হাছন রাজা লোক উৎসব by শামস শামীম

'বাউলা কে বানাইলরে/হাছন রাজারে বাউলা কে বানাইলরে। নেশা লাগিলরে/ বাঁকা দুই নয়নে/ নেশা লাগিলরে।' 'লোকে বলে বলেরে/ঘরবাড়ি ভালা না আমার/রূপ দেখিলামরে/ আপনার রূপ দেখিলামরে...' মরমি কবি হাছন রাজার অন্যতম কালজয়ী জনপ্রিয় গান। হাছন রাজার জনপ্রিয় ও অপরিচিত গানে দেশ-বিদেশের হাজারো দর্শক-ভক্ত মাতাতে সুনামগঞ্জে আজ শুক্রবার থেকে দীর্ঘ দুই দশক পর শুরু হচ্ছে তিনদিনব্যাপী হাছন রাজা লোক উৎসব।


সাম্প্রদায়িক শক্তির আস্টম্ফালন, সংস্কৃতিকর্মীদের মধ্যে অনৈক্য এবং পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে দীর্ঘ দুই দশক বন্ধ ছিল সুনামগঞ্জের প্রাণের এই উৎসবটি। দীর্ঘদিন পরে উৎসবকে ঘিরে স্থানীয় সাংস্কৃতিক অঙ্গন সরগরম হয়ে উঠেছে। নবীন এবং প্রবীণ সংস্কৃতিকর্মীদের মধ্যেও ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা দিয়েছে। মরমি কবি হাছন রাজার ১৫৭তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে হাছন রাজা পরিষদের উদ্যোগে এবার লোক উৎসবটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
এক সময় হাছন রাজা লোক উৎসবকে সুনামগঞ্জের সবচেয়ে সাংস্কৃতিক বৃহৎ উৎসব হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এই উৎসবকে ঘিরে সুনামগঞ্জে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রাণচাঞ্চল্য বিরাজ করত। উৎসবে আমন্ত্রিত হতেন দেশবরেণ্য সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শিল্পী ও সংস্কৃতি অঙ্গনের আলোকিত মুখ। উৎসবে বিভিন্ন সময়ে অতিথি হয়ে এসেছেন সত্যেন সেন, কবি শামসুর রাহমান, হুমায়ূন আহমেদসহ সংস্কৃতি অঙ্গনের উজ্জ্বল মুখগুলো। উৎসবের দিনগুলোতে জেলা শহর বাদেও জেলার সর্বত্র উৎসবের আমেজ বিরাজ করত। নতুন প্রজন্মের সংস্কৃতিকর্মীরা অনুপ্রাণিত হতেন প্রবীণদের কথায়।
১৯৬৩ সালে প্রথমে সুনামগঞ্জের বিশিষ্ট সাংবাদিক, শিক্ষক ও প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব মোঃ আবদুল হাই উৎসব আয়োজন নিয়ে কাজ শুরু করেন। ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত হাছন রাজা লোক উৎসব নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়। পরে দেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক অবস্থা এবং প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর ক্ষমতায়নের ফলে এই নিখাদ সাংস্কৃতিক উৎসবটি বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর স্বাধীনতার পরে ১৯৭৫ সালে আবারও উৎসবের উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং উৎসবটি অনুষ্ঠিত হয়। '৭৫-এর ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনে আবারও ধাক্কা খায় এই উৎসবটি। ফলে বন্ধ হয়ে যায় দ্বিতীয়বারের মতো। এরপরে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯২, '৯৪ এবং সর্বশেষ ১৯৯৫ সালে অনিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়। তারপর আবার দীর্ঘ বিরতি। কারণ, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর লম্ফঝম্প, সংস্কৃতিকর্মীদের মধ্যে অনৈক্য এবং সর্বোপরি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব। এভাবেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বিভিন্ন সময়ে মরমি কবির নামে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক উৎসবটি অনুষ্ঠিত হয়ে আসছিল। কিন্তু প্রতিনিয়ত প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর বাধার কারণে সংস্কৃতিকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। এবার ক্ষোভ কিছুটা প্রশমিত হলেও উৎসবটি নিয়মিত হবে কিনা এ নিয়েও সন্দিহান তারা। তাই সন্দেহের বেড়াজালে বন্দি সংস্কৃতিকর্মীদের মনের আশঙ্কাটি দূর করে দেশ-বিদেশে হাছন রাজার অসাম্প্রদায়িক জীবন দর্শন ও সৃষ্টি ছড়িয়ে দিতে উৎসবটি নিয়মিত আয়োজন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.