করা যায়, বিদ্রোহীরা যত বড় গলায়ই নিজেদের সাফল্য বর্ণনা করুক না কেন, সেখানে শান্তির আশা ক্ষীণ।
- লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.