ভাগ্য বুঝি সড়কপথেই আমাদের অনিবার্য মৃত্যু লিখে রেখেছে by হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ

না, বাড়ির বাইরে রাস্তা বা সড়কে এখন আর কেউ মোটেও নিরাপদ নন। প্রিয় স্বজন, আপনি, আমি বা অন্য কেউ_কেউই নন। ঘর ছেড়ে রাস্তায় বেরোলেই যে কারোরই অনিবার্য সড়ক দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয়ে মৃত্যু হতে পারে। আপনার জন্য আপনার পরিবার, বন্ধু, সন্তান-সন্ততির জন্য দেশের সড়কপথগুলো এভাবেই উন্মুক্ত এবং নিরাপদহীন করে রাখা হয়েছে। আপনি যেদিক দিয়ে যাবেন, সড়ক-ঘাতক যেন সেদিক দিয়েই আপনার মৃত্যু নিশ্চিত করতে পারে।


এ সড়ক-ঘাতক এখন এতটাই হিংস্র, শক্তিশালী যে দেশের প্রচলিত আইন-কানুন সে তোয়াক্কা করে না। একই সঙ্গে পুলিশ আর মন্ত্রীদের স্বার্থরক্ষার বক্তব্য তাকে আরো উস্কে দেয় সড়কপথের হত্যাকাণ্ডগুলো সম্পন্ন করতে।
দেশের সড়কপথগুলো সত্যিই এখন ঘাতকের থাবায় আক্রান্ত। সড়কপথগুলো যে এখন কতটা ভয়াবহ, নিরাপদহীন তার নির্মম-নিষ্ঠুর উদাহরণ ফের আমরা দেখতে পেলাম ১৩ আগস্ট। দেশের অন্যতম দুই সৃজনশীল মানুষ, অনন্য প্রতিভা সাংবাদিক মিশুক মুনীর এবং চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ এদিন মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকায় ফেরার পথে জোকা নামক স্থানে এক সড়ক দুর্ঘটনায় নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ (হত্যাকাণ্ডই বলা শ্রেয়) করেন। তাঁদের আরো তিন সঙ্গীও একই সঙ্গে মারা যান। আহত হন তারেক মাসুদের স্ত্রী জন্মসূত্রে আমেরিকান ক্যাথরিন মাসুদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষক ঢালী আল মামুন, তাঁর স্ত্রী দিলারা বেগম জলিসহ আরো কয়েকজন।
শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর ছেলে মিশুক মুনীর বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রধান সম্পাদক ছিলেন। প্রামাণ্যচিত্র মুক্তির গান, বিকল্প ধারার ছবি 'মাটির ময়না' বানিয়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তারেক মাসুদ। দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তারেক মাসুদ বানাতে চেয়েছিলেন আরেকটি নতুন ছবি 'কাগজের ফুল'। কিন্তু বড় দুর্ভাগ্য আমাদের, পথের মাঝেই হারালাম শিল্প এবং সাংবাদিকতার এই দুই পথপ্রদর্শককে। স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল প্রতিভাবান এই দুই সৃষ্টিশীল মানুষের অকাল এবং অপ্রত্যাশিত মৃত্যুতে যারপরনাই আমরা গভীরভাবে শোকাভিভূত। সর্বশেষ এই দুজন এবং তিন সহযোগীর করুণ মৃত্যু আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেল, কোন এক মৃত্যকূপের মাঝে আমরা বসবাস করছি। রাস্তায়, সড়কে মানুষের প্রাণ কতটা নিরাপত্তাহীন।
তারেক মাসুদ, মিশুক স্যার যে মহাসড়কে মারা গেছেন সেই সড়কে দুর্ঘটনা নতুন নয়, নিত্যই বটে। প্রায় প্রতিদিনই রাস্তায় মানুষ গাড়িচাপায় মারা যায়। সাধারণ হওয়ায় হয়তো সেই মানুষগুলো সংবাদ শিরোনাম হয় না। মনে আছে, গত বছরের ৩১ জুলাই সচিব রাজিয়া বেগম এবং অতিরিক্ত সচিব ও বিসিকের চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমানের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটেছিল এই সড়কেই। সে সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গোপালগঞ্জে যাবেন বলে তারই অংশ হিসেবে সচিব রাজিয়া এবং অতিরিক্ত সচিব সিদ্দিকুর রহমান অফিসের একটি পাজেরোতে চড়ে খুব ভোরে গোপালগঞ্জের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন। কিন্তু সকাল পৌনে ৮টার দিকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের শিবালয় থানার পাটুরিয়া মোড়ে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি পরিবহনের গাড়ি পাজেরোটিতে আঘাত হানলে সচিব রাজিয়া এবং অতিরিক্ত সচিব সিদ্দিকুর রহমানের তাৎক্ষণিক মৃত্যু ঘটে। অসংখ্যবার এই সড়কে চলাচলকারী পরিবহনের নিচে পিষ্ট হয়েছে প্রাইভেট কারের যাত্রী, পথচারী। বড় বড় পরিবহনও কারণে-অকারণে অসংখ্যবার রাস্তায় আছড়ে পড়ে অসংখ্য তাজা প্রাণের স্পন্দন সারা জীবনের জন্য নিস্তব্ধ করে দিয়েছে। মনে আছে বেশ কয়েক বছর আগে ফ্লাইট ক্যাপ্টেন আবুল কাশেম এবং তাঁর ছেলে ও বউমা একই সঙ্গে মারা যান। এক দানব ট্রাক আবুল কাশেমের প্রাইভেট কারকে ধাকা দিলে এই দুর্ঘটনা ঘটে। এর আগে এরশাদ জমানায় এই সড়কে প্রাইভেট কারে চড়ে যাওয়ার সময় একটি দানব ট্রাক ধাক্কা দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্রী তাজিনের মৃত্যু ঘটিয়েছিল। সে সময় মেধাবী ছাত্রী তাজিনের মৃত্যু নিয়েও দেশজুড়ে হৈচৈ কম ছিল না।
দেশজুড়ে এ রকম আরো অনেক উদাহরণ আছে। শত শত আমজনতার সঙ্গে মেধাবী, প্রতিভাবান, সৃজনশীল, বরেণ্য অনেক মানুষকেই আমরা পথের মাঝেই হারিয়েছি। মনে আছে, ২০০০ সালের ১০ নভেম্বর ঢাকা থেকে পাবনায় বাড়ি ফেরার পথে যমুনা ব্রিজের কাছাকাছি জায়গায় শ্যামলী পরিবহন দুর্ঘটনায় পতিত হলে সেদিন বিএনপির সংসদ সদস্য, পাবনার সর্বস্তরের জনপ্রিয় সাহসী নেতা রফিকুল ইসলাম বকুল এমপির নির্মম মৃত্যু ঘটে। নিজস্ব গাড়ি না থাকায় এই লড়াকু সংসদ সদস্য পাবলিক পরিবহনে চড়ে বাড়ি যাচ্ছিলেন। বছর তিনেক আগে খুলনার চুকনগরে দেশের প্রতিভাবান ক্রিকেটার মানজারুল ইসলাম রানার মৃত্যু এখনো আমাদের কাঁদায়। অনেকেরই নিশ্চয় মনে আছে, গত বছরের শুরুতে থাইল্যান্ডের রাজকন্যা উত্তরবঙ্গের গাইবান্ধা জেলার চর এলাকা পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। পরিদর্শন শেষে রাজকন্যা ১৮ ফেব্রুয়ারি গাইবান্ধা থেকে গাড়িবহর নিয়ে ঢাকায় ফিরছিলেন। কিন্তু টাঙ্গাইল সীমানায় রাজকন্যার গাড়িবহরের একটি গাড়িকে রডবোঝাই একটি ট্রাক ধাকা দিলে থাই দূতাবাসের কাউন্সিলর মিস পানি্ন নিহত হন। সেদিন সুখের সফরে থাই রাজকন্যা মাহা সিরোন্দাম সঙ্গে নিয়ে যান দুঃখের এক দুর্বিষহ স্মৃতি। কিছুদিন আগে ভুয়া চালকের বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে চলি্লশের অধিক খুদে শিক্ষার্থীর যে করুণ মৃত্যু হলো, তার জবাব কেউ দিতে পারেনি। আবার ২৮ জুলাই বেপরোয়া ট্রাকচালকের কারণে বগুড়ার শাহজাহানপুরে ১৮ জন সাধারণ মানুষের মৃত্যু, রাস্তায় তাদের ছিন্নভিন্ন দেহ পড়ে থাকা আমাদের বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ না করে পারেনি।
কিন্তু এত সবের পরও আমরা কী করছি। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে, সড়কে মানুষের নিরাপত্তায় রাষ্ট্রযন্ত্র আসলে কী সচেতন? পাশ্চাত্যের উন্নত দেশ নয়, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে হাজার হাজার কিলোমিটার সড়কপথ। এক প্রদেশ থেকে আরেক প্রদেশে যেতে গেলে কয়েক হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। অথচ তুলনামূলক সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের চেয়ে সেখানে অনেক কম। এর প্রধানতম কারণ, ভারতের প্রায় সব মহাসড়কেই ডিভাইডার রয়েছে। ফলে যানবাহনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। দ্বিতীয়ত ভারতের যেকোনো মহাসড়কেই আমাদের তুলনায় গাড়ির সংখ্যা অনেক কম। কিন্তু আমাদের মহাসড়কের দিকে তাকালে গাড়ি ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। আমরা অনেক দিন ধরেই শুনছি, ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের মহাসড়কগুলো চার লেন করা হবে, কিন্তু বাস্তবে এসব বক্তব্যের প্রতিফলন এখনো দৃশ্যমান হয়নি। একবাক্যে বলতে পারি, মহাসড়কগুলোকে আরো উন্নত করে ডিভাইডার দিতেই হবে।
গত বছর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ছাত্র ফুটফুটে শিশু হামিমের মৃত্যুর পর ১৪ ফেব্রুয়ারি সংসদ সদস্য অভিনেত্রী তারানা হালিম সংসদে একটি নোটিশ করেছিলেন। নোটিশে তিনি বলেছিলেন, প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে। নিহত স্বজনরা বুক চাপড়ে মরলেও ঘাতক চালকরা আইনের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে যায়। একজন ঘাতক জামিনযোগ্য আইনের ধারায় বের হয়ে যাওয়াকে আদালত কোনোভাবেই ঠেকাতে পারছে না। তাই আইনের সংশোধনী প্রয়োজন। নোটিশে দুর্ঘটনায় মৃত্যু ঘটলে শাস্তির বিধান ৩০৪(খ) সংশোধন করে অজামিনযোগ্য করার সুপারিশ করা হয়। একই সঙ্গে শাস্তির মাত্রা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড করারও সুপারিশ করা হয়। সংসদে এ সময় আইনমন্ত্রী উত্তরে বলেছিলেন, সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ চালকদের অসাবধানতা। এ ব্যাপারে তিনি দ্রুতই উদ্যোগ নেবেন।
দেশে যে হারে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে, তাতে করে মনে হচ্ছে সড়ক-মহাসড়কগুলো নিরাপদ করার বদলে মন্ত্রীদের এখন প্রিয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে কেবলই শোকবার্তা পাঠিয়ে দায়িত্ব শেষ করা। সবশেষে বলব, সুপ্রিয় তারেক মাসুদ এবং মিশুক স্যারের অকালমৃত্যুর পর মহাসড়কগুলোর নিরাপত্তা, উন্নয়ন এবং চালকদের সব ধরনের নৈরাজ্য বন্ধে আমরা কোনো মশকারা বা লোকদেখানো কর্মকাণ্ড দেখতে চাই না।
লেখক : চেয়ারম্যান, ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি
kirondebate@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.