একে একে নিভে যাচ্ছে বাতি? by বিনায়ক সেন

র্থশাস্ত্র যদি বিষণ্ন বিষয় হয়ে থাকে তবে বাংলাদেশ নিশ্চয়ই সেই অর্থশাস্ত্রের সবচেয়ে বিষণ্ন অধ্যায়। ১৯৭৫ সালে দুই কীর্তিমান বিদেশি অর্থনীতিবিদ লিখেছিলেন, 'বাংলাদেশের উন্নয়ন করা গেলে উন্নয়নের কম-দুরূহ সমস্যাকেও সমাধান করা সম্ভব। এই অর্থে বাংলাদেশকে উন্নয়নের পরীক্ষা ক্ষেত্র বলা যেতে পারে।' স্বাধীনতার চলি্লশ বছরেও দেশটিকে নিয়ে হতাশাবাদের ধ্বনি বন্ধ হলো না। আমরা যদি শিখরের দ্বারপ্রান্তেও এসে কখনও পেঁৗছাই তাহলেও আমাদের দুর্গম


অভিযান যাঁরা নিরাপদ দূরত্বে থেকে দেখছেন তারা বলবেন, 'এই তো, যাক না আরও একটু ওপরে তারপরেই দেখবে ওটা কীভাবে গড়িয়ে গড়িয়ে খাদে পড়ে যায় নির্ঘাত'! আর সে হতাশার সুরও ছিল একেক দশকে একেক রকম।
প্রথমে [সত্তর দশকেই] শোনা গেল জনসংখ্যা নিয়ে হতাশাবাদ। আদিতেই ছিল জনসংখ্যার উচ্চ ঘনত্ব, তার ওপর অব্যাহত হারে দ্রুত জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধি_ এ দুইয়ে মিলে সৃষ্টি হয়েছে এক 'ম্যালথাসীয় বিষবৃত্ত', যার থেকে বেরোনোর সম্ভাবনা নেই এ দেশের। তারপর শোনা গেল কৃষি তথা খাদ্য উৎপাদন নিয়ে হতাশাবাদ। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ সেই হতাশাবাদের গুঞ্জন আরও উস্কে দিয়ে থাকবে সন্দেহ নেই। আশির দশকের শেষ পর্যন্ত রাজত্ব করা এই কৃষি-হতাশাবাদের মোদ্দা কথা ছিল_ এ দেশের কৃষিতে উৎপাদন-সম্পর্ক এতটাই শোষণমূলক [আধা-সামন্তবাদী, আধা-পুঁজিবাদী] যে, এখানে গরিব কৃষকদের পক্ষে উচ্চ ফলনশীল আধুনিক ধান বীজ ফলানোর সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আর ধনী কৃষকদের আগ্রহ যেহেতু কৃষির চেয়ে অকৃষির দিকে [অধিকন্তু সামন্তবাদী জোতদারদের মতো সুলভে উদ্বৃত্ত আহরণের প্রতি], সুতরাং কৃষির আধুনিকায়নের সম্ভাবনাও এখানে সুদূরপরাহত। 'শৃঙ্খলে বাঁধা এ দেশের কৃষি'_ এ রকম বললেন কেউ; অন্য একজন লিখলেন, ঔপনিবেশিক কাঠামোয় 'অচলাবস্থাই' এ দেশের কৃষির নিয়তি। আরও কেউ কেউ পূর্বাভাস দিলেন আশু অনিবার্য দুর্ভিক্ষের। রফতানিমুখী উন্নয়ন নিয়েও হতাশা ব্যক্ত হলো আশির দশকে। তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, কোরিয়া [বা পরবর্তী যুগের চীন, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড] এসব পূর্ব এশীয় দেশকে অনুসরণ করে এই দুর্ভাগা ভূখণ্ড কখনোই রফতানিমুখী উন্নয়নের ছকে সাফল্য পাবে না_ এই ছিল মত। এবং এই নৈরাশ্যের মূলে ছিল বাংলাদেশে লুটেরা ধনিক শ্রেণীর আধিপত্য এবং উৎপাদনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন উদ্যোক্তাদের অভাব। আর শেষোক্তরা না থাকলে প্রাথমিক পণ্য [কৃষিজ পণ্য] রফতানিকারক দেশ থেকে শিল্পপণ্য রফতানিকারকের তালিকায় নাম লেখানো শক্ত। হতাশাবাদ গড়ে উঠেছিল নারীর ক্ষমতায়ন নিয়েও। বাইরের পর্যবেক্ষকদের চোখে আমাদের নারীরা ইতিহাসের অন্ধকূপে নিক্ষিপ্ত যেন; পর্দার আড়ালেই তাদের জীবনযাপন। ফলে তাদের পক্ষে উৎপাদনমুখী খাতে অংশ নেওয়া প্রায় অসম্ভব মনে করা হতো সত্তরের দশকে। নারী শিক্ষার বিষয়ে সাফল্য কখনও আসবে_ এমনকি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুলে মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে সমান তালে অংশ নেবে_ এটিও ছিল তাদের চিন্তার বাইরে। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে দড়ি বানানো বা চিড়া-মুড়ি বানানো ছাড়া গ্রামবাংলার নারীদের পক্ষে আর কী করা সম্ভব_ এ কথা নব্বইয়ের দশকেও শোনা গেছে! নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে নৈরাশ্য জনসংখ্যা নিয়ে নৈরাশ্যের যুক্তিকে আরও সবল করেছিল, যেমন প্রশ্নকীর্ণ করেছিল শিল্পপণ্য রফতানিতে এ দেশের সম্ভাবনাকেও।
গত দুই দশকের বাস্তব তথ্য পরিসংখ্যান অবশ্য জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধি, কৃষি উৎপাদন, রফতানিমুখী উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে হতাশার রায়কে ইতিমধ্যেই মিথ্যা প্রমাণিত করেছে। তারপরও হতাশাবাদীরা আশ্বস্ত হতে পারেননি। ২০০০-এর দশক থেকে বিশেষভাবে শোনা যাচ্ছে সুশাসন ও গণতন্ত্র নিয়ে নৈরাশ্য। এবারে তারা অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতে এ দেশের কিছু কিছু চেঁচিয়ে বলার মতো সাফল্য আর আগের মতো অস্বীকার করছেন না। কিন্তু এবারে তাদের যুক্তি ভর্তৃহরির নন্দনতত্ত্বের চেয়েও সূক্ষ্ম : সুশাসনের অভাবের কারণে_ বিশেষত রাজনৈতিক গণতন্ত্রের ভেতরকার পরস্পর বিধ্বংসী অস্থিরতার কারণে এসব অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাফল্যের আসলে কোনো স্থিরতা বা নিশ্চয়তা নেই। এই মতে, যতটুকু সাফল্য অর্জিত বাংলাদেশের এ পর্যন্ত, সেসবই ক্ষণস্থায়ী পরিণতি মাত্র। অচিরেই অস্থিরতা ও নৈরাজ্য গ্রাস করবে এই ভূখণ্ডকে। এদের মধ্যে যারা দীর্ঘমেয়াদি পরিণাম নিয়ে ভাবেন, তারা এই রাজনৈতিক নৈরাজ্যের সঙ্গে যুক্ত করেন পরিবেশগত হুমকিকে। পুরো দেশটা ভাসছে নূহের নৌকায় এবং সেই ভাসমান নৌকার ওপরে থেকেই আমরা ভ্রাতৃদ্রোহী যুদ্ধে লিপ্ত_ এমন একটা দুঃস্বপ্ন দেখাতে চান তারা আমাদের।
২. যে বছর চলে গেল অর্থাৎ ২০১১ খ্রিস্টীয় সালে আরও একটি ক্ষুদ্রমাপের নৈরাশ্য যুক্ত হয়েছে। সেটি হচ্ছে 'সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা' নিয়ে হতাশা। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে; বৈদেশিক সাহায্য সেভাবে আসছে না; বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ কমে যাচ্ছে; টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে; রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি আর সমালে উঠতে পারছে না আমদানি ব্যয়ের চাহিদা; সরকার ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নতুন করে সরবরাহ করেছে ঠিকই; কিন্তু নতুন বিদ্যুৎ প্লান্টগুলো [যেমন কুইক রেন্টাল] চালু রাখতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে বাড়তি তেল আমদানির কারণে। তেলের দামও বিশ্ববাজারে বাড়ন্ত, তাই বর্ধিত হারে ডলার গুনতে হচ্ছে, আবার ভর্তুকি কিছুটা কমাতে গিয়ে বেড়ে যাচ্ছে দেশের ভেতরের মূল্যস্ফীতি; বৈদেশিক অর্থায়নের আকস্মিক হ্রাসের মুখে অভ্যন্তরীণ অর্থায়নের দুটো প্রধান উৎস [যথাক্রমে, কর আহরণ ও অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ধার কর্জ]_ এদের মধ্যে বাধ্য হয়ে অনেক বেশি নির্ভর করতে হচ্ছে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ গ্রহণের ওপর। রাজস্ব ঘাটতি মেটানোর এই পদ্ধতি যেমন আরও উস্কে দেবে মূল্যস্ফীতিকে, তেমনি আগামী বছরগুলোর বাজেটে অভ্যন্তরীণ ঋণ বাবদ সুদাসল মেটানোর ক্ষেত্রেও বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে। ফলে ২০১১-১২ অর্থবছরের এডিপি কাটছাঁট করার দিকে অগ্রসর হতে হবে অচিরেই [যেসব চলক ওপরে বলা হলো এরা পরস্পর সম্পর্কিত]। সেই সঙ্গে বাড়তি দুর্ভাবনার মতো সুপ্ত হয়ে থাকবে শেয়ারবাজারের সংকট-মোকাবেলা ও তাকে চাঙ্গা করে রাখার চ্যালেঞ্জ। মোটাদাগে এই হচ্ছে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে হতাশার মূল সুর। তবে এর বিপরীতে অর্থনীতিতে অন্য প্রবণতাও আছে, যা না বললে বর্তমান সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে যথার্থভাবে বোঝার এবং তা মোকাবেলা করার কাজটা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। গত ডিসেম্বর মাসেরই কোনো একটি দিনে একটি বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিকের শিরোনাম ছিল_ 'দাম নিয়ন্ত্রণ অগ্রাধিকারে ছিল, উদ্যোগ ছিল না'! এর উপ-শিরোনামে বলা হলো কীভাবে বর্তমান সরকারের আমলে মূল্যস্ফীতি ২০০৯ সালের জানুয়ারির ৬ শতাংশ থেকে এখন দাঁড়িয়েছে ১১.৬ শতাংশে। ঠিক একই দিনে, ওই বাংলা দৈনিকের সহযাত্রী ইংরেজি দৈনিকের শিরোনাম ছিল_ 'অর্থনীতিতে এ বছরেও ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হওয়ার সম্ভাবনা'! দুটো শিরোনামের মধ্যেই পুরো সত্য নেই। একদিকে উচ্চ প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা, অন্যদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা_ এই দুটো প্রবণতাই সত্য বর্তমান [২০১১-১২] অর্থবছরের বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য। এবং এই কারণে এটা আরেকটু ব্যাখ্যার দাবি রাখে।
৩. আমাদের স্বীকার করা উচিত যে, আমাদের অর্থনীতি আর আগেকার মতো কৃষিনির্ভর অর্থনীতি নেই। এই অর্থনীতির চাকাকে অনেকটাই এখন বিশ্বমানে তাল রেখে চলতে হচ্ছে। এতকাল আমরা বিশ্বায়নের বাইরে থেকে বিশ্বায়নের স্বপ্ন দেখেছি [সভা-সেমিনার, টক-শো বা আই-ফোনে ইন্টারনেটে এর কথা বলেছি, পড়েছি বা শুনেছি]। এখন আমরা গোলকায়নের কেন্দ্রের ভেতরে : 'সমুদ্র পাড়ি দেওয়া শেষ, এখন প্রকৃত যাত্রার শুরু' জর্জ লুকাচের সেই প্রবচনের মতো। ফলে বিশ্বায়নের সুবাদে বাড়তি প্রবৃদ্ধি অর্জন যেমন আমাদের সাম্প্রতিক বছরগুলোর অভিজ্ঞতা, তেমনি বিশ্বায়নের ঝুঁকিরও আমরা নিত্য মুখোমুখি। সেই ঝুঁকির প্রথম বড় তিক্ত স্বাদ আমরা গ্রহণ করছি এখন_ যার শুরু ২০০৮ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা দিয়ে [যার কবলে হিমশিম খাচ্ছে আমেরিকা ও হাল আমলের ইউরো জোনভুক্ত দেশগুলো কম-বেশি]। এখানে আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হলো, বাড়তি প্রবৃদ্ধি গ্রহণের পাশাপাশি উচ্চ প্রবৃদ্ধির বেদনাকেও স্বীকার করে নেওয়া ও সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত অংশের ওপর সেই বেদনার ভারকে যথাসম্ভব সহনীয় করে তোলা, যতদিন পর্যন্ত বিশ্ব পরিস্থিতি আবারও মন্দা কাটিয়ে না উঠছে।
দ্বিতীয়ত, গত কয়েক বছর ধরে আমাদের অর্থনীতি একই সঙ্গে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও উচ্চ প্রবৃদ্ধির যুগে প্রবেশ করেছে। এটা শুধু আমাদের অর্থনীতি নয়, ভারত ও শ্রীলংকার মতো অর্থনীতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ২০০০-এর দশকের শুরুতে শুধু ২-৩ শতাংশ মূল্যস্ফীতিকে স্বাভাবিক ধরা হতো; দ্বিতীয়ার্ধে তা বেড়ে ৫-৬ শতাংশে দাঁড়ায়। বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা ও মূল্যস্ফীতি একে ১০ শতাংশের ওপরে নিয়ে এসেছে দক্ষিণ এশিয়ার সবদেশেই।
আরব অভ্যুত্থানের পেছনে ছিল কর্মসংস্থানবিহীন প্রবৃদ্ধি, কিন্তু সেইসঙ্গে মূল্যস্ফীতির চাপও সেখানে যুক্ত হয়ে থাকবে। এখন প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশে উচ্চ প্রবৃদ্ধি বজায় রেখে কী করে মূল্যস্ফীতিকে সামাল দেওয়া যায়?
তৃতীয়ত, সনাতনী মনিটারিস্টদের মতে, মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য 'সামগ্রিক চাহিদা'কে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে; বিশেষত সরকারি ব্যয়জনিত সৃষ্ট চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে এই মতের পরিপ্রেক্ষিতে এর সার্বিক প্রয়োজন মেনে নিয়েও আরেকটু সৃষ্টিশীল হয়ে ভাবার সুযোগ রয়েছে। এই সরকারের প্রথম তিন বছরে বেশকিছুটা সম্প্রসারণশীল মুদ্রানীতি নিয়ে চলা হচ্ছিল এবং এর সুফল উচ্চ প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে আমরা ইতিমধ্যেই পেয়েছি। তখন এই নীতি নিয়ে চলা সম্ভব হয়েছিল। তার বড় দুটি কারণ ছিল বৈদেশিক সাহায্যের অব্যাহত প্রবাহ ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরিত বৈদেশিক মুদ্রার বর্ধিত জোগান। এই দুটো ক্ষেত্রেই চলতি অর্থবছরে ভাটা পড়ায় সরকারকে তার অবস্থান কিছুটা বদলাতে হবেই এবং সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে মুদ্রানীতির সঙ্গে রাজস্বনীতির সমন্বয়হীনতা। যেমন_ রাজস্বনীতির ক্ষেত্রে যতটা পারা যায় অপ্রয়োজনীয় ভর্তুকি প্রত্যাহার করে নিতে হবে। কুইক রেন্টালের দ্বারা প্রদত্ত বিদ্যুতের ক্ষেত্রে ভর্তুকি ক্রমান্বয়ে প্রত্যাহার করে নিতে হবে। কেননা, সরকার যে অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে ঋণ নিচ্ছে তার একটি বড় কারণ তেল-বিদ্যুতের ওপর অব্যাহত ভর্তুকি রাখা প্রয়োজনীয়। এই ভর্তুকি প্রত্যাহারের ফলে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি সাম্প্রতিক মাসগুলোয় কিছুটা বাড়লেও তাকে 'মন্দ বছরের দুর্ভাগ্যজনক পরিণাম' হিসেবেই দেখতে হবে।
চতুর্থত, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি মানে এই নয় যে, এডিপি কাটছাঁট করতে হবে। এডিপি যতটা পারা যায় রক্ষা করতে হবে অন্য সব অপ্রয়োজনীয় সরকারি ব্যয় কমিয়ে এনে। যেসব মেগা প্রকল্প সবার চোখে পড়ে [যেমন_ শহর এলাকার অত্যাধুনিক হাইওয়ে, ফ্লাইওভার বা মেগা আন্তঃসড়ক প্রকল্প] সেগুলোর প্রবৃদ্ধি-অভিঘাত ও বৈদেশিক মুদ্রার ভারসাম্যের ওপর অভিঘাত বিচার করে প্রয়োজনে সেসব আপাতত স্থগিত রাখতে হবে। তবে এডিপির যেসব প্রকল্প বৃহত্তর জনসাধারণকে উপকৃত করবে_ যেমন কৃষি, গ্রাম উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় অবকাঠামো প্রভৃতি প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দিয়ে রক্ষা করতে হবে। কেননা, এসব খাতে সরকারি ব্যয় বেসরকারি খাতের বিনিয়োগকে উৎসাহিত করে, জনগণের সঞ্চয় বাড়াতে সাহায্য করে। এই কারণে ২০১১-১২ অর্থবছরে কেইনসীয় [প্রবৃদ্ধি-বর্ধক] ও মনিটারিস্ট [মূল্যস্ফীতি-সংকোচক] নীতিমালার মধ্যে এক ধরনের বাস্তবোচিত মিশ্রণকে অনুসরণ করা যেতে পারে।
পঞ্চমত, এটা সুবিদিত যে, বাংলাদেশ ব্যাংককে তার মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটি রাজনৈতিক সরকারের রাজস্ব-বিনিয়োগের পলিটিক্যাল ইকোনমির মধ্যে বাস করতে হচ্ছে। এসব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বাংলাদেশ ব্যাংক দক্ষতার সঙ্গে তার মুদ্রানীতি পরিচালনা করছে। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ধারায় অবমূল্যায়িত হচ্ছে [একে জোর করে আটকে ধরে রাখার নীতি হতো সর্বনাশা!]। এর ফলে আশা করা যায়, আমদানি নিরুৎসাহিত হবে এবং আমদানি-রফতানি বাণিজ্য ভারসাম্যে উন্নতি ঘটবে। টাকার বর্তমান অবমূল্যায়নের ধারাকে সরকারের ব্যর্থতা মনে করলে তা হবে এক ধরনের জনতুষ্টিবাদী ভাঁওতাবাজির ফাঁদে পা দেওয়া। সরকার যদি তার মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির সমন্বয়সাধন করতে পারে এবং রাজস্বনীতির মধ্যে জনগণের জন্য সুফলদায়ী বিনিয়োগকে বিশ্বমন্দার [বিশেষত ইউরো-জোনের মন্দার] বছরেও রক্ষা করতে পারে, তবে 'সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা' নিয়ে উচ্চারিত এই নতুন হতাশাবাদও ব্যর্থ বলে প্রমাণিত হবে।
সবশেষে বৈদেশিক দাতাগোষ্ঠীর সঙ্গে আরও নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলা চাই, যেমন চলা চাই রাজনৈতিক বিরুদ্ধ পক্ষের সঙ্গে আরও শিষ্টাচারসম্মত ব্যবহারের ক্ষেত্রেও। বিশ্বায়নের তরঙ্গবিক্ষুব্ধ সমুদ্রে ছিদ্রযুক্ত জাহাজ নিয়ে চললে শুধু সমুদ্রকে দায়ী করলে অব্যাহতি পাওয়া যায় না_ এ কথা রবীন্দ্রনাথ কত আগে বলে গিয়েছেন। কিসিঞ্জার 'চীন সম্পর্কে' তার সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থে বলেছেন যে, পাশ্চাত্য যেখানে প্রতিপক্ষকে শুধু যুদ্ধ করে পরাস্ত করতে শিখেছে [ভন ক্লসউইটজদের মন্ত্রণা মেনে], চীন সেখানে যুদ্ধ না করে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করতে শিখেছে [সুন-জু-এর মতো যুদ্ধ বিশারদদের তত্ত্ব মেনে]। এ কারণে পাশ্চাত্য দাবার চালকে শিরোধার্য বলে রপ্ত করেছে, যেখানে চীন 'ওয়ে চি' নামক খেলাকে আদর্শস্থানীয় মনে করেছে। এই 'ওয়ে চি' খেলার বিশেষত্ব হচ্ছে, প্রতিপক্ষের চালকে রাজনৈতিক ও মনস্তাত্তি্বকভাবে বানচাল করে দেওয়া এবং ক্রমে তার অবস্থানকে ঘেরাও করা। 'যখন যুদ্ধ করবে, তখন ভান ধরবে যে তুমি যুদ্ধ করছ না; আর যখন যুদ্ধ করবে না তখন ভান ধরবে যাতে মনে হয় তুমি বুঝি যুদ্ধ করছ।' ওই ছলনার দরকার। কেননা, কিসিঞ্জার আজ বার্ধক্যে এসে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন সুন-জুর কথা_ যুদ্ধের চেয়ে ধ্বংসাত্মক আর কিছুই হতে পারে না। সে কারণে শান্তিই শিরোধার্য, শান্তিকেই যে কোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে। 'মহাভারত'-এও দেখি : কৃষ্ণ পঞ্চপাণ্ডবের জন্য শুধু পাঁচটি গ্রাম চেয়ে কুরু-পাণ্ডবের মধ্যকার ভ্রাতৃদ্রোহী মহাযুদ্ধ নিবারণ করতে চেয়েছিলেন।
এসব বলা এই কারণে যে, দেশের ভেতরে রাজনৈতিক সুস্থিরতা না থাকলে শুধু অর্থনৈতিক নীতিমালা দিয়ে [তার যে রূপই আমরা এ দেশ এ বছরে শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন করি না কেন] দেশের অর্থনৈতিক শান্তি বা অর্থনৈতিক সুস্থিরতা আসবে না বা তা রক্ষা করা যাবে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আমরা এখনও সুন-জু থেকে শিক্ষা নিতে অনেকখানিই পিছিয়ে রয়েছি। হ

No comments

Powered by Blogger.