ভারত-কংগ্রেস-মমতার রাজনৈতিক দ্বৈরথ by এম জে আকবর

কংগ্রেসের বিশিষ্ট নেতারা মমতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার ব্যাপারে এখনি মুখ না খুললেও রাজ্য ইউনিটকে যে আক্রমণ শানানোর মৌখিক অনুমতি দেওয়া হয়েছে সেটা তো বোঝাই যায়। এভাবে দিলি্লর বিষেই জারিত হবে মমতার সঙ্গে কংগ্রেসের সম্পর্কটি। উভয় দিক থেকেই বার্তা যাচ্ছে। তবে সেটা এখনও 'অব দ্য রেকর্ড', 'অন দ্য রেকর্ড' নয়। আরও বারো কি ষোলো সপ্তাহ অপেক্ষা করে দেখা যাক একজন রাজনীতিবিদের 'অব দ্য রেকর্ড' এবং 'অন দ্য রেকর্ড'


কথাবার্তার মধ্যে প্রধান পার্থক্য হলো আগেরটা সম্ভবত সত্যের অনেক কাছাকাছি থাকে। তবে অব দ্য রেকর্ড মানে আলোচনার বাইরের কোনো বিষয় নয়। তা সত্ত্বেও নিজের মধ্যে কিছু রেখে দিতে চাইলে সে বিষয়ে মৌনতা অবলম্বনই শ্রেয়। আবার কোনো আরোপণ ছাড়াই যখন কোনো রাজনীতিবিদ কথা বলবেন বলে ঠিক করেন, তখন বুঝতে হবে যে, তার কথার মধ্যেই একটা অস্বীকৃতি জানানোর ক্লজ আছে। অব দ্য রেকর্ডটা হতাশা ও ক্ষুব্ধতা প্রকাশের উপায়ও।
একজন সিনিয়র কংগ্রেস রাজনীতিবিদ ২০১২ সালের জন্য অসাধারণ প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। তিনি নতুন বছরে নির্বাচন হলে বিজেপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী এনডিএ জোট ক্ষমতায় আসুক চান। তখন তারা হাড়ে হাড়ে টের পাবেন মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে থাকাটার জ্বালা। তার ধারণা মমতা ব্যানার্জির সমর্থন ছাড়া কেউই দিলি্লতে ক্ষমতায় বসতে পারবে না। তার এহেন বক্তব্যের যথার্থতা এই মুহূর্তে অস্বীকার করার উপায় নেই। মমতার সমর্থন নিয়ে দিলি্লর মসনদে বসে সরকার চালানোর চেয়ে বেশি ক্লেশকর আর কিছু হতে পারে না বলেই তার ধারণা।
মমতাকে অনমনীয়তার বাহবা দিতে হয়। মাত্র ১৯ জন এমপি নিয়ে তিনি এক বছরে অন্তত চারবার ২০৬ এমপির শক্তিশালী কংগ্রেসকে বিভিন্ন ইস্যুতে পরাস্ত করেছেন। প্রত্যেকবারই বিষয়গুলো ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মনমোহন সিংকে বাংলাদেশ সফর করতে বাধ্য করেছেন তিস্তার পানি বণ্টনের ব্যাপারে কোনো সমঝোতা ছাড়াই। খুচরা ব্যবসায় সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ ও পেনশনের ব্যাপারে বাধা প্রদান করে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে শিক্ষা দিয়ে ছেড়েছেন। লোকপাল বিলের ক্ষেত্রেও তিনি একই আচরণ করেছেন। এ নিয়ে ভোটাভুটির সময় তিনি ইউপিএর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তিনি এ ক্ষেত্রে একটি মৌলিক নীতি অনুসরণ করেছেন। এ ক্ষেত্রে তার কৌশল হলো, কংগ্রেস তার মিত্রদের সঙ্গে যে ধরনের আচরণ করে থাকে একই আচরণ তাকে ফিরিয়ে দিতে হবে। কংগ্রেস কখনোই মনে করে না যে, জোট মানেই হলো পারস্পরিক সহযোগিতামূলক একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা। এ ক্ষেত্রে কংগ্রেস 'ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা পদ্ধতি' অনুসরণ করে থাকে। এই পদ্ধতির সার কথা হলো_ হয় আমার পথে চল, না হয় সদর দরজা দেখ। আকস্মিকভাবে মমতা তার সিনিয়র পার্টনার কংগ্রেসকে বলা শুরু করেছেন, ক্ষমতায় থাকতে হলে তার শর্ত মানতে হবে। মমতা আসলে কংগ্রেসের সংস্কৃতি ভালো করেই জানেন। কারণ, এক সময় তিনিও ওই দল করতেন কিনা!
মমতা ব্যানার্জি হয়তো কখনও কখনও ভুল করে বসেন, তবে তিনি দুর্দৈবে বিশ্বাস করেন না। তার পদক্ষেপগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তার অপশন উন্মুক্ত_ এটাই তার ২০১২ সালের নতুন বছরের বার্তা। মমতা সহজে বশ মানার লোকও নন। কারণ তামিলনাড়ূর ডিএমকে দলের মতো তার দলের বা তার নিজের
বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নেই। কোনো কিছু প্রকাশ হয়ে পড়লে অনর্থ ঘটতে পারে এমন ভয়ও তার নেই। কারণ, সিবিআইর কাছ থেকে লুকানোর মতো তার
কোনো বড় ধরনের দুর্নীতি নেই। সে জন্য দিলি্লর ব্ল্যাকমেইলিংয়ের পরোয়া তার নেই। নম্রতা, ধৈর্য এসব তার চরিত্রের সঙ্গে খাপ খায় না। এই বিশেষ জিনটি তার
মধ্যে নেই।
কংগ্রেস মনে করত, সঙ্গীরা তাকে ছেড়ে যেতে পারবে না। এমনকি দু'একটি বিক্ষুব্ধতার ঘটনা থাকলেও তাতে অবস্থার ইতরবিশেষ হবে না। কিন্তু আকস্মিকভাবে কংগ্রেস আবিষ্কার করল যে, সবকিছু তার পছন্দানুসারে চলছে না। তাদের অবস্থা হয়েছে, অনেকটা আপন ঘর লণ্ঠনের আগুনে পুড়ে অঙ্গার হতে দেখার মতো। এই আগুন ধীরে ধীরে ছড়ায়। এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত পুড়তে থাকে। কংগ্রেস রাজনীতি তাই ২০১২ সালের প্রথমার্ধ পর্যন্ত মাত্র একটি লক্ষ্যেই ঘুরপাক খাবে। সেটি হচ্ছে, মমতা ব্যানার্জির এই ১৯ এমপির বিকল্প খুঁজে পাওয়া। তাই বলে তাদের মমতার সঙ্গ ছাড়ার আবশ্যকতা নেই। তারা শুধু মমতাকে অপ্রাসঙ্গিক করে তুলতে চায়। তারা মৌমাছির বিষাক্ত হুল ছাড়াই মধু চায়। এ কারণেই মোলায়েম সিং যাদবের এতটা গুরুত্ব কংগ্রেসের কাছে। ভবিষ্যৎ আদর্শ দৃশ্যপট হতে পারে : মোলায়েম সিং যাদবের নেতৃত্বাধীন সমাজবাদী পার্টি যদি আসন্ন উত্তর প্রদেশ রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনে একক বৃহত্তম দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং রাজ্যে সরকার গঠনের জন্য যদি তাকে কংগ্রেস বিধায়কদের সমর্থনের ওপর নির্ভর করতে হয়, তখন উত্তর প্রদেশে সরকার টিকিয়ে রাখার জন্য মোলায়েম সিংকে কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকারকে সমর্থন দিয়ে যেতে হবে। সে ক্ষেত্রে রাহুল নতুন প্রধানমন্ত্রী হলে তার পক্ষে আগামী দুই বছর অর্থাৎ ২০১৪ সালের আগামী লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত কেন্দ্রে সরকার টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে।
কংগ্রেসের বিশিষ্ট নেতারা মমতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার ব্যাপারে এখনি মুখ না খুললেও রাজ্য ইউনিটকে যে আক্রমণ শানানোর মৌখিক অনুমতি দেওয়া হয়েছে সেটা তো বোঝাই যায়। এভাবে দিলি্লর বিষেই জারিত হবে মমতার সঙ্গে কংগ্রেসের সম্পর্কটি। উভয় দিক থেকেই বার্তা যাচ্ছে। তবে সেটা এখনও 'অব দ্য রেকর্ড', 'অন দ্য রেকর্ড' নয়। আরও বারো কি ষোলো সপ্তাহ অপেক্ষা করে দেখা যাক।

এম জে আকবর :দিলি্ল থেকে প্রকাশিত দি সানডে গার্ডিয়ানের সম্পাদক
খালিজ টাইমস থেকে ভাষান্তর সুভাষ সাহা

No comments

Powered by Blogger.