সিলেটের মণিপুরি হস্তশিল্পের সমস্যা ও সম্ভাবনা by ড. নিয়াজ আহম্মেদ

সিলেটে হস্তশিল্পের এক উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে মণিপুরি হস্তশিল্প। মণিপুরিদের নিজেদের হাতে তৈরি বিভিন্ন ধরনের পোশাক বাংলাদেশের সর্বত্র সমাদৃত। তাদের তৈরি পোশাকের যেমন রয়েছে নান্দনিক সৌন্দর্য, তেমনি এ পোশাকের দামও তুলনামূলক কম। আবার পোশাকগুলো আরামদায়কও বটে।


সিলেটের লামাবাজার, মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জসহ বিভিন্ন জায়গায় মণিপুরিরা তাদের পোশাক তৈরি করে। মূলত মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় মণিপুরিদের ব্যাপক বসবাস। এ প্রেক্ষাপটে মৌলভীবাজারকে কেন্দ্র করেই মণিপুরি হস্তশিল্পের বিকাশ ঘটে। মণিপুরি সম্প্রদায়ের ছোট-বড় সবাই কমবেশি এ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। বছরের পর বছর ধরে মণিপুরিদের হস্তশিল্প আমাদের সংস্কৃতি ও কৃষ্টির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। পাশাপাশি এ শিল্প আমাদের সাধারণ শিল্পের পরিপূরক হিসেবেও কাজ করছে। শুধু তা-ই নয়, মণিপুরিদের তৈরি পণ্য রপ্তানি করে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথও সুগম হচ্ছে। জাতীয় আয়ের ক্ষেত্রে তাদের অবদানও চোখে পড়ার মতো। কিন্তু এ রকম ইতিবাচক দিক থাকা সত্ত্বেও মণিপুরি হস্তশিল্প বিভিন্নভাবে সমস্যাগ্রস্ত। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের আশু পদক্ষেপ জরুরি। একটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে মণিপুরিরা আর্থিকভাবে তেমন সচ্ছল নয়। জীবিকা অর্জনের বিকল্প পথ অবলম্বনের সুযোগও সীমিত। নিজস্ব শিক্ষা, সংস্কৃতি ও কৃষ্টির বাইরে বের হতে পারলে আধুনিক জীবন ধারণ করা সহজ। মণিপুরিদের মধ্যে অনেকে মূলধারার শিক্ষা গ্রহণ করে সরকারি ও বেসরকারি চাকরিতে প্রবেশ করছে। কিন্তু বিরাট এক গোষ্ঠী তাদের পূর্বপুরুষের পেশা হস্তশিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে। হতে পারে এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে তাদের এ চেষ্টা। আর্থিক দিক থেকে সচ্ছল না হওয়ায় তাদের মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে দাদন নিয়ে শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হচ্ছে। যার জন্য পণ্যের তৈরিমূল্য বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে অনুপাতে পণ্যের মূল্য না বাড়ায় প্রকৃত পোশাক প্রস্তুতকারী ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। মহাজনদের দাদনের পাশাপাশি এ শিল্পে প্রবেশ করছে ক্ষুদ্র ঋণ। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা বেসরকারি সংস্থাগুলো মণিপুরিদের মধ্যে প্রবেশ করেছে। এখানেও তাদের চড়া সুদে ঋণ নিতে হচ্ছে। তারপর রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি ঋণদানে অনীহা। মণিপুরিদের কিস্তি শোধ করতে করতেই দম ফুরোয় না। বাধ্য হয়ে অন্যদের মতো মণিপুরিদেরও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণ করতে হয়। একটি পর্যায়ে এসে তারা ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে শর্ত জুড়ে দেওয়া হয় যে যাদের কাছ থেকে ঋণ নেবে তাদের কাছে পণ্য বিক্রি করতে হবে। এতে পণ্যের দামও কম দেওয়া হয়। একদিকে চড়া সুদ, অন্যদিকে তাদের কাছেই পণ্য বিক্রি_মণিপুরিদের বঞ্চনার এ এক বিস্ময়কর দিক। আরো মজার ব্যাপার হলো, মণিপুরিরা তাদের তৈরি পোশাক সরাসরি বিক্রি করতে পারে না। এখানে রয়েছে মধ্যস্বত্বভোগী বা ফড়িয়া। তাদের কাছ থেকে পণ্য বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলে যায়।
মণিপুরিদের হস্তশিল্পে ক্ষুদ্রঋণের প্রভাব অনেক মণিপুরিই ভালো চোখে দেখছে না। কেননা এর দ্বারা তারা লাভবান হচ্ছে না। তাদের কষ্ট আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। তারা চায় তাদের শিল্পের পরিপূর্ণ বিকাশ এবং এর জন্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা। সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এ শিল্পের যেমন বিকাশ ঘটানো সম্ভব, তেমনি পণ্যের গুণগত মান বৃদ্ধির মাধ্যমে অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সহায়তা করা জরুরি। প্রথমত, রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোকে কম সুদে মণিপুরি শিল্পের বিকাশের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। ঋণদানের ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনকানুন মণিপুরিদের জন্য শিথিলও করা যেতে পারে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অংশ হিসেবে ঋণদান পদ্ধতি সহজীকরণ মণিপুরিদের শিল্প বিকাশে সহজতর হবে। মণিপুরিদের উৎপাদিত পণ্যের সবার কাছে কমবেশি কদর আছে। আমরা শুধু এর সংরক্ষণই চাইব না, চাইব এর দ্রুত বিকাশ। আর এর জন্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি প্রয়োজন সবার সচেতনতা এবং আন্তরিক প্রচেষ্টা।

লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট
neayahmed_2002@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.