গল্প- 'সেদিন অফিসে যায়নি আন্দালিব' by হাবিব আনিসুর রহমান

ডান দিকে মোড় নিয়ে আবার থেমে যায় বাস। সামনে গাড়ির লম্বা লাইন। সিগন্যাল পার হতে পারলে সামনে পান্থপথ। পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট এভাবে কুৎসিত সময় গড়ায়।

গাড়ির ছাদ ক্রমেই তেতে ওঠে। সূর্য তেরচা হয়ে তার শরীরের বাম দিক উত্তপ্ত করে। সকাল দশটা হলেও অসহনীয় গরম। যাত্রীদের মুখে কোনো কথা নাই। কী হবে বলে? প্রতিদিন এভাবেই মূল্যবান সময় নষ্ট হয়ে যায় রাস্তায়। রুমাল বের করে হাত-মুখের ঘাম মোছে কেউ কেউ। আন্দালিবের চোখ পড়ে বাম পাশের বিলবোর্ডের ওপর। সামনের হোটেলের পিৎজা আর পাস্তার বিশাল বিজ্ঞাপনচিত্র। যেন এইমাত্র পরিবেশন করা হলো। টাটকা পিৎজার নিচে লাল অক্ষরে লেখা_হ্যাভ নেভার বিন সো ফ্যাবিউলাস। যেন সুগন্ধ ছড়ায়, জিবে পানি আসার অবস্থা।
নিচে দুটো ফোন নম্বর। সে প্রথম নম্বরটা সেভ করে মোবাইলে। পরে ফোন করে জানবে দামটাম কেমন? মাঝে মাঝে সে এমন করে, নানা অভিজাত জায়গায় ফোন করে। দু'পাঁচ টাকা খরচ হয় তাতে কী? এসবের মধ্যে একটা বৈচিত্র্য পায়। এ হোটেলের সামনে দিয়ে সে যাতায়াত করে তিন বছর, অথচ এক দিনও ভেতরে ঢুকে কোনো মেয়ে বন্ধুকে মুখোমুখি বসিয়ে পিৎজা, পাস্তা, কফি বা ঠাণ্ডা কিছুর অর্ডার দিতে পারেনি। মাঝে মাঝে শায়লার চেহারা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। আজ ওকে ফোন করে বলবে_চলো, আজ সন্ধ্যায় পিৎজাটিৎজা খাই, একটু ঘুরে আসি।
শায়লার জীবনটাও ঝামেলা আর একঘেয়েমিতে ভরা। সম্মতি পেলে পেয়েও যেতে পারে। তবে শায়লা খুব শক্ত মেয়ে। আকাশে উড়তে চেয়েছিল, হঠাৎ মাটিতে পড়ে গেল ধপ করে। তার পরও ওর সেই এককথা_নিয়তি, ভাগ্য এসব মানি না।
এসব হলো দুর্বল মানুষের খোঁড়া যুক্তি, আসলে তারা ভীতু, অক্ষম। স্রোতের সঙ্গে ভেসে যাওয়া মানে ওইসব ভাগ্যকে মেনে নিয়ে বলা আমি দুর্ভাগ্যের শিকার। যে স্রোতের বিপরীতে সাঁতরাতে পারে, সে-ই হচ্ছে সফল মানুষ, অথচ সাধারণ লোকে তাদের বলে ভাগ্যবান। একবারও দেখে না সৌভাগ্যটা সে আদায় করে ছেড়েছে।
শায়লার ভাবনা দারুণ প্রভাবিত করে আন্দালিবকে। সে কি নিজেকে একটা ভীতু বা অক্ষম মনে করে! আজ ফোন করবে। সামনে যানজট কখন কাটবে, এগিয়ে যাবে বাস! যাত্রীরা কেউ কোনো কথা বলে না, সব চুপচাপ। আন্দালিবের ইচ্ছা করে খুব জোরে একটা চিৎকার দেয়, কিন্তু পারে না, দেওয়া হয় না। মানুষ বলবে লোকটা পাগল, মাথা খারাপ। এর মধ্যে জানালা দিয়ে ছোট ছোট কাগুজে বিজ্ঞাপন এসে পড়ে যাত্রীদের কোলের ওপর। সময় কাটাতে ধীরে ধীরে মনোযোগ দিয়ে বিজ্ঞাপন পড়ে আন্দালিব_যারা যৌন অক্ষমতায় ভুগছে তাদের লিঙ্গে ড্রাগন তেল মালিশ করতে বলা হয়েছে, কেউ বিফল হলে মূল্য ফেরত দেবে কম্পানি। ছিঁড়ে ফেলে ছুড়ে মারে জানালা দিয়ে। আরে তেল মালিশ করে সফল হলো না ব্যর্থ হলো, এটা বোঝা যাবে কেমন করে, রাবিশ_পাশের যাত্রী বলল। যাত্রীদের মুখে একটু হাসি ফুটে আবার মিলিয়ে যায়। তখনই বাসটা গর্জন করে সামনে এগিয়ে যায়। কিন্তু এক শ বা সোয়া শ গজ গিয়ে আবার থামে। লম্বা চুলওয়ালা এক যুবক জানালা দিয়ে মাথা বের করে সিগন্যালের দিকে তাকিয়ে চিৎকার দেয়_তোদের গুষ্টি আমি চুদি শালা খানকির পুতরা, এইটা কোন সভ্য দেশ! চারপাশের থেমে থাকা গাড়ির ইঞ্জিন আর হর্নের শব্দের সঙ্গে শূন্যে মিশে যায় যুবকের চিৎকারধ্বনি। দু'একজন যাত্রী যুবককে শাবাশ দেয়_গালিটা এক্কেরে ঠিকমতো দিছেন ভাই। দশ-বারো বছরের একটা ছেলে, হাত-পা, শরীর অস্বাভাবিক, কোনো রকমে আসনের রড ধরে দাঁড়িয়ে কাঁদে_'বাজানরা আমার দিকে একটু চাইয়া দেহেন, বাবা, কিছু করতে পারি না, বাপ-মা মইরা গেছে, দুইডা ছুডু বোইন লইয়া বস্তিতে থাহি, প্যাটের খিদায় হাত পাতছি বাজান, যে যা পারেন দেন বাবা...।' যাত্রীদের পকেট থেকে দুই টাকার নোটগুলো বের হয়ে ছেলেটার হাতে পড়ে। ওকে দেখে অবাক হয় আন্দালিব, মানুষের শরীর এমন অস্বাভাবিক হয় কী করে! কেউ কোনো কিছু দিয়ে ওর হাত-পা ছেঁচেছে মনে হয়!
আন্দালিব মোবাইল বের করে কথা বলে_স্যার, আমি বাসের ভেতর, পুরো শরীর কেঁপে জ্বর এল হঠাৎ, ভীষণ মাথাব্যথা, রাস্তায় অসম্ভব জ্যাম, আমি ফিরে যাচ্ছি স্যার, অফিসে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না... স্লামালেকুম।
আন্দালিব বাস থেকে নেমে ভিক্ষুক ছেলেটাকে খোঁজে। ততক্ষণে ছেলেটা পেছনের বাসে ঢুকে পড়ে। সড়কদ্বীপের ওপর গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে আন্দালিব।
পান্থপথের উঁচু ভবনগুলোর পাশে বেমানান একটা টিনের চালার হোটেলে বসে আন্দালিব। বসকে এক শ ভাগ মিথ্যা বলেছে। ও মাঝে মাঝে এটা করে। নিজের জন্য দু'একটা দিন অন্য পাঁচটা অসহনীয় একঘেয়ে নিরানন্দ দিন থেকে বের করে নেয়। আসলে এটা কোনো মিথ্যাচার নয়, হয়তো ভেতরের মানুষটা সত্যিই জ্বরে পুড়ছে, মাথা যন্ত্রণায় ছটফট করে, অথচ কাউকে কিছুই বলা হয় না।
ভিক্ষুক ছেলেটাকে সামনের চেয়ারে বসতে যেতে সাহায্য করে সে,
_কত দিন ভিক্ষা করছিস? পাশে এসে দাঁড়ানো বয়টাকে বলে_একে চা-শিঙ্গাড়া দাও।
পরপর দুটো শিঙ্গাড়া খেয়ে সে আন্দালিবের দিকে তাকায়। তাকে এভাবে ডেকে হোটেলে বসিয়ে শিঙ্গাড়া খাওয়ার দাওয়াত দেওয়ায় সে ভীষণ আনন্দিত।
_আর খাবি?
_হ খামু। সে মাথা নাড়ে।
_এই একে আরো দুটো শিঙ্গাড়া দাও। বয়কে বলে। ছেলেটা শিঙ্গাড়া, পানি, চা খায় খুব দ্রুত। কথা বলে,
_আপনে সাংবাদিক?
_মনে হচ্ছে?
_জানি না।
_কত দিন ভিক্ষা করছিস?
_পাঁচ বছর।
_ডেইলি ইনকাম কত?
_কওন নিষেদ আছে আমাগো। চারপাশে তাকায়, তার চোখেমুখে ভয়।
_তোর বাবা-মা, ভাই-বোন কেউ নাই?
_সাংবাদিক, যদি ফুডু তুইলা প্যাপারে দেন, লগে আমার ইনকাম লেখেন, তাইলে অরা আমারে মাইরা ফালাইব।
কারা?
_আছে আপনে বুজবেন না, তয় আপনেরে আমি কিছু কমু।
_ভয় পাস না আমাকে?
_আপনে তো সাংবাদিক না।
_কেমনে বুঝলি?
_আপনের ব্যাগ দেইখ্যা, যারা সাংবাদিক তাগো ব্যাগ ছুডু, লগে ক্যামেরা থাহে। হেরা খুব চালাক।
_তাই নাকি? তাহলে আমাকে কিছু বল?
_আমরা বিক্কা কইরা যা ইনকাম করি, আমাগো সব ট্যাহা আব্বা লুফে নিয়া যায়।
_আব্বাটা কে?
_আমাগো মালিক, বস্তির ভেতরে আমরা অনেক লুলা-কানা থাহি, এগুলারে লুলা-কানা বানাইছে বিক্কা করণের লেইগা।
_বলিস কী? থাক, এসব কথা থাক। ভালো লাগছে না, তুই যা। ছেলেটা হাসে,
_একখান কতা কই সার?
_কী, জলদি বল।
_বিরানি খামু।
_এখানে ওসব খাবার পাওয়া যায় না। তুই এখন যা।
_আসসালামু আলাইকুম, যাইগা সার, আপনে মানুষটা বহুত ভালা।
ছেলেটা চলে গেলে এক কাপ চা দিতে বলে আন্দালিব। সামনের বিলবোর্ডের দিকে তাকায়। সাত দিনে সুন্দরী হওয়ার শ্রেষ্ঠ ক্রিম। পত্রপত্রিকা-বিলবোর্ড ছেয়ে গেছে এসব ক্রিমের বিজ্ঞাপনে। প্রতিদিনের সৌন্দর্য প্রবৃদ্ধির প্রমাণ। পাশে ক্যাটরিনা কাইফ বাচ্চা মেয়েদের ফ্রক পরে বসে আছে। তার উঁচু বুক, কোমর, পাছা, উরুদেশ গোলাপি ফিনফিনে পাতলা ফ্রকের ভেতর প্রায় দৃশ্যমান। অবিশ্বাস্য সুন্দরী মেয়ে ক্যাটরিনা অসংখ্য মানুষের সামনে জীবন্ত একটা হাসি নিয়ে আকাশে ভাসে। আন্দালিব ভাবে, যারা ফোকশাস্ত্র বিশেষজ্ঞ, তারা আগে আর্টিস্টকে বলে_স্কেচ করো, তারপর ফটোগ্রাফারকে সব কিছু বোঝানো হয়। তা না হলে ক্যাটরিনা কেন এমন প্রচণ্ডভাবে দোলা দেবে যুবকদের দেহমনে। আর বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি নারী কেন এমন উতলা হয়ে সুন্দরী হতে চাইবে? হোটেল থেকে বের হয়ে আবার ফিরতি বাসের জন্য ফুটপাতে গিয়ে দাঁড়ায় আন্দালিব। অঙ্ক কষে_বাসে করে যারা অফিস করে তারা প্রতিদিন পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা রাস্তায় কাটায়। এভাবে এতগুলো ঘণ্টা রাস্তায় নষ্ট হয়ে গেলে জীবনে আর কী থাকে!
মেসের দরজার কড়া নাড়তেই চিৎকার দিল বুয়া_কেডা? খাড়াইয়া থাহেন। আন্দালিব আবার করা নেড়ে বলে_দরজা খোল, আমি। বুয়া আন্দালিবকে দেখে হাসি দেয়,
_আপনে! অফিসে গেলেন আবার ফিইরা আইলেন বুজলাম না!
_কেন তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে? তোমাকে এত কিছু বুঝতে হবে না, যাও।
_রাগ করেন ক্যান? আমি কি খারাপ কথা কইছি?
আন্দালিব রুমের তালা খুলে ফ্যানের সুইচের সামনে দাঁড়ায়। আছে কি বিদ্যুৎ? সে সুইচ টেপে, কিন্তু ফ্যান ঘোরে না। ব্লেডগুলো স্থবির অনড়। একটু আগের বাসের চাকার মতো থেমে আছে, ঘোরে না। তীব্র আক্রোশে ফেটে পড়ে আন্দালিব, তোমাদের গুষ্টি আমি... মুখ দিয়ে সেই গালিটা বের হয়। বুয়া এসে বলে_স্যার এইসব কী কইতাছেন? বুয়ার মুখে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম। রং কালো হলেও এ মুহূর্তে তাকে ক্যাটরিনা মনে হয় আন্দালিবের। বুকে ওড়না পেঁচানো। শরীরের গাঁথুনি চমৎকার। সে বুকের ওপর থেকে ওড়নাটা সরিয়ে দু'বার ঝাড়া দিয়ে গলায় জড়াল। উদ্ধত বুক দুটো প্রদর্শন করল আন্দালিবকে।
_স্যার আপনে তো টায়ার, এক কাপ চা আনি?
_তোমার উদ্দেশ্যটা কী বলো তো বুয়া?
_স্যার, এখন তো মাসের পয়লা হ্না, আপনে কইলাম আমারে দুই শ ট্যাকা কর্জ দিবেন।
আন্দালিব বুয়ার আহ্বানে সাড়া না দিয়ে বলে,
_তুমি এখন যাও, কাজ করো। আমি রেস্ট নিয়ে খাওয়াদাওয়ার পর বাইরে যাব, জরুরি কাজ আছে।
_লন, রেস্ট লন স্যার, কোনো কিছু লাগলে আমারে কইয়েন।
শুয়ে পড়ে আন্দালিব। উঠে ফ্যানের সুইচটা দেখে অন করা আছে তো? কানের পাশে মোবাইল ফোনটা রেখে গান শোনে_এক-একটা দিন বড় একা লাগে... ঘুম চোখ খুলে দেখি ভোর নেই আজ ভালো করে সকালটা পাওয়া হয় না...। উঠে বসে আন্দালিব_শালা গুষ্টি মারি তোমাদের একাকিত্বের। কিসের ভোর, কিসের সকাল, বাস ধরার সময় পাই না আবার ভোর সকাল!
বুয়া সামনে এসে দাঁড়ায়,
_লন স্যার চা খান, খুব সুন্দর কইরা বানাইছি, চা খাইলে শরীলডা ভালা লাগব।
_বুয়া এসব কী শুরু করলে তুমি? আমি জানি তুমি কেন এত শয়তানি শুরু করেছ, যত কিছুই করো, টাকা তোমাকে দিচ্ছি না।
_চা খান, আমার ট্যাকার দরকার নাই।
চায়ের সঙ্গে দুই টাকার ছোট্ট বিস্কুটের প্যাকেট এনেছে বুয়া। আন্দালিব চায়ের কাপটা হাতে নেয়। শায়লার কথা ভাবে। অসময়ে হঠাৎ সে মোবাইলের নম্বর টেপে। কানে ধরে অপেক্ষা করে... হ্যাঁ রিং হচ্ছে... কাপটা পাশে রেখে চিত হয়ে শুয়ে বুকের কাছে রাখে মোবাইলটা, রেখে লাউডস্পিকারটা অন করে...
_হ্যাঁ আন্দালিব, কেমন আছ?
_তাহলে নামের তালিকা থেকে আন্দালিব আখন্দকে ডিলিট করে দাও নাই, ভালো আছি, তুমি?
_ভালো, হঠাৎ অসময়ে!
_তোমার ওখানে আসতে চাচ্ছি।
_কেন, কী ব্যাপার?
_মোনোটোনাস, ভীষণ বাজে একটা সময় যাচ্ছে, সন্ধ্যাবেলা সময় হবে? ধরো তোমাকে নিয়ে বের হলাম?
_হঠাৎ! এত দিন তো চুপচাপ ছিলে?
_যেকোনো সময় মরে যেতে পারি তাই না?
_বাইরে গেলে তো অনেক খরচ, আবার সময় নষ্ট, তা ছাড়া বড় সমস্যা তো... কোথায় যাবে?
_যাবো মানে ভীষণ একঘেয়ে লাগছে, ভাবছি কোনো বড় হোটেলে বসব...গল্প করব...
_বড় হোটেল! আদার ব্যাপারি জাহাজের খবর নিচ্ছ, কী ব্যাপার?
_আদা এখন অনেক মূল্যবান, আবার সেটা জাহাজে করেই আসে, আদার ব্যাপারি হতে পারলে তো বারিধারা, গুলশানে একটা দামি ফ্ল্যাট কিনে ফেলতাম...
_(হাসির শব্দ) কী খাওয়াবে?
_এই পিৎজা বা পাস্তা, ধরো একটু কফি অথবা তুমি বললে অন্য কিছু...
_বেতন পাইছ, না?
_হ্যাঁ, পেয়েছি। তুমি চাইলে ইচ্ছামতো খরচ করতে রাজি আছি...
_আন্দালিব, হোটেলে বসে দামি পিৎজা খাওয়ার চেয়ে আমার এখন টাকার দরকার অনেক বেশি। চলে এসো, যাওয়ার চেষ্টা করব।
আন্দালিব আখন্দ বহুদিন পর হাসে।
প্রতিটি দিনই তো হাসিবিহীন চলে যায়, আজ না হয় একটু হাসি... মনে মনে বলে সে। শায়লা যেতে বলেছে, এর চেয়ে বড় আনন্দ আর কী হতে পারে!
এটা শুধু শায়লার অনুমতি নয়, হতে পারে এটা এক ধরনের আমন্ত্রণ। আন্দালিব যেমন একঘেয়ে নিরানন্দ জীবনযাপন করে, শায়লার জীবনটাও তো এমনই। সে যেমন শায়লার সানি্নধ্য কামনা করে, একইভাবে শায়লাও হয়তো ওর সানি্নধ্য ভালোবাসে। আন্দালিব কল্পনা করে_আলো-আঁধারিতে মুখোমুখি বসে ওরা দুজন গল্প করছে, শায়লাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে।
উঠে বসে আন্দালিব। বুয়া দরজায় দাঁড়িয়ে। নিশ্চয় সে কাপ নেওয়ার ছুঁতো করে ওর কথোপকথন শুনেছে! যা ভেবেছে ঠিক তাই, বুয়া বলে,
_বেতন পাইছেন ভালো কতা, কিন্তু একদিনে ওই বেডির ধারে সবটি ট্যাকা উড়াইবেন, তারপর কাইল বিয়ানে মন্নান স্যারের কাছে ট্যাকা কর্জ করবেন, এইডা কি ভালা?
হঠাৎ আন্দালিবের মাথায় রক্ত উঠে যায়। লায় পেয়ে মাথায় উঠে গেছে বুয়াটা, ওর এত বড় সাহস। সে বুয়ার সঙ্গে অস্বাভাবিক তর্কে লিপ্ত হয়।
_তোমার কোনো কাম-কাইজ নাই স্টুপিড মহিলা, এক কাপ চা দিয়ে আমার মাথা কিনে নিয়েছ তাই না?
_যা কইছি আপনের ভালার লেইগাই কইছি, চেতেন ক্যান?
আন্দালিব নিচে নেমে দাঁড়ায়। ইংরেজি কমেডি সিরিজের নায়ক যখন সীমাহীন রেগে গিয়ে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে নিচুস্বরে ধীরে ধীরে কাঁপতে কাঁপতে সংলাপ বলে, তেমন করে সে বলে,
_শাট আপ স্টুপিড, তুমি কি বুঝতে পারছ, কী বলছ? দেখো বুয়া, সাংবিধানিকভাবে যেটা তোমার জন্য প্রযোজ্য নয়, সেটা বলা বা করা তোমার উচিত নয়, এসব আমার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার, তুমি কাজের বেটি, তুমি তোমার জায়গায় থাকো, আমাকে আমার জায়গায় থাকতে দাও, বেশি রাগালে ঘাড় ধরে বের করে দেব...
_ভালা কতা, খুব ভালা কতা, ম্যাসে পরথম যখন আইছিলেন, তখনকার কতা সবটি ভুইল্যা গেলেন, তখন আমার লগে যা কিছু করছেন, যা কিছু বলছেন ওইগুলা কি সংবিধান আছিল...
_উফ্ অসহ্য, আমি ভুল করেছি অসময়ে রুমে ফিরে, আমি ভুলেই গেছি, তুমি শুধু একজন কাজের বুয়া নও, তুমি আসলে ঝগড়াঝাঁটিতে পারদর্শিনী একজন মুখরা মেয়েলোক।
দরজা লাগিয়ে শুয়ে পড়ে আন্দালিব। চিত হয়ে পা নাচায় আর রাগ দমন করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। শেষে পুরো বিষয়টাকে অ্যান্ট্রিথিসিস থেকে একটা সিনথিসিসে নিয়ে আসে। মেসের বেটিগুলোর দোষ কী? ব্যাচেলররা এখানে থেকে চাকরি করে, চাকরি খোঁজে। এদের সবার বিয়ের বয়স পার হলেও বিয়ে করতে পারে না। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করলে তাদের পেছনে মাসের বেতনের অর্ধেকটা চলে যাবে। ওসবের থেকে কাজের বুয়াই সস্তা। শুধু শুধু বুয়াকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। জোয়ার্দার তো এক বিকেলে বুয়াকে সাজিয়ে-গুছিয়ে রমনা পার্কে নিয়ে গিয়ে চটপটি, ফুচকা খেয়ে এল। সবাই যখন জোয়ার্দারকে বলল_ব্যাপার কী, হেসে উত্তর দেয় জোয়ার্দার_ব্যাপার তেমন কিছু না, এই একটু চেঞ্জ আর কী!
ডোরবেল টিপতেই দরজা খোলে শায়লা। পোশাক-পরিচ্ছদে সব সময় ভীষণ সচেতন সে। হালকা গোলাপি রঙের পাতলা ফতুয়া, তার সঙ্গে গাঢ় কালো জিন্স পরেছে। ওড়নাটা গলায় জড়ানো, ব্রাউন কালার করা চুল, উন্নত নাক, উঁচু বুক, সব মিলিয়ে শায়লা সর্বদা অতুলনীয়। আবার এ-ও হতে পারে, শায়লা সম্পর্কে আন্দালিবের উদার দৃষ্টিই শায়লাকে আর পাঁচজন নারী থেকে ওই অতুলনীয় করে তুলেছে। একটা বড় দুর্ঘটনা ঘটে গেলেও জীবন নিয়ে ভীষণ আশাবাদী শায়লা। নিজের ফিগার, পোশাক, শরীরের রং_এসব নিয়ে তার ভাবনার অন্ত নেই। শায়লা কথা বলে,
_দেখে মনে হচ্ছে বেশ ভালো আছ?
_আছি, তোমার অবস্থা কী?
_ভালো, তোমাকে এত স্মার্ট লাগছে, কী ব্যাপার?
_কী জানি আমি তো নিজেকে দেখতে পাচ্ছি না।
_আগে তো একটা নাম্বার ওয়ান ক্ষেত ছিলা, তাই না?
_আর এখন?
_দারুণ।
সোফার ওপর খুব কাছাকাছি বসেছে ওরা।
দুজন দুজনার শরীরের ঘ্রাণ পায়। শায়লা সব সময় সুগন্ধি ব্যবহার করে। আন্দালিব খুব বড় করে একটা শ্বাস টেনে নেয়, এই মুহূর্তে ওটা একটা প্রাণদায়িনী কিছু। প্রতিদিন সকালে উঠে মেসের খাবার, ফুটপাতে দাঁড়িয়ে বাসের অপেক্ষা, বাসের ভেতর ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে অথবা দাঁড়িয়ে থাকা, আবার রাতে মেসে ফিরে একদম ফালতু বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক। অসহ্য একঘেয়ে নিরানন্দ সব। আন্দালিব বলে,
_এত ঝড়ঝাপ্টার পরও তুমি কিভাবে দাঁড়িয়ে আছ!
_দাঁড়িয়ে না থাকলে তো খড়কুটোর মতো ভেসে যাবো, তাই না?
_তোমার মুখ দেখে কিন্তু কিছুই বোঝা যায় না, মনে হয় তুমি আগের মতোই আছ।
_সকালে একটা বুয়া আসে। ও সব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে, রান্নাও করে; কিন্তু দুপুরে চলে যায় রাতে থাকে না।
_তাহলে রাতে?
_রাতের জন্য আর একজন আসে। কলেজে পড়া মেয়ে। রাতে থাকে, টিভি দেখে, গান শোনে, মেহেদীকে দেখে। আমি বাজারে গেলে ওর হাতেই সব সংসার ছেড়ে দিয়ে যাই। এ ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
_আত্মীয়স্বজন কাউকে এনে রাখা যায় না?
_না, ওর বা আমার তেমন কেউ নেই যে বেকার, এখানে থেকে সেবা দিতে পারবে। তা ছাড়া এটা সম্ভবও নয়। এখন যারা থাকে, তাদের আমি পে করি। ওরা আমার চলাফেরায় ইন্টারফেয়ার করে না, কিন্তু আত্মীয়স্বজন হলে নানা সমস্যা। তোমাকে অন্য একটা কথা বলি আন্দালিব...
_বলো...
_আমার আসলে একটা বড় অঙ্কের লোন দরকার। তোমাদের অফিস থেকে একটা লোনের ব্যবস্থা করতে পারবে?
_কেমন?
_ধরো পাঁচ থেকে সাত লাখের মধ্যে।
_শোধ করবে কেমন করে!
_পারব, আমার বিশ্বাস আমি খুব কম সময়ে পরিশোধ করতে পারব। এই শহরে তরুণী মেয়েদের ওপর আমার অনেক আস্থা, তা ছাড়া ওরা ভীষণ পজিটিভ...
শায়লার শরীরের গন্ধ এখন ঘরময় ভেসে বেড়ায়। আন্দালিবের ভেতরে প্রচণ্ড কোলাহল। শায়লার সম্মতি পেলে এখনই তাকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিত রঙিন ঠোঁট দুটো, তার বুক দলিত-মথিত হতো শক্ত হাতে। দ্রুত কল্পনায় একটা পরিপূর্ণ সঙ্গমের ছবি আঁকে আন্দালিব আখন্দ। শায়লা কী ভাবছে এখন! সময়টা পার করা বড্ড কঠিন হয়ে পড়ে আন্দালিবের। সে নীরবতা ভাঙে।
_তুমি রেডি হও। সময় নষ্ট করে লাভ কী?
_ও তো এখনো এল না! ঘড়ি দেখে শায়লা, আনমনে কিছু বলে...
হঠাৎ ডোরবেল বেজে ওঠে। কে? ও সেই মেয়েটা যে শায়লার কাছে থাকে, প্রতি মাসে শায়লা যাকে বেতন দেয়। আন্দালিব ভাবে সেই মেয়েটা চলে এসেছে তাহলে! নিশ্চয়ই! একটু পরই তারা দুজন বের হতে পারবে। একটা ট্যাঙ্ িনেবে। তারপর ভোঁ করে ছুটবে হোটেলের দিকে। সেই সকালে দেখা বিজ্ঞাপন...পিৎজা অ্যান্ড পাস্তা...হ্যাভ নেভার বিন সো ফ্যাবিউলাস...পিৎজা অথবা পাস্তা...আবার সেই অশ্রুতপূর্ব পাখির ডাকের ছন্দে বেজে ওঠে ডোরবেলটা। উঠে দাঁড়ায় শায়লা, ঘড়ি দেখে...
_ভদ্রলোক এলেন মনে হয়?
_ভদ্রলোক!
_ওই যে লোকের ব্যাপারটা, তোমাকে যেটা বলছিলাম...
_তুমি যে বললে সন্ধ্যায় কাজের মেয়ে আসে, রাতে থাকে...
_হ্যাঁ, দুজনার একজন হবে।
_বুঝলাম না লোন দেবে কে!
_মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির সেই অফিসারটা, উনিই লোনের ব্যবস্থা করে দেবেন...
_কী নাম লোকটার?
শায়লা বিরক্ত হয় অথবা হয় না। আন্দালিবের কথার উত্তর দেবে কি দেবে না বোঝা যায় না। সে উঠে দাঁড়ায়। শায়লা এখন ধীরস্থির পায়ে হাঁটে। উত্তর দেয় শেষমেশ,
_নামটা তো ঠিক জানি না, আমি একটা ফ্যাশন হাউসের জন্য লোন চেয়েছি। ভদ্রলোক নিশ্চয়ই ব্যবস্থা করে দেবেন। (শায়লা দ্রুত কিছু ভাবছে)
আন্দালিব, কলেজের সুন্দরী তরুণী মেয়েরা আমার সঙ্গে কাজ করবে, আমাদের টার্গেট হবে প্রথমে দেশ, তারপর দেশ ছাড়িয়ে আমাদের পণ্য বিদেশে রপ্তানি হবে, হবে মানে হবেই, তুমি দেখে নিও। শায়লা এবার আন্দালিবের একটা হাত ধরে...আন্দালিব শায়লার দিকে তাকায়...শায়লা বলে, আমার সঙ্গে এসো, আন্দালিবকে বেডরুমে নিয়ে যায়, খাটের পাশে চেয়ারে বসিয়ে শায়লা কথা বলে চলে...মেহেদী ঘুমাচ্ছে...ঘুম ভাঙলে তুমি বলবে, আপনাকে দেখতে এলাম...কেমন আছেন? আপনার স্ত্রী তো আপনাকে ইন্ডিয়ায় নিয়ে যাওয়ার সব ব্যবস্থা করছে, বলবে উন্নত চিকিৎসা দেবে... তুমি মেহেদীকে সাহস দেবে, বলবে...ভয়ের কিছু নেই, ফিজিওথেরাপি দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে...ও তো বিয়ের পর থেকেই তোমাকে চেনে তাই না...দেখবে ও কথা বলতে চাচ্ছে, কিন্তু পারছে না...ওর ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠবে...বাম হাতটা একটু ওপরে ওঠানোর চেষ্টা করবে, কিন্তু পারবে না, শুধু চোখ দিয়ে পানি গড়াবে...তোমার দিকে অপলক চেয়ে থাকবে...হাজারো প্রশ্ন থাকবে সেই চাহনিতে, কিন্তু একটা প্রশ্নও করতে পারবে না...তুমি কিন্তু চুপ করে থাকবে না প্লিজ...শুনছ আন্দালিব...আগের কথাগুলোই রিপিট করে যাবে কেমন...ডোরবেল বেজে চলেছে। অদ্ভুত একটা ডোরবেল ঘরে লাগিয়েছে শায়লা...বউ কথা কও, বউ কথা কও...শায়লা হাসে অথবা সে হাসে না, মনে হয় তার চোখ দিয়ে পানি গড়ায়, সে বলে...বিয়ের পর মেহেদী এ বেলটা লাগিয়েছিল... অফিস থেকে এসেই ওটা টিপলে এভাবে বেজে উঠত। শায়লা বেডরুম থেকে ড্রইংরুমের দিকে হেঁটে যায়, মনে হয় ও দরজাটা খুলবে।
===============================
বিজ্ঞান আলোচনা- মানবযকৃৎ উদ্ভাবনে বিজ্ঞানীরা সফল  খবর- দিলমা রুসেফ । নারী গেরিলা থেকে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট  আলোচনা- 'সকল গৃহ হারালো যার' by তসলিমা নাসরিন  রাজনৈতিক আলোচনা- 'বিষয় কাশ্মীর-ইনসাফ ও স্বাধীনতা by অরুন্ধতী রায়  ইতিহাস- 'ক্রিস্টোফার কলম্বাসের ডায়েরি' by শাহাদুজ্জামান  বিজ্ঞান আলোচনা- নাসা আজীবনের জন্য মঙ্গলে মানুষ পাঠাবে  ফিচার- ‘বাইশ্যা নাচ' by মৃত্যুঞ্জয় রায়  আদিবাসী আলোচনা- 'বেদিয়া নাকি সাঁওতাল' by সালেক খোকন  আলোচনা- 'পর্যটন ও জীববৈচিত্র্য:প্রেক্ষাপট-বাংলাদেশ হেমায়েত উদ্দীন তালুকদার  খবর- নাগোয়া সম্মেলনে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ঐতিহাসিক চুক্তি  খবর- ছয় দশক পর দুই কোরিয়ার স্বজনদের পুনর্মিলন


কালের কণ্ঠ এর সৌজন্যে। শিলালিপি থেকে
লেখকঃ হাবিব আনিসুর রহমান

এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.