চালচিত্র-পর পর নারীর আত্মহনন ও সমাজের বিষফোড়া by শুভ রহমান

হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও মাদারীপুর_পর পর তিন দিনে তিনটি জায়গায় নারী নির্যাতন ও গ্রাম্য সালিসের জুলুমের অসহায় শিকার হয়ে নারীর আত্মহননের ঘটনা ঘটে গেল। আমাদের গ্রামসমাজ যে কী নিষ্ঠুর নারী নির্যাতন ও সালিস, ফতোয়া, বিচার-আচারের নামে কী ভয়ানক অন্যায়-অবিচারের নরক হয়ে রয়েছে, উলি্লখিত উপর্যুপরি আত্মহননের ঘটনাগুলো সে সমাজবাস্তবতা নগ্ন করে দিয়েছে।


জাতীয় দৈনিকের খবর অনুযায়ী, ১৫ আগস্ট হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলায় আন্দিউড়া ইউনিয়নের সুলতানপুর গ্রামে পরকীয়া প্রেমের অপবাদ আর মাতব্বরদের ডাকা সালিসে সমাজচ্যুত হওয়ার রায় মেনে নিতে পারেননি গৃহবধূ ফেরদৌসী বেগম (৩৫)। তাই ক্ষোভে-অপমানে তিনি তাঁর চার সন্তান নিয়ে ঝাঁপ দেন ট্রেনের নিচে। এতে মায়ের সঙ্গে মৃত্যু হয় দুই সন্তানের। প্রাণে বেঁচে যায় অন্য দুই সন্তান। তারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
গত ১৭ আগস্ট মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে পতনঊষা ইউনিয়নের রামেশ্বরপুর গ্রামে কনের বাপের বাড়ি থেকে ইফতার আনিয়ে না দেওয়ার জন্য স্ত্রীকে মারধর করার পর স্বামীর ওপর রাগ ও অপমানে শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন রুমা বেগম (২৮)।
এরপর গত আগস্ট মাদারীপুর সদর উপজেলায় এক গ্রাম্য সালিসে বেত্রাঘাতের অপমান সইতে না পেরে শিরীন আখতার (১৫) নামে দশম শ্রেণীর এক ছাত্রী আত্মহত্যা করে। শিরীনের ছাগল প্রতিবেশীর গাছপালার ক্ষতি করায় প্রতিবেশী তাকে মারধর করে। এতে শিরীনের মায়ের নালিশের পরিপ্রেক্ষিতে ওই প্রতিবেশী এবং গ্রামের অন্য ১৫ জন বাসিন্দা বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে সালিস বৈঠক করে। তারা শিরীনকে দোষী সাব্যস্ত করে প্রতিবেশী শাহ আলমের পায়ে ধরে মাফ চাইতে বলে। শিরীন এর প্রতিবাদ করলে তারা তাকে বেত্রাঘাত করে।
এগুলো নারী নির্যাতন ও নারীর আত্মহননের অতি সাম্প্রতিক ঘটনা। দীর্ঘকাল ধরেই এ রকম নির্যাতন ও আত্মহননের ঘটনা আমাদের অন্ধকার ও পশ্চাৎপদ গ্রাম্য সমাজের একটা অনড় বাস্তবতা হিসেবেই বিরাজ করছে। আমাদের গ্রামগুলো অর্থনৈতিকভাবে আরো ভেঙে পড়ছে। তার যোগাযোগব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসাসেবা, শিক্ষাব্যবস্থা_কোনো কিছুই উন্নত তো হচ্ছেই না, বরং সাধারণভাবে গ্রামীণ মানুুষের ওপর, বিশেষ করে গ্রামীণ নারীর ওপর নানা রকম অত্যাচার-নির্যাতন, শোষণ-বঞ্চনা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে। দু-চারটি গ্রামে দু-চারটি পরিবার তাদের বংশধরদের বিদেশগমন ও প্রবাস থেকে অর্থ উপার্জন করে দেশে প্রেরণের সুবাদে কিঞ্চিৎ সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের মুখ দেখলেও, তাদের বাহ্যিক চেহারা, ঘরবাড়ির হাল কিছু উন্নত মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে গ্রামসমাজ হিসেবে তারা ক্রমেই আরো গাঢ় অন্ধকারের আবর্তেই নিক্ষিপ্ত হয়েছে। শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে ভাগ্যবানদের একাংশ বিত্তশালী ও শিক্ষার আলোকপ্রাপ্ত হওয়ার কোনো প্রভাবই আমাদের গ্রামসমাজ ও সারা দেশকে উন্নত-আলোকিত করতে পারেনি। সার্বিক দৃষ্টিতে কি শহর, কি গ্রাম_সর্বত্রই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এখন পর্যন্ত সামাজিক অন্যায়-অবিচার, অত্যাচার-উৎপীড়ন, শোষণ-বঞ্চনার একরকম অসহায় শিকারই হয়ে রয়েছে। গ্রামসমাজে নিপীড়িত-নির্যাতিতদের অবস্থা সবচেয়ে করুণ ও মর্মান্তিক। এর মধ্যে শহর ও গ্রামে সমভাবেই নারীরা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত। শহরে থানা-পুলিশ, আইনশৃঙ্খলাব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে উৎপীড়িতদের প্রতিকারের জন্য একটু বেশি মজুদ থাকলেও গ্রামসমাজে গ্রাম্য সালিসই একমাত্র ভরসা। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেই গ্রাম্য সালিসও রক্ষক সেজে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। গ্রাম্য সালিসের বস্তুত তেমন কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। কিন্তু তারাই আইনের রক্ষক সেজে কার্যত আইন হাতে তুলে নিয়ে দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার-নিপীড়নের খৰই হেনে চলেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গ্রাম্য টাউট, মতলববাজ, প্রভাবশালী ও কায়েমি স্বার্থবাদীদের দিয়ে আমলাতান্ত্রিকভাবেই এসব সালিস কমিটি গঠিত হয়। এ ব্যবস্থার গণতন্ত্রায়ণ, বিশেষ করে সমাজটা পুরুষতান্ত্রিক থেকে যাওয়ায় এবং আজ পর্যন্ত সমাজের কোনো রকম গণতন্ত্রায়ণ না হওয়ায় সুদূরপরাহতই রয়ে গেছে। শহরেও নারী নির্যাতনের মূলে রয়েছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজই। আইনশৃঙ্খলা, থানা-পুলিশ সব ক্ষেত্রে সব সময় নারীকে নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করতে পারছে না। আইনের অপ্রতুলতা, ঘুষ-দুর্নীতি, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মানবিকতার প্রচণ্ড অভাব নারীকে চরম অসহায়ত্বের শিকারে পরিণত করে রেখেছে। মৌলভীবাজারেই দীর্ঘকাল আগে গ্রাম্য সালিস ও ফতোয়ার অসহায় শিকার হয়ে নূরজাহানকে জীবন্ত মাটিতে পুঁতে পাথর নিক্ষেপ করে শাস্তি দেওয়ার নিষ্ঠুর বিধান শেষ পর্যন্ত নূরজাহানের আত্মহননেই পর্যবসিত হয়। কমবেশি একই নিপীড়নের ধারা গ্রামে ও শহরে, বিশেষ করে অন্ধকারাচ্ছন্ন গ্রামাঞ্চলে অব্যাহত রয়েছে।
নারী বস্তুত শত শত বছর ধরেই নির্যাতিত হয়ে চলেছে। গোঁড়া হিন্দু সমাজে একসময় নারীর সহমরণের বা সতীদাহের বাধ্যতামূলক বিধান ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনামলেই রদ করে নারীর ওপর অন্যায়-জুলুম বন্ধের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে আইনগতভাবে সে নিপীড়ন বন্ধের চেষ্টাও গোঁড়া সমাজপতিদের বাধায় সফল করতে খুবই বেগ পেতে হয়। সমাজের আনাচকানাচে, আড়ালে-আবডালে আইনের চোখ এড়িয়ে তা চালু রাখার এক অনমনীয় চেষ্টায় মেতে থাকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মোড়লরা। প্রমথনাথ বিশীর 'কেরী সাহেবের মুন্সী' কিংবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'মনের মানুষ' উপন্যাসে সেই পশ্চাৎপদ সমাজের চিত্র খানিকটা তুলে ধরা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র প্রমুখের সাহিত্যে নারীর অসহায়ত্ব তুলে ধরার গভীর শিল্পসমৃদ্ধ প্রয়াস অক্ষয় হয়ে রয়েছে। সেসবের চলচ্চিত্রায়ণ সমাজকে আলোকিত করেছে। তার পরও এই একবিংশ শতাব্দীতেও কখনোসখনো ভারতের মধ্যপ্রদেশ কিংবা অন্য কোনো রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নারীদের ওপর বর্বর-নৃশংস সামাজিক নিপীড়ন, বিশেষ করে সতীদাহ প্রথা চাপিয়ে রাখার খবর বেরিয়ে পড়ে পত্রপত্রিকায়। মুসলিম সমাজে বাহ্যত ওই ধরনের বর্বর প্রথা অনুসৃত না হলেও অন্দরমহলে, হেরেমে, প্রধানত যৌতুকের দাবিতে মেয়েদের মানসিক ও শারীরিক নিগ্রহ-নির্যাতনের ধারা শত বছর ধরে, কার্যত আজও বহু ক্ষেত্রেই বহাল রয়েছে। বেগম রোকেয়া থেকে শুরু করে নারীমুক্তির দূতরা যুগে যুগে শিক্ষাবিস্তার ও সমাজসংস্কারের বিভিন্নমুখী প্রয়াসের মাধ্যমে নারীকে নির্যাতনের শিকার থেকে মুক্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করে এসেছেন। আজকের অনেক বেশি শিক্ষার আলোকপ্রাপ্ত সমাজেও নারীমুক্তির সংগ্রামে আত্মনিবেদিত ও প্রগতিশীল নারী নেত্রীরা সে প্রচেষ্টাকে অব্যাহত রাখতে এবং জোরদার করতে চেষ্টা করছেন। রাষ্ট্র নারী উন্নয়ন নীতি প্রণয়ন করেছে। নারীমুক্তি আন্দোলনের ফলেই উচ্চ আদালতের এক রায়ে ফতোয়াবাজি নিষিদ্ধ হয়েছে। রাজনীতি, অর্থনীতি_সব ক্ষেত্রেই নারীর ক্ষমতায়নের প্রসার ঘটেছে; তার পরও তাঁদের প্রচেষ্টা প্রধানত শহরের ও মফস্বলের মধ্যেই সীমিত থেকে যাচ্ছে। সুদূর অন্ধকারে পড়ে থাকা হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার কিংবা মাদারীপুরের পশ্চাৎপদ গ্রামের ফেরদৌসী বেগম, রুমা বেগম, শিরীন আখতারকে আত্মহনন থেকে তা রক্ষা করতে পারছে না। গ্রাম্য সালিস বিষফোড়ার মতোই সমাজকে বিষিয়ে তুলছে। সেই সঙ্গে শহরে-গ্রামে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে আজও সামন্ত মূল্যবোধ ও তার নগ্ন বহিঃপ্রকাশ, উগ্র ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদী ও তালেবানি অপশক্তির ও জঙ্গিবাদী হুমকির দাপট পরিদৃৃষ্ট হচ্ছে। আলোর অভিযাত্রা রুখতে অন্ধকারের শক্তি মরিয়া হয়ে উঠেছে।
সে যুগে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, ডিরোজিও, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল ও তাঁদের উত্তরসূরিরা বাংলার সমাজকে পশ্চাৎপদতা থেকে, বিশেষ করে নারীদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একপেশে বিধিবিধান, অপমান, অবহেলা, বঞ্চনা থেকে মুক্ত করার সংগ্রাম করে গেছেন তাঁদের সমাজসংস্কার, সমাজচিন্তা, সাহিত্য-সংস্কৃতির ফসল-সম্ভার দিয়ে। অন্যদিকে সমাজকে বিজ্ঞানমনস্ক, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন করার জন্যও যুগে যুগে প্রফুল্লচন্দ্র, সত্যেন বোস, মেঘনাদ সাহা, জগদীশচন্দ্র বসু প্রমুখ মনীষী তাঁদের চিন্তাচেতনা দিয়ে মানুষের ভেতর মনুষ্যত্ববোধ, কল্যাণচিন্তা, সভ্যতাকে এগিয়ে নেওয়ার আদর্শ জাগ্রত করার নিরলস প্রচেষ্টাই চালিয়ে এসেছেন। এসব দীর্ঘ সামাজিক প্রক্রিয়ায় সমাজটা ব্যাপকভাবে গণতান্ত্রিক, সভ্য ও উন্নত হয়েছে ঠিকই, তার পরও একবিংশ শতাব্দীর যাত্রাপথে কী অকল্পনীয় কলঙ্কের কালিমাই না লেপন করে দিচ্ছে উলি্লখিত সব নারীর আত্মহননের ঘটনাগুলো! শহরে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের একাংশের মধ্যে এসিড নিক্ষেপ, নারীর চোখ উপড়ে ফেলার চেষ্টা, নারীকে শিশুসন্তানসহ আত্মহত্যায় প্ররোচিত করা, ইভ টিজিংয়ের মাধ্যমে অসংখ্য নারীকে আত্মহত্যায় বাধ্য করার সহিংস ও নৃশংস ঘটনা ঘটে যাচ্ছে।
এসব ঘটনাই বলে দিচ্ছে, সমাজে আলোক বিস্তারের শক্তি আজও এমন পর্যাপ্ত হয়ে উঠতে পারেনি যে তা শহর ও গ্রামের ওই সব নারীর অপমান-লাঞ্ছনা ও আত্মহনন রুখতে পারে।
দীর্ঘ গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মধ্য দিয়েই রাষ্ট্রক্ষমতায় আজ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সমাসীন রয়েছে। গণতান্ত্রিক শক্তির এই রাজনৈতিক উত্তরণকে যেমন খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই, তেমনি এর ঐতিহাসিক ভূমিকাকে আজ আরো সর্বব্যাপী ও আরো অভ্রভেদী ও অজেয় করার দাবিই নিয়ে এসেছে আমাদের গ্রামসমাজের অসহায়-অপমানিত নারীদের আত্মহননের উলি্লখিত মর্মান্তিক ঘটনাগুলো! সমাজের এসব নেতিবাচক চিত্র ও বাস্তবতা সম্পূর্ণ পাল্টে দিতে এবং উজ্জ্বল, ইতিবাচক বাস্তবতার চিত্রকে উজ্জ্বলতর করতে প্রখর রাজনৈতিক সচেতনতা ও সংকল্প নিয়ে নারী-পুরুষের মিলিত গণতান্ত্রিক সংগ্রাম আরো জোরদার করার বিকল্প নেই।
২২.০৮.২০১১

No comments

Powered by Blogger.